পে-স্কেল ২০২৫ । নীরব যোদ্ধাদের দাবি, ন্যূনতম মৌলিক বেতন ৩৫,০০০/- টাকা?
দেশের প্রতিটি অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দপ্তর আর ইউনিটের সবচেয়ে জরুরি ও নীরব যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ১১ থেকে ২০ গ্রেডের সাধারণ কর্মচারীরা আসন্ন পে-স্কেল ২০২৫ (নবম পে-স্কেল)-এ তাঁদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জোরালো দাবি জানিয়েছেন। জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে তাঁরা ন্যূনতম মৌলিক বেতন (Basic Pay) ৩৫,০০০/- (পঁয়ত্রিশ হাজার) টাকা নির্ধারণের দাবি তুলেছেন। এটি এখন আর শুধু অনুরোধ নয়, সময়ের দাবি।
🗣️ দাবির মূল কারণ: বাজার ও বেতনের বৈষম্য
১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীরা রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি হলেও গত এক দশক ধরে তাঁদের জীবনযাত্রার মান ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে। এই কর্মচারীরা তাঁদের সমস্যার চিত্র তুলে ধরেছেন:
- 📈 মূল্যস্ফীতি বনাম স্থির বেতন: বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, তখন তাঁদের বেতন কাঠামো রয়েছে প্রায় একই রকম। এতে প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় পরিবার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
- 📚 শিক্ষা ও খাদ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা: বাচ্চার স্কুল ফি দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, পরিবারের জন্য মানসম্মত খাবার নিশ্চিত করাও এখন চিন্তার বিষয়। তাঁরা বিলাসবহুল জীবন চান না, শুধু চান একটু মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে।
- 😟 ছুটি নয়, দুশ্চিন্তা: কর্মচারীরা জানিয়েছেন, ছুটি মানে তাঁদের কাছে মানসিক বিশ্রাম নয়, বরং পরের মাসের সংসার খরচ কী করে চলবে সেই চিন্তা।
📢 একটাই দাবি: ৩৫,০০০/- টাকা মৌলিক বেতন
বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠন এবং সাধারণ কর্মচারীদের পক্ষ থেকে জোরালোভাবে দাবি উঠেছে যে, বর্তমান বাজারদর, মূল্যস্ফীতির হার এবং একটি ৬ সদস্যের পরিবারের জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনা করে পে-স্কেল ২০২৫-এ সর্বনিম্ন মৌলিক বেতন (Base Salary) অবশ্যই ৩৫,০০০/- টাকা নির্ধারণ করতে হবে। এই বেতনের মাধ্যমে কর্মচারীরা তাঁদের পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে এবং অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন।
🤝 সরকারের প্রতি প্রত্যাশা
এই কর্মচারীরা দেশের সিস্টেমকে সচল রাখতে দিনরাত কাজ করে চলেন। কিন্তু তাঁদের হাতের কাজে সিস্টেম চললেও, তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেই। তাই নবম পে-কমিশন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি তাঁদের বিনীত অনুরোধ—১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীদের এই ন্যায়সঙ্গত দাবিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হোক। দ্রুততম সময়ে একটি বৈষম্যমুক্ত, বাস্তবসম্মত ও ন্যায্য বেতন কাঠামো কার্যকর করা হলে রাষ্ট্রের এই নীরব যোদ্ধারা নতুন উদ্যমে দেশসেবায় নিজেদের নিয়োজিত করতে পারবেন।
প্রাসঙ্গিক তথ্য:
- বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠন ইতিমধ্যে পে-কমিশনের কাছে সর্বনিম্ন বেতন ৩২ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত করার প্রস্তাব পেশ করেছে।
- জাতীয় বেতন কমিশন আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারে বলে জানা গেছে।
- অর্থ বিভাগ জানিয়েছে, নতুন পে-স্কেল বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদের মধ্যেই বাস্তবায়ন হতে পারে।
