সরকারি কর্মচারীদের জন্য ‘পেনশন ম্যানুয়াল (বেসামরিক)’ ২০২৫ । পেনশন প্রক্রিয়া সহজ করতে নতুন উদ্যোগ কতটা কার্যকর হয়েছে?
সরকারি কর্মচারীদের অবসর গ্রহণ ও পেনশন সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে এবং প্রক্রিয়াকে আরও সহজ ও স্বচ্ছ করতে ‘পেনশন ম্যানুয়াল (বেসামরিক)’ প্রকাশ করেছে হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (সিজিএ)। অক্টোবর ২০২২-এ প্রকাশিত এই ম্যানুয়ালটি সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন সংক্রান্ত আইন, বিধি-বিধান এবং ব্যবহারিক দিকগুলো তুলে ধরেছে, যা পেনশনার, পেনশন অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ এবং হিসাব রক্ষণ অফিসের জন্য একটি সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে কাজ করবে ।
ম্যানুয়ালের মূল লক্ষ্য ও বিষয়বস্তু:
ম্যানুয়ালটির প্রধান উদ্দেশ্য হলো পেনশন প্রক্রিয়াকরণ ও প্রদানের সাথে জড়িত সকল পক্ষের করণীয় বিষয়গুলো লিপিবদ্ধ করা । এতে তাত্ত্বিক বিষয়ের চেয়ে ব্যবহারিক দিক, যেমন কাজটি কীভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হবে, তার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আইবাস++ (iBAS++) সিস্টেমের মাধ্যমে পেনশন প্রক্রিয়াকরণ ও প্রদান করা হচ্ছে এবং এই ম্যানুয়ালে সেই সিস্টেমের ব্যবহার পদ্ধতি স্ক্রিন শট এবং ফ্লোচার্টের মাধ্যমে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে ।
গুরুত্বপূর্ণ বিধান ও বিষয়সমূহ:
অবসরগ্রহণের প্রকারভেদ: ম্যানুয়ালে বার্ধক্যজনিত অবসরগ্রহণ, স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণ, জনস্বার্থে অবসর প্রদান, অক্ষমতাজনিত অবসরগ্রহণ এবং শাস্তিমূলক অবসর প্রদানসহ সকল প্রকার অবসরগ্রহণের পদ্ধতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে ।
অবসর গ্রহণের বয়স: সরকারি কর্মচারী আইন, ২০১৮ অনুযায়ী, সাধারণ সরকারি কর্মচারীদের জন্য অবসরের বয়স ৫৯ বছর এবং মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মচারীদের জন্য ৬০ বছর পূর্তিতে বাধ্যতামূলক অবসর গ্রহণের বিধান রয়েছে ।
ঐচ্ছিক অবসর: একজন সরকারি কর্মচারী চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যেকোনো সময় নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে লিখিত নোটিশ প্রদানপূর্বক স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করতে পারবেন ।
পেনশন পুনঃস্থাপন: শতভাগ পেনশন সমর্পণকারী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের জন্য ১৫ বছর সময় অতিক্রান্ত হলে তাদের মাসিক পেনশন পুনঃস্থাপনের বিধান রয়েছে ।
পেনশন মঞ্জুরির সময়সীমা: ‘সরকারি কর্মচারীগণের পেনশন সহজীকরণ আদেশ, ২০২০’-এর নির্দেশনা অনুযায়ী, পেনশন আবেদন প্রাপ্তির ৫ মাসের মধ্যে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়/কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পেনশনের অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে ।
কল্যাণ কর্মকর্তা (Welfare Officer): পেনশন প্রক্রিয়াকরণে সহায়তা করার জন্য প্রত্যেক কার্যালয়ে একজন কল্যাণ কর্মকর্তা মনোনয়ন দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে ।
সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন পেনশন: ২০১৬ সালের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, গ্রস পেনশনের সর্বোচ্চ পরিমাণ ৭৭,০০০/- টাকা এবং সর্বনিম্ন পেনশন নির্ধারণের বিধানও ম্যানুয়ালে উল্লেখ করা হয়েছে ।
ম্যানুয়ালটি প্রস্তুত করা হয়েছে অর্থ বিভাগের প্রজ্ঞাপন নম্বর ০৭.০০.০০০০.১৭১.১৩.০০২.১৮-০৮ তারিখ ০৬/০২/২০২০ এর মাধ্যমে জারিকৃত “সরকারি কর্মচারীগণের পেনশন সহজীকরণ আদেশ, ২০২০” এর নির্দেশনা অনুসরণ করে । এটি সরকারি কর্মচারীদের অবসরজনিত সুবিধাদি সঠিক সময়ে প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে।

সরকারি কর্মচারীদের জন্য ‘পেনশন ম্যানুয়াল (বেসামরিক)’ ২০২৫
পেনশন পেতে এখনও পায়ের জুতো ক্ষয় করতে হয়?
