বেতন ফিক্সেশন পদ্ধতি ২০২৫ । নতুন পে স্কেলে ‘পার্থক্য যোগ’ ও ‘ইনক্রিমেন্ট ফ্যাক্টর’ পদ্ধতি প্রয়োগ হবে?
সরকারি কর্মচারী ও সংশ্লিষ্টদের জন্য বেতন ফিক্সেশন বা নতুন বেতন কাঠামোতে বেতন নির্ধারণের দুটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতির তুলনামূলক বিশ্লেষণ উঠে এসেছে, যা বেতন নির্ধারণ প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ করতে সহায়ক হতে পারে। পদ্ধতি দুটি হলো— ‘পার্থক্য যোগ পদ্ধতি’ এবং ‘ইনক্রিমেন্ট ফ্যাক্টর পদ্ধতি’। বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুটি পদ্ধতিতেই কর্মচারীর মূল বেতন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সামান্য পার্থক্য তৈরি হতে পারে, যা চূড়ান্ত বেসিকে প্রভাব ফেলে। নিচে পদ্ধতি দুটির গাণিতিক বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো:
১. পার্থক্য যোগ পদ্ধতি (Difference Addition Method) এই পদ্ধতিতে মূল বেতনের সাথে ইনক্রিমেন্ট-জনিত পার্থক্য যোগ করে নতুন স্কেলের প্রাথমিক ধাপে সমন্বয় করা হয়।
- পুরোনো স্কেলের বেসিক: ১০২০০ টাকা
- ৬ বছর পর ইনক্রিমেন্টসহ বেসিক: ১৩০৫০ টাকা
- পার্থক্য নির্ণয়: ১৩০৫০ – ১০২০০ = ২৮৫০ টাকা
- নতুন স্কেলের বিবেচ্য ধাপ (ধরা হয়েছে): ২১০০০ টাকা
- নতুন বেসিক (গণনাকৃত): ২১০০০ + ২৮৫০ = ২৩৮৫০ টাকা
চূড়ান্ত নির্ধারণ: গণনাকৃত ২৩৮৫০ টাকা যদি স্কেল টেবিলের কোনো ধাপে না থাকে, তবে নিকটতম উচ্চতর ধাপ, যেমন ২৫২০০ টাকা-তে বেসিক নির্ধারণ করা হবে।
২. ইনক্রিমেন্ট ফ্যাক্টর পদ্ধতি (Increment Factor Method) এই পদ্ধতি অনুসারে প্রথমে ইনক্রিমেন্ট ফ্যাক্টর বের করা হয় এবং সেই ফ্যাক্টর দিয়ে নতুন স্কেলের সংশ্লিষ্ট বেসিককে গুণ করে নতুন বেসিক নির্ধারণ করা হয়।
- ইনক্রিমেন্ট ফ্যাক্টর বের করার সূত্র: ইনক্রিমেন্টসহ বেতন/পুরোনো স্কেলের প্রারম্ভিক বেতন}
- ফ্যাক্টর নির্ণয়: ১৩০৫০/১০২০০ = ১.২৮০৪৯
- নতুন বেসিক (গণনাকৃত): নতুন স্কেলের বেসিক (ধরা হয়েছে) x ইনক্রিমেন্ট ফ্যাক্টর}২১০০০ x ১.২৮০৪৯ = ২৬৮৮০ টাকা
চূড়ান্ত নির্ধারণ: গণনাকৃত ২৬৮৮০ টাকা যদি স্কেল টেবিলের কোনো ধাপে না থাকে, তবে নিকটতম উচ্চতর ধাপ, যেমন ২৭০০০ টাকা-তে বেসিক নির্ধারণ করা হবে।
তুলনামূলক পর্যালোচনা
বিশ্লেষণ অনুযায়ী, একই প্রারম্ভিক তথ্য ব্যবহার করে দুটি পদ্ধতিতে গণনাকৃত বেসিকের মধ্যে সামান্য পার্থক্য দেখা যাচ্ছে:
| পদ্ধতি | গণনাকৃত বেসিক | চূড়ান্ত বেসিকের ধাপ (উদাহরণ অনুযায়ী) |
| পার্থক্য যোগ পদ্ধতি | ২৩৮৫০ টাকা | ২৫২০০ টাকা |
| ইনক্রিমেন্ট ফ্যাক্টর পদ্ধতি | ২৬৮৮০ টাকা | ২৭০০০ টাকা |