এই খবরটি ১১-২০ গ্রেডের লক্ষ লক্ষ কর্মচারীর আশা ও অধিকারের প্রতিচ্ছবি। এখন দেখার বিষয়, সরকার এই নীরব যোদ্ধাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কতটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। পে-স্কেল ২০২৫-এ ১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীদের মূল বেতনের (Basic Pay) দাবি ছাড়াও অন্যান্য ভাতা ও গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বেশ কিছু জোরালো দাবি রয়েছে। জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে এই দাবিগুলো অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে। এখানে সেই দাবিগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো:
ভাতা সংক্রান্ত প্রধান দাবিগুলো
| দাবিকৃত ভাতার ক্ষেত্র | বর্তমান সুবিধা (প্রায়) | দাবিকৃত সুবিধা (বিভিন্ন সংগঠনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী) | দাবির মূল যুক্তি |
| 🏠 বাড়ি ভাড়া ভাতা | মূল বেতনের একটি নির্দিষ্ট শতাংশ (শহরভেদে পার্থক্য) | মূল বেতনের ৬০% থেকে ৮০% পর্যন্ত (ঢাকা, অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন, জেলা শহর ভেদে) | বাজারের অস্বাভাবিক বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির সাথে সংগতি রেখে ভাতার পরিমাণ বাড়ানো। |
| 🩺 চিকিৎসা ভাতা | মাসিক ১,৫০০/- টাকা (প্রায়) | মাসিক ৩,০০০/- থেকে ৬,০০০/- টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি | অসুস্থতা ও চিকিৎসার ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যাওয়ায় একটি কার্যকর চিকিৎসা ভাতা নিশ্চিত করা। |
| 📚 শিক্ষা সহায়ক ভাতা | মাসিক ৫০০/- টাকা/সন্তান (সর্বোচ্চ দুই সন্তানের জন্য) | মাসিক ২,০০০/- থেকে ৩,০০০/- টাকা/সন্তান পর্যন্ত বৃদ্ধি | মানসম্মত শিক্ষার ক্রমবর্ধমান খরচ মেটানো এবং সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা। |
| 🍽️ টিফিন/নাস্তা ভাতা | নেই/খুবই নগণ্য | দৈনিক ১০০/- টাকা (মাসে প্রায় ২,২০০/- টাকা) | কর্মক্ষেত্রে থাকা অবস্থায় মানসম্মত খাবার বা নাস্তা গ্রহণের খরচ মেটানো। |
| 🚗 যাতায়াত ভাতা | স্থানভেদে ভিন্ন (তুলনামূলক কম) | মাসিক ২,০০০/- থেকে ৩,০০০/- টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি | পরিবহণ ব্যয় বৃদ্ধি এবং যাতায়াতের চাপ সামলানোর জন্য। |
| 📈 বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট | ৫% (হারে) | ১০% (হারে) নির্ধারণ | মূল্যস্ফীতির সাথে বেতনের সামঞ্জস্য রাখা এবং জীবনযাত্রার মান স্থিতিশীল রাখা। |
গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগত ও সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত দাবি
- ১. টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল: ২০১৫ সালের পে-স্কেলে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল করে ‘উচ্চতর গ্রেড’ (১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে) প্রবর্তন করা হয়েছিল। কর্মচারীদের দাবি, পুরোনো নিয়মে তিনটি টাইম স্কেল ও দুটি সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল করা হোক। এতে পদোন্নতি-বঞ্চিত কর্মচারীরা দীর্ঘ চাকরিকালীন সময়ে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন।
- ২. পেনশন সুবিধা বৃদ্ধি: শতভাগ পেনশন উত্তোলনের সুযোগ পুনর্বহাল করা (বর্তমানে যা অর্ধেক) এবং গ্র্যাচুইটির হার ১ টাকায় ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা।
- ৩. গ্রেড সংখ্যা হ্রাস: বিদ্যমান ২০টি গ্রেড কমিয়ে ১০ থেকে ১৩টি গ্রেড-এর মধ্যে সীমিত করে বেতন কাঠামোতে বিদ্যমান বৈষম্য কমানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
- ৪. রেশনিং ব্যবস্থা চালু: ১১ থেকে ২০ গ্রেডের কর্মচারীদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা (ন্যায্যমূল্যে খাদ্যপণ্য সরবরাহ) চালু করার দাবি জানানো হয়েছে, যাতে বাজারমূল্য বৃদ্ধির চাপ থেকে তাঁরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পান।
- ৫. ব্লক পদ বাতিল: বিভিন্ন দপ্তরে ব্লক পদ বাতিল করে পদোন্নতির মাধ্যমে উচ্চতর পদে যাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করা।