না, এখন আর আগের মতো দিনের পর দিন অফিসে ঘোরাঘুরি বা ‘জুতো ক্ষয়’ করার প্রয়োজন নেই। এর প্রধান কারণ হলো:
ডিজিটাল প্রক্রিয়াকরণ (iBAS++): বর্তমানে পেনশনের সমস্ত প্রক্রিয়াকরণ ও প্রদান করা হচ্ছে আইবাস++ (iBAS++) সিস্টেমের মাধ্যমে। এটি একটি কেন্দ্রীয় এবং সম্পূর্ণ ডিজিটাল ব্যবস্থা। এর ফলে আবেদনকারীর ফাইল এক ডেস্ক থেকে অন্য ডেস্কে সশরীরে বহন করার বা ফলোআপ করার প্রয়োজনীয়তা প্রায় নেই বললেই চলে।
পেনশন সহজীকরণ আদেশ, ২০২০: অর্থ বিভাগের জারি করা ‘সরকারি কর্মচারীগণের পেনশন সহজীকরণ আদেশ, ২০২০’ অনুসারে, পেনশন মঞ্জুরির জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এই আদেশ অনুযায়ী, আবেদনকারী কর্তৃক আবেদন জমা দেওয়ার পর প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়/কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ ৫ মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ অনুমোদন প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।
পেনশন ম্যানুয়াল: আপনার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রকাশিত ‘পেনশন ম্যানুয়াল (বেসামরিক)’-এর মূল লক্ষ্যই হলো প্রক্রিয়াটিকে সহজ ও স্বচ্ছ করা, যাতে তাত্ত্বিক নয়, বরং ব্যবহারিক দিক এবং ডিজিটাল পদ্ধতির প্রয়োগ সহজবোধ্য হয়।
কল্যাণ কর্মকর্তা: প্রতিটি অফিসে একজন কল্যাণ কর্মকর্তা (Welfare Officer) নিয়োগের বিধান রয়েছে, যিনি পেনশনারকে তার আবেদন প্রক্রিয়াকরণে সহায়তা করবেন।
সুতরাং, নতুন নিয়মে এবং ডিজিটাল পদ্ধতির কারণে, পেনশন এখন একটি সময়বদ্ধ ও পদ্ধতিগত প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়, যা পেনশনারের হয়রানি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছে।
পেনশন ডিজিটালাইজেশন কি আর্শীবাদ হয়ে আসছে?
পেনশন ডিজিটালাইজেশনকে নিঃসন্দেহে একটি বড় আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। সরকারি কর্মচারীদের জন্য পেনশন প্রক্রিয়াটিকে দ্রুত, হয়রানিমুক্ত এবং স্বচ্ছ করার ক্ষেত্রে এটি একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। আপনার প্রদত্ত তথ্যে উল্লিখিত ‘পেনশন ম্যানুয়াল (বেসামরিক)’ এবং বাস্তবায়িত আইবাস++ (iBAS++) সিস্টেম এই ডিজিটাল রূপান্তরের মূল ভিত্তি। ডিজিটালাইজেশনের ফলে আসা মূল সুবিধাগুলো (আশীর্বাদস্বরূপ) নিচে তুলে ধরা হলো:
১. হয়রানি ও দীর্ঘসূত্রিতা মুক্তি (End of Harassment)
‘জুতো ক্ষয়’ এর সমাপ্তি: পূর্বে পেনশন ফাইল ম্যানুয়ালি এক ডেস্ক থেকে অন্য ডেস্কে ঘোরা এবং দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষার কারণে যে সীমাহীন হয়রানি হতো, ডিজিটাল প্রক্রিয়াকরণের ফলে তা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।
স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়াকরণ: iBAS++ সিস্টেমের মাধ্যমে পেনশন বিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয় এবং অনলাইনে দাখিল ও নিরীক্ষণ করা হয়, যার ফলে সময় নষ্ট হওয়া এবং দুর্নীতির সুযোগ কমেছে।
২. দ্রুততা ও সময়াবদ্ধতা (Speed and Timeliness)
নির্দিষ্ট সময়সীমা: ‘সরকারি কর্মচারীগণের পেনশন সহজীকরণ আদেশ, ২০২০’ অনুসারে, পেনশন আবেদনের ৫ মাসের মধ্যে তা অনুমোদন করার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়েছে। ডিজিটাল পদ্ধতির কারণে এই সময়সীমা অনুসরণ করা সহজ হয়েছে।
ইএফটি (EFT) এর মাধ্যমে সরাসরি টাকা: এখন পেনশন মঞ্জুর হওয়ার পর প্রতি মাসের মাসিক পেনশনভোগীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের (EFT) মাধ্যমে সরাসরি ও সময়মতো জমা হয়ে যায়। পেনশন তোলার জন্য ব্যাংকে বা হিসাবরক্ষণ অফিসে যেতে হয় না।
৩. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা (Transparency and Accountability)
অনলাইন ট্র্যাকিং: পেনশনভোগীরা এখন ঘরে বসেই তাদের NID এবং নিবন্ধিত ফোন নম্বর ব্যবহার করে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তাদের মাসিক পেনশন প্রাপ্তির তথ্য (ব্যাংক স্টেটমেন্টের মতো) এবং পূর্ববর্তী সকল মাসের EFT বিবরণী দেখতে পারেন।
ক্যালকুলেশনে ভুল হ্রাস: মানবসৃষ্ট ভুল (Human Error) কমানোর জন্য স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম ব্যবহার করা হয়, যা নির্ভুলভাবে পেনশন ও আনুতোষিক গণনা নিশ্চিত করে।
৪. আধুনিকায়ন ও বৃহত্তর সুবিধা (Modernization and Greater Benefits)
কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা: কেন্দ্রীয়ভাবে হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে পেনশন প্রদান কার্যক্রম নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয়, যা ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও শক্তিশালী করেছে।
কল্যাণ কর্মকর্তা: প্রতিটি অফিসে কল্যাণ কর্মকর্তা মনোনয়নের বিধান থাকায় পেনশনাররা তাদের প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সহায়তা পাচ্ছেন।
সংক্ষেপে বলা যায়, পেনশন ডিজিটালাইজেশন সরকারি চাকরিজীবীদের অবসর জীবনকে আর্থিকভাবে সুরক্ষিত, মানসিকভাবে স্বস্তিদায়ক এবং প্রশাসনিকভাবে স্বচ্ছ করেছে। এটি কেবল একটি প্রক্রিয়াগত পরিবর্তন নয়, বরং অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের প্রতি সরকারের দায়িত্বশীলতার আধুনিক বহিঃপ্রকাশ।



