সরকারি কর্মচারীদের খোলা চিঠি ২০২৫ । ১০ বছরে সরকারি চাকরিতে ‘বেতন বৃদ্ধি শূন্য’, ডলারের মানদণ্ডে ক্ষতি ২০,০০০ টাকা!
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলেও স্থবির নবম গ্রেডের বেতন, ভয়াবহ বৈষম্যের শিকার নতুন যোগদানকারীরা- সরকারি চাকরিতে নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়নের আলোচনা যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই বেরিয়ে এলো এক চাঞ্চল্যকর ও উদ্বেগজনক তথ্য। ২০১৫ সালের বেতন কাঠামোর পর পেরিয়ে গেছে প্রায় এক দশক।
এই দীর্ঘ সময়ে দ্রব্যমূল্য, জীবনযাত্রার খরচ এবং ডলারের বিনিময় মূল্য আকাশ ছুঁয়েছে। অথচ, সরকারি চাকরিতে নবম গ্রেডে (যা প্রথম শ্রেণির গেজেটেড পদমর্যাদা) একজন নতুন যোগদানকারী যে মূল বেতনের কাঠামোতে প্রবেশ করতেন, ২০২৫ সালেও তিনি কার্যত একই পরিমাণ টাকায় প্রবেশ করছেন। এই স্থবিরতার ফলে ডলারে বেতন কমেছে প্রায় ১৬৮ ডলার, যা টাকার অঙ্কে প্রায় ২০,০০০ টাকা কম।
ক্ষতিগ্রস্ত একাধিক সরকারি চাকুরিজীবীর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই দশ বছরে সরকারি বেতন কাঠামোতে বেতন বৃদ্ধি না হওয়ায় নতুন যোগদানকারী থেকে শুরু করে সকলের জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
💸 ১০ বছরে বেতন-কাঠামোর অসামঞ্জস্য:
| বিবরণ | ২০১৫ সালের অবস্থা | ২০২৫ সালের অবস্থা | বৈষম্য (১০ বছরে) |
| ৯ম গ্রেডে মোট বেতন (আনুমানিক) | ৩৫,০০০+ টাকা | ৩৫,০০০+ টাকা | বেতন বৃদ্ধি শূন্য |
| ডলারের বিনিময় হার (আনুমানিক) | ৭৭ টাকা | ১২২ টাকা | 0-0 |
| ডলারে বেতনের মূল্যমান | ৪৫৫ ডলার | ২৮৭ ডলার | ১৬৮ ডলার কম |
| টাকার অঙ্কে ক্ষতি (১৬৮ ডলার x ১২২ টাকা) | 0-0 | 0-0 | প্রায় ২০,০০০ টাকা কম |
পর্যালোচনা:
১. স্থবিরতা: ২০১৫ সালের পে-স্কেল অনুযায়ী ৯ম গ্রেডে যোগদানকারী একজন কর্মী সর্বমোট প্রায় ৩৫,০০০ টাকা পেতেন। ১০ বছর পর, অর্থাৎ ২০২৫ সালেও একই পদে যোগদানকারী একজন কর্মী প্রায় একই পরিমাণ বেতন পাচ্ছেন।
২. মূল্যমানের অবক্ষয়: যদিও টাকার অঙ্কে বেতন একই, কিন্তু ডলারের হিসাবে বেতন কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং বেতন না বাড়ার কারণে ২০১৫ সালের ৪৫৫ ডলারের বিপরীতে এখন পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ২৮৭ ডলার। এর ফলে, নতুন যোগদানকারীরা তাদের ২০১৫ সালের সমকক্ষদের চেয়ে মাসিক প্রায় ২০,০০০ টাকা কম আর্থিক সুবিধা ভোগ করছেন।
🌶️ জীবনযাত্রার খরচের সাথে বেতনের ব্যবধান:
গত ১০ বছরে দ্রব্যমূল্যের ভয়াবহ বৃদ্ধি এই বেতনের স্থবিরতাকে আরও প্রকট করেছে। কিছু অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দামের তুলনামূলক চিত্র:
| পণ্য | ২০১৫ সালে দাম (আনুমানিক) | ২০২৫ সালে দাম (আনুমানিক) | বৃদ্ধি |
| গরুর মাংস (কেজি) | ৩০০ টাকা | ৮০০ টাকা | প্রায় ১৬৬% বৃদ্ধি |
| স্বর্ণ (ভরি) | ৪০,০০০ টাকা | ২ লাখ+ টাকা | ৪০০% এরও বেশি বৃদ্ধি |
সরকারি চাকুরিজীবীদের দাবি, যেখানে ১০ বছর আগে একজন মানুষ ৩০০ টাকায় এক কেজি মাংস কিনে মধ্যবিত্তের জীবনযাপন করতে পারতেন, সেখানে এখন ৮০০ টাকায় সেটি কেনা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে, যে বেতনে এক দশক আগে স্বাচ্ছন্দ্য ছিল, সেই একই বেতনে এখন জীবনধারণ করাই দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দ্রষ্টব্য: বর্তমানে একজন দিনমজুরের দৈনিক পারিশ্রমিক ৬০০-৮০০ টাকা বা তার বেশি। এই পারিশ্রমিক অনেক ক্ষেত্রে নবম গ্রেডে নতুন যোগদানকারী একজন কর্মকর্তার দৈনিক বেতনের কাছাকাছি বা তার চেয়েও বেশি। এই বৈষম্য সরকারি চাকুরির আকর্ষণ এবং মর্যাদা দুটোই কমিয়ে দিচ্ছে।
🚨 দাবি: নবম পে কমিশন বাস্তবায়ন অতিজরুরী
শিল্প কারখানার শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু সরকারি চাকুরিজীবীরা এখনও ২০১৫ সালের বেতন কাঠামোতে আটকে আছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ডলারের বিপরীতে টাকার মান হ্রাস এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির এই পরিস্থিতিতে সরকারি চাকুরিজীবীদের, বিশেষ করে নতুন যোগদানকারীদের জীবনধারণ অসম্ভব হয়ে উঠছে।
এই খোলা চিঠির মাধ্যমে নবম পে কমিশন অবিলম্বে বাস্তবায়ন করে সরকারি চাকুরিজীবীদের বেতন কাঠামোকে বর্তমান বাজার পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার দাবি জানানো হচ্ছে। অন্যথায়, সরকারি চাকুরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করা কঠিন হবে এবং অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ: দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে নবম পে-স্কেল ঘোষণার জন্য জোর দাবি জানানো হলো।
বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য জাতীয় বেতন স্কেল, ২০১৫ কার্যকর আছে। এটিই বর্তমানে সরকারি কর্মচারীদের বেতন ও ভাতাদির মূল ভিত্তি।
২০১৫ সালের পর থেকে সরকারি কর্মচারীরা এই স্কেলের ভিত্তিতেই বেতন-ভাতা পাচ্ছেন, তবে প্রতি বছর তাদের মূল বেতনের উপর একটি নির্দিষ্ট হারে (সাধারণত ৫% হারে) বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট যুক্ত হচ্ছে।
