গুমের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ২০২৫ । ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ, ২০২৫’ গেজেটভুক্ত হয়েছে?
সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে গেজেট আকারে প্রকাশিত হলো বহুল প্রতীক্ষিত ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ, ২০২৫’। গত ১ ডিসেম্বর, ২০২৫ তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত এই অতিরিক্ত গেজেটে গুমের অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে গুমকে একটি শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হলো, যা জাতিসংঘের ‘গুম হইতে সকল ব্যক্তিকে সুরক্ষার নিমিত্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশন’ কার্যকর করার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডের বিধান:
অধ্যাদেশের ৪ নং ধারায় গুমের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী বা শৃঙ্খলা-বাহিনীর কোনো সদস্য বা তাদের অনুমোদন, সমর্থন বা সম্মতিতে যেকোনো ব্যক্তি যদি কাউকে গ্রেফতার, আটক, অপহরণ বা স্বাধীনতা হরণ করে এবং সেই ব্যক্তির অবস্থান বা পরিণতি গোপন রাখে, যার ফলে ব্যক্তিটি আইনি সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, তবে তা ‘গুম’ হিসেবে গণ্য হবে।
সাধারণ গুমের শাস্তি: যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ড এবং ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড।
মৃত্যু ঘটলে বা ৫ বছরেও সন্ধান না মিললে: যদি গুমের ফলে ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে বা গুমের ঘটনার ৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও তাকে জীবিত বা মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব না হয়, তবে দায়ী ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড।
এছাড়া, গুমের সাক্ষ্যপ্রমাণ বিনষ্ট বা গোপন করলে সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড এবং ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আইন দ্বারা অনুমোদিত নয় এমন ‘গোপন আটক কেন্দ্র’ নির্মাণ, স্থাপন বা ব্যবহার করাকেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, যার শাস্তি সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড।
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জবাবদিহি নিশ্চিত:
এই আইনে শৃঙ্খলা-বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, কমান্ডার বা দলনেতাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনা হয়েছে। অধস্তনদেরকে অপরাধ সংঘটনে আদেশ, অনুমতি বা প্ররোচনা দিলে, বা অপরাধ সংঘটনের তথ্য জানা সত্ত্বেও প্রতিরোধে ব্যর্থ হলে ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিও মূল অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই অধ্যাদেশের অধীন শাস্তিযোগ্য কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে ‘অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা’, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা’ অথবা ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ’ – এমন কোনো অজুহাত অগ্রহণযোগ্য হবে বলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা ও ট্রাইব্যুনাল:
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (কমিশন) গুম সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণ করবে, অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনা বা তত্ত্বাবধান করবে। কমিশন বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণাধীন যেকোনো কারাগার, হাজতখানা ও আটক-কেন্দ্র সরেজমিন পরিদর্শন করতে পারবে এবং গোপন আটক কেন্দ্র শনাক্ত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারবে।
ভুক্তভোগী বা সাক্ষী কমিশনের মনোনীত কর্মকর্তার নিকট বা থানার অফিসার ইনচার্জের নিকট অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন, যা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কমিশনের নিকট পাঠাতে হবে।
দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে সরকার প্রত্যেক বিভাগ বা জেলায় এক বা একাধিক ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করবে। অভিযোগ গঠনের পর ১২০ দিনের মধ্যে মামলার বিচার সম্পন্ন করার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই অধ্যাদেশের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, গুম একটি ‘চলমান অপরাধ’ হিসাবে বিবেচিত হবে, যতক্ষণ না গুম হওয়া ব্যক্তির অবস্থান বা পরিণতি নিশ্চিত হওয়া যায়।
এছাড়া, অভিযুক্ত ব্যক্তি গুম হওয়া ব্যক্তিকে জীবিত ফেরত পেতে বা প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনে কার্যকর অবদান রাখলে ট্রাইব্যুনালের বিবেচনায় পূর্ণাঙ্গ বা আংশিক মার্জনা পেতে পারেন।

গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ, ২০২৫
কেউ গুম হলে প্রথমে করণীয় কি?
‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর ধারা ৮ (অভিযোগ দায়ের ও তদন্ত প্রক্রিয়া) অনুযায়ী, কেউ গুম হলে বা গুম হওয়ার সুনির্দিষ্ট তথ্য জানলে প্রাথমিকভাবে নিম্নলিখিত উপায়ে অভিযোগ দায়ের করা যেতে পারে:
অভিযোগ দায়েরের এখতিয়ার: এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী, গুম সংক্রান্ত কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে:
১. কারা অভিযোগ করতে পারবেন? * ভুক্তভোগী নিজে (যদিও গুমের ক্ষেত্রে এটি সাধারণত অসম্ভব) । * ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী । * ঘটনার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানেন এমন কোনো ব্যক্তি ।
২. যেখানে অভিযোগ দায়ের করা যাবে (প্রাথমিক করণীয়): * জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মনোনীত কর্মকর্তা: সরাসরি, অনলাইনে বা ডাকযোগে অভিযোগ দাখিল করা যাবে । * থানার অফিসার ইনচার্জ (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা): সরাসরি হাজির হয়ে অভিযোগ দায়ের করা যাবে । * দায়িত্বরত প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট: সরাসরি হাজির হয়ে অভিযোগ দায়ের করা যাবে ।
গুরুত্বপূর্ণ পরবর্তী ধাপ: যদি অভিযোগটি থানার অফিসার ইনচার্জ বা দায়িত্বরত প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দাখিল করা হয়, তবে তাদের করণীয় হলো:
তাৎক্ষণিক অভিযোগটিকে সাধারণ ডায়ারিভুক্ত (GD) করা বা ক্ষেত্রবিশেষে একটি বিবিধ মামলার অধীন রেজিস্ট্রিভুক্ত করা ।
উক্ত অভিযোগটি ২৪ (চব্বিশ) ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (কমিশন) বরাবর প্রেরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা ।
কমিশন এই অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত করবে এবং ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া শুরু করবে ।