উভয় ক্ষেত্রেই, গণনাকৃত অঙ্ক স্কেল টেবিলের কোনো ধাপে না থাকলে, নিকটতম উচ্চতর ধাপে বেসিক নির্ধারণের নিয়ম অনুসরণ করা হয়। তবে এই উদাহরণে ‘ইনক্রিমেন্ট ফ্যাক্টর’ পদ্ধতি অনুসরণ করে নির্ধারিত বেসিক (২৭,০০০ টাকা) ‘পার্থক্য যোগ’ পদ্ধতির (২৫,২০০ টাকা) চেয়ে উচ্চতর হয়েছে। এই বিশ্লেষণ সরকারি কর্মচারীদের নতুন বেতন স্কেল বা টাইম-স্কেল/উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির পর তাদের বেতন নির্ধারণ প্রক্রিয়া বুঝতে সহায়ক হবে। বেতন নির্ধারণের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ তাদের সুনির্দিষ্ট বিধিমালা অনুসরণ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন।

বেতন ফিক্সেশন (Pay Fixation) হলো বেতন নির্ধারণ বা বেতন পুনঃনির্ধারণের একটি প্রক্রিয়া কি?
সহজ ভাষায়, যখন একজন সরকারি বা বেসরকারি কর্মচারীর বেতনে কোনো পরিবর্তন আসে, তখন নতুন নিয়ম বা স্কেল অনুসারে তার বর্তমান বেসিক (মূল বেতন) এবং নতুন স্কেলে প্রাপ্য বেসিক নির্ধারণ করার পদ্ধতিকেই বেতন ফিক্সেশন বলা হয়। এটি সাধারণত নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে করা হয়- নতুন জাতীয় বেতন স্কেল কার্যকর হলে: যখন সরকার একটি নতুন বেতন স্কেল (যেমন: ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেল) ঘোষণা করে, তখন কর্মচারীর পুরোনো স্কেলের বেতনের ভিত্তিতে নতুন স্কেলে তার বেতন নির্ধারণ করা হয়। নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে: একজন কর্মচারী যখন নতুন চাকরিতে যোগদান করেন, তখন তার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও গ্রেড অনুযায়ী তার প্রাথমিক বেতন নির্ধারণ করা হয়। পদোন্নতি হলে: পদোন্নতি বা উচ্চতর পদে যোগদানের পর তার নতুন গ্রেড ও স্কেল অনুসারে বেতন পুনর্নির্ধারণ করা হয়। বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট (বেতন বৃদ্ধি) হলে: প্রতি বছর ইনক্রিমেন্ট পাওয়ার পরও আনুষ্ঠানিকভাবে বেতন ফিক্সেশন করা হয়, যাতে নতুন বেসিকটি সিস্টেমে সঠিকভাবে আপডেট হয়। টাইম স্কেল/সিলেকশন গ্রেড বা উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তি হলে: চাকরির নির্দিষ্ট সময় পূর্ণ হওয়ার কারণে উচ্চতর গ্রেড বা স্কেল প্রাপ্তি হলেও এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বেতন নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের জন্য এই প্রক্রিয়াটি সাধারণত অর্থ বিভাগের অধীনস্থ iBAS++ সিস্টেমের মাধ্যমে অনলাইনে সম্পন্ন করা হয়। এটি কর্মচারীর বেতন ও অন্যান্য আর্থিক তথ্য একটি নির্ভুল ডাটাবেজে সংরক্ষণ করতে সাহায্য করে।
অনলাইনে ফিক্সেশনের নিয়ম কি?