নিচে ২০১৫ সালের বেতন স্কেল অনুযায়ী বিভিন্ন গ্রেডের মূল বেতনের কাঠামো তুলে ধরা হলো:
💰 জাতীয় বেতন স্কেল, ২০১৫ (মূল বেতনের কাঠামো)
সরকারি চাকরিতে মোট ২০টি গ্রেড রয়েছে।
| গ্রেড | পদমর্যাদা | মূল বেতনের স্কেল (টাকা) |
| ১ | সচিব/সিনিয়র সচিব (নির্ধারিত) | ৮০,০০০/- (নির্ধারিত) |
| ২ | (প্রশাসনিক পদ) | ৬৬,০০০ – ৭১,০৫০ – … – ৭৬,৪৯০/- |
| ৩ | (প্রশাসনিক পদ) | ৫৬,৫০০ – ৫৯,৭০০ – … – ৬৭,০১০/- |
| ৪ | (প্রশাসনিক পদ) | ৫০,০০০ – ৫৩,৯০০ – … – ৬১,০৪০/- |
| ৫ | প্রথম শ্রেণি (গেজেটেড) | ৪৩,০০০ – ৪৫,৫৪০ – … – ৬৯,৮৫০/- |
| ৬ | প্রথম শ্রেণি (গেজেটেড) | ৩৫,৫০০ – ৩৭,৩৫০ – … – ৬৭,০১০/- |
| ৭ | প্রথম শ্রেণি (গেজেটেড) | ২৯,০০০ – ৩০,৪৫০ – … – ৬৩,৪১০/- |
| ৮ | প্রথম শ্রেণি (গেজেটেড) | ২৩,১০০ – ২৪,২৭০ – … – ৫৬,৫৩০/- |
| ৯ | প্রথম শ্রেণি (গেজেটেড) – (যোগদান গ্রেড) | ২২,০০০ – ২৩,১০০ – … – ৫৩,০৬০/- |
| ১০ | দ্বিতীয় শ্রেণি (নন-গেজেটেড) | ১৬,০০০ – ১৬,৮০০ – … – ৩৮,৬৪০/- |
| ১১ | তৃতীয় শ্রেণি | ১২,৫০০ – ১৩,১৩০ – … – ৩০,২৪০/- |
| ১২ | তৃতীয় শ্রেণি | ১১,৩০০ – ১১,৮৭০ – … – ২৭,৩০০/- |
| ১৩ | তৃতীয় শ্রেণি | ১১,০০০ – ১১,৫৫০ – … – ২৬,৫৯০/- |
| ১৪ | তৃতীয় শ্রেণি | ১০,২০০ – ১০,৭১০ – … – ২৪,৬৮০/- |
| ১৫ | তৃতীয় শ্রেণি | ৯,৭০০ – ১০,১৯০ – … – ২৩,৪৯০/- |
| ১৬ | তৃতীয় শ্রেণি | ৯,৩০০ – ৯,৭৬৫ – … – ২২,৪৯০/- |
| ১৭ | চতুর্থ শ্রেণি | ৯,০০০ – ৯,৪৫০ – … – ২১,৮০০/- |
| ১৮ | চতুর্থ শ্রেণি | ৮,৮০০ – ৯,২৪০ – … – ২১,৩১০/- |
| ১৯ | চতুর্থ শ্রেণি | ৮,৫০০ – ৮,৯৩০ – … – ২০,৫৭০/- |
| ২০ | চতুর্থ শ্রেণি (সর্বনিম্ন) | ৮,২৫০ – ৮,৬৭০ – … – ২০,০১০/- |
গুরুত্বপূর্ণ নোট:
১. মূল বেতন: উপরে দেওয়া স্কেল হলো মূল বেতন (Basic Pay)।
২. মোট বেতন: একজন কর্মচারী মূল বেতনের সাথে বাড়ি ভাড়া ভাতা, চিকিৎসা ভাতা (চিকিৎসা ভাতা), টিফিন ভাতা, মহার্ঘ ভাতা (যদি থাকে) এবং অন্যান্য ভাতাদি যুক্ত করে যে অর্থ পান, সেটিই হলো মোট বেতন (Gross Salary)।
৩. নবম গ্রেড: প্রথম শ্রেণির গেজেটেড পদে (যেমন সহকারী সচিব, সহকারী প্রকৌশলী ইত্যাদি) যোগদানের শুরুতে মূল বেতন হলো ২২,০০০ টাকা। এর সাথে ভাতা যুক্ত হয়ে মোট বেতন (যেমন আপনি উল্লেখ করেছেন) প্রায় ৩৫,০০০+ টাকা হয়।
৪. বেতন বৃদ্ধি: ২০১৫ সালের পর নতুন কোনো পে-স্কেল ঘোষণা না হওয়ায় কেবল বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট (৫% হারে)-এর মাধ্যমেই কর্মচারীদের বেতন সামান্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।