এই সমস্ত দাবিগুলো মূলত ১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, চলমান অর্থনৈতিক চাপ এবং একটি মর্যাদাশীল জীবনযাপনের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উত্থাপিত হয়েছে।
জি, পে-স্কেল ২০২৫ (নবম পে-স্কেল) নিয়ে কর্মচারীদের পাশাপাশি সরকার এবং কমিশনও অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে কাজ করছে। বিভিন্ন সূত্র এবং কমিশনের কার্যক্রমের তথ্য অনুযায়ী, চূড়ান্ত সুপারিশ দ্রুতই আসার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে।
এখানে চূড়ান্ত সুপারিশ সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্য ও সম্ভাব্য সময়সীমা তুলে ধরা হলো:
🗓️ চূড়ান্ত সুপারিশের সম্ভাব্য সময়সীম: জাতীয় বেতন কমিশন, ২০২৫ (National Pay Commission, 2025) এর কাজ বর্তমানে চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
- প্রতিবেদন জমা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা: কমিশন সূত্রগুলো অনুযায়ী, তাঁরা ২০২৫ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই সরকারের কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন।
- জুলাই মাসে গঠিত কমিশনকে তাদের প্রথম সভা থেকে ৬ মাসের মধ্যে সুপারিশ জমা দেওয়ার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। সেই হিসাবে ডিসেম্বর বা ২০২৬ সালের জানুয়ারির মধ্যেই প্রতিবেদন জমা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
- কার্যকর হওয়ার সম্ভাব্য তারিখ: অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, নতুন পে-স্কেল পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের জন্য ফেলে রাখা হবে না, বরং চলতি সরকারের মেয়াদেই গেজেটের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে।
- সবকিছু ঠিক থাকলে, ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে নতুন বেতন কাঠামো কার্যকর হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
📜 চূড়ান্ত সুপারিশে কী থাকতে পারে? কমিশন বিভিন্ন সংগঠন ও কর্মচারীর কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রায় ৩০০টিরও বেশি প্রস্তাবনা এবং মতামত পর্যালোচনা করছে। চূড়ান্ত সুপারিশে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোতে বড় পরিবর্তন আসতে পারে:
| ক্ষেত্র | কর্মচারীদের মূল দাবি | খসড়া/সম্ভাব্য সুপারিশের ইঙ্গিত |
| সর্বনিম্ন মৌলিক বেতন | ৩৫,০০০/- টাকা | একাধিক প্রস্তাবনা রয়েছে (যেমন ২৫,০০০/- বা ৩২,০০০/- টাকা), তবে জীবনযাত্রার ব্যয়ের কারণে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি আশা করা যায়। |
| বেতন গ্রেড সংখ্যা | ২০টি থেকে কমিয়ে ১০-১২টি করা | গ্রেডের সংখ্যা কমানো প্রায় নিশ্চিত, যাতে গ্রেডভিত্তিক বৈষম্য হ্রাস পায়। |
| বেতন বৃদ্ধির অনুপাত | ১:৪ (সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত) | বর্তমান অনুপাত (প্রায় ১:১০) কমানোর চেষ্টা থাকবে। |
| টাইম স্কেল/সিলেকশন গ্রেড | পুনর্বহাল করা | কর্মচারীদের দাবির যৌক্তিকতা বিবেচনা করে উচ্চতর গ্রেড পাওয়ার প্রক্রিয়া বা সংখ্যায় পরিবর্তন আসতে পারে। |
| অন্যান্য ভাতা | বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ও শিক্ষা ভাতার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি | চিকিৎসা ও শিক্ষা ভাতা বাড়ানোর বিষয়ে কমিশন ইতিবাচক, যা চূড়ান্ত সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত হবে। |
| বিশেষ ব্যবস্থা | রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা | এই দাবির বিষয়েও পর্যালোচনা চলছে। |
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: কমিশন চূড়ান্ত সুপারিশ জমা দেওয়ার পর অর্থ বিভাগ এবং মন্ত্রিসভা তা যাচাই-বাছাই ও অনুমোদন করবে। এরপর এটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হলে তা কার্যকর হবে।