অনলাইনে ফিক্সেশনের (বেতন নির্ধারণী) নিয়ম মূলত সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য এবং এটি বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের ইন্টিগ্রেটেড বাজেট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিং সিস্টেম (iBAS) এর ওয়েবসাইটের (বর্তমানে এটি iBAS++ নামে পরিচিত) মাধ্যমে করা হয়।
সাধারণভাবে, অনলাইনে ফিক্সেশনের প্রধান নিয়মাবলী ও ধাপগুলো নিম্নরূপ:
১. ওয়েবসাইট ব্যবহার: সরকারি কর্মচারীদেরকে iBAS ওয়েবসাইটে (পূর্বে www.payfixation.gov.bd ছিল, বর্তমানে এটি iBAS++ এর অংশ) গিয়ে বেতন নির্ধারণী ফরম পূরণ করতে হয়।
২. লগ ইন: লগইন করার জন্য সাধারণত কর্মচারীর জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নম্বর এবং জন্মতারিখ ব্যবহার করতে হয়। যদি জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকে বা তথ্যে অসঙ্গতি থাকে তবে তা সংশোধন করে নিতে হয়।
৩. ফরম পূরণ: কর্মচারী তার প্রযোজ্য ক্যাটাগরি (যেমন: বেসামরিক, রেলওয়ে, ইত্যাদি) নির্বাচন করে নির্দিষ্ট ছক বা ফরম পূরণ করবেন। ফরম পূরণের ক্ষেত্রগুলো হতে পারে: * নতুন নিয়োগ * বদলী * বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট * উচ্চতর গ্রেড/টাইমস্কেল/সিলেকশন গ্রেড (যেগুলো এখনো প্রযোজ্য) * বেতন পুনঃনির্ধারণ
৪. প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আপলোড: বেতন নির্ধারণ সংক্রান্ত অফিস আদেশের সফট কপি (পিডিএফ/জেপিইজি ফরমেটে) এবং আনুসঙ্গিক সকল কাগজপত্র আপলোড করতে হয়। যেমন: * নিয়োগপত্র * বদলী সংক্রান্ত আদেশ * উচ্চতর গ্রেড বা পদোন্নতির আদেশ * নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত সনদ, যোগদানপত্র, স্বাস্থ্যগত সনদ ইত্যাদি। * পুরোনো ফিক্সেশনের ক্ষেত্রে ০১/০৭/২০১৫ তারিখের বেতন নির্ধারণ ‘ভেরিফিকেশন নম্বর’ প্রয়োজন হতে পারে।
৫. স্বয়ংক্রিয় নির্ধারণ ও প্রিন্ট: তথ্যাদি দাখিল করার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন বেতন স্কেলে মূল বেতনের পরিমাণ নির্ধারিত হয়। এরপর কর্মচারীকে ‘বেতন নির্ধারণী বিবরণী’ প্রিন্ট করে স্বাক্ষর করতে হয়।
৬. হিসাবরক্ষণ অফিসে প্রেরণ ও প্রতিপাদন (Verification): প্রিন্ট করা বেতন নির্ধারণী বিবরণীর কপি এবং সার্ভিস বুক (যদি প্রযোজ্য হয়) সংশ্লিষ্ট হিসাবরক্ষণ অফিসে প্রতিপাদনের জন্য জমা দিতে হয়। হিসাবরক্ষণ অফিস অনলাইনে দাখিলকৃত তথ্য যাচাই করে সঠিক প্রতীয়মান হলে অনলাইনে তা প্রতিপাদন (Verify) করে।
৭. ভেরিফিকেশন নম্বর: প্রতিপাদনের পর হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি ভেরিফিকেশন নম্বর পাওয়া যায়।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:
- বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট (Annual Increment): প্রতি বছর ১লা জুলাই তারিখে বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের কারণেও এই অনলাইনে বেতন নির্ধারণ বা হালনাগাদ করা বাধ্যতামূলক।
- বাধ্যতামূলক: জাতীয় বেতন স্কেল, ২০১৫ জারির পর থেকে নতুন নিয়োগ, পদোন্নতি, টাইম স্কেল বা উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তি সহ যে কোনো কারণে মূল বেতনের পরিবর্তন হলে অনলাইনে বেতন নির্ধারণ করা বাধ্যতামূলক। এটি ছাড়া বেতন ও ভাতা পরিশোধ করা হয় না।
এই নিয়মগুলো সময়ে সময়ে সরকারি নির্দেশনার মাধ্যমে পরিবর্তিত হতে পারে। সবচেয়ে সঠিক ও হালনাগাদ তথ্যের জন্য বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের (Finance Division) ওয়েবসাইট বা iBAS++ এর পোর্টাল দেখা উচিত।



