বৈষম্য । দাবীর খতিয়ান । পুন:বিবেচনা

সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় নিয়ে উদ্বেগ ২০২৫ । সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়তে পারে ৭০ থেকে ১০০ শতাংশ?

সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে পে কমিশন। বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী সংগঠন ইতোমধ্যেই তাদের প্রস্তাব কমিশনের কাছে জমা দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে বেতনের হার ও সরকারের উপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপের বিষয়টি।

নতুন পে স্কেলে ৭০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার। তিনি আশা করছেন, আগামী জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারির মধ্যে পে কমিশনের প্রস্তাব জমা দেওয়া হতে পারে।


কর্মচারী সংগঠনের প্রস্তাব ও প্রত্যাশা

বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী কল্যাণ ফেডারেশনের পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তাদের সুপারিশে বলা হয়েছে:

  • সর্বনিম্ন বেতন: ৩৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হোক।
  • গ্রেড সংখ্যা হ্রাস: বর্তমান ২০টি গ্রেড কমিয়ে ১২টিতে নামিয়ে আনা হোক।

ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মুখপাত্র আব্দুল মালেক গণমাধ্যমকে বলেন, সর্বশেষ ২০১৫ সালে পে স্কেল হলেও ২০২০ সালে নতুন স্কেল হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি। তিনি জানান, নিয়মিত হলে ২০২৫ সালে সর্বনিম্ন বেতন ৩৩ হাজার টাকায় পৌঁছাতো। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বর্তমানে কর্মচারীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তাই ৩৫ হাজার টাকা সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, বর্তমানে বেতন বৈষম্য রয়েছে ১:১০ অনুপাতে, যা কমিয়ে ১:৪ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।


অতিরিক্ত ব্যয়ের চাপ

সরকারি কর্মচারীদের বেতন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হলে সরকারের ওপর বড় ধরনের আর্থিক চাপ তৈরি হবে। বিভিন্ন বিশ্লেষণ অনুযায়ী অতিরিক্ত ব্যয়ের যে চিত্র উঠে এসেছে, তা নিম্নরূপ:

বৃদ্ধির হারঅতিরিক্ত বার্ষিক ব্যয় (আনুমানিক)
১০০ শতাংশ (দ্বিগুণ)প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা
৯০ শতাংশপ্রায় ৭০-৭৫ হাজার কোটি টাকা
৮০ শতাংশপ্রায় ৬৫-৭০ হাজার কোটি টাকা

বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করা হলে বছরে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।


পে স্কেল প্রস্তাব ও বাস্তবায়ন

নিয়ম অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পে স্কেল হওয়ার কথা থাকলেও ২০১৫ সালের পর তা হয়নি। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার মনে করছেন, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেতন বাড়ানোর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তবে, এত বড় অঙ্কের বেতন বৃদ্ধি করা হলে সরকারের বার্ষিক বাজেটে তা কতটা প্রভাব ফেলবে এবং সেই চাপ সরকার কীভাবে সামাল দেবে, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে।

নতুন পে স্কেলের মূল লক্ষ্য বেতন বৈষম্য হ্রাস এবং গ্রেড কাঠামো পুনর্বিন্যাস করা। কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এই বিষয়ে বিস্তারিত সুপারিশ থাকবে, যা সরকারের কাছে জমা দেওয়া হবে।


এই পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মচারীরা আশা করছেন যে তাদের বেতন কাঠামোতে একটি যৌক্তিক ও সময়োপযোগী পরিবর্তন আসবে, যা বর্তমান বাজার মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।

নিম্নগ্রেডের কর্মচারীর বেতন ৭০-১০০ শতাংশ বৃদ্ধি কি প্রত্যাশা পূরণ করবে?

নিম্নগ্রেডের কর্মচারীদের বেতন ৭০-১০০ শতাংশ বৃদ্ধি তাদের প্রত্যাশা আংশিকভাবে পূরণ করতে পারে, তবে এটি সম্পূর্ণরূপে তাদের আর্থিক সংকট বা দীর্ঘদিনের বঞ্চনা দূর করবে কিনা, তা নির্ভর করবে কয়েকটি প্রধান বিষয়ের ওপর।


১. মূল্যস্ফীতির সাপেক্ষে প্রকৃত আয় (Real Income)

বেতন ৭০-১০০ শতাংশ বৃদ্ধি আপাতদৃষ্টিতে অনেক বেশি মনে হলেও, এর কার্যকারিতা নির্ভর করে মূল্যস্ফীতির হারের ওপর।

  • প্রত্যাশা পূরণ: যদি বেতন বৃদ্ধির হার বিগত বছরগুলোর ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি হয়, তবে কর্মচারীদের ক্রয়ক্ষমতা (Purchasing Power) বাড়বে এবং প্রত্যাশা পূরণের সম্ভাবনা থাকবে।
  • আংশিক পূরণ: যদি ২০১৫ সালের পে-স্কেলের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত জমে থাকা উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি এই বেতন বৃদ্ধির হারকে ‘খেয়ে ফেলে’, তবে বর্ধিত বেতন শুধুমাত্র জীবনযাত্রার বর্তমান ব্যয় মেটাতে সহায়তা করবে, কোনো দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক স্বস্তি দেবে না। তারা ২০২০ সাল থেকে বকেয়া থাকা বেতন বৃদ্ধির প্রত্যাশা করছিল। সেই ক্ষতি পূরণ হতে পারে।

২. প্রস্তাবিত সর্বনিম্ন বেতনের লক্ষ্যমাত্রা

বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী কল্যাণ ফেডারেশন সর্বনিম্ন বেতন ৩৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করেছে।

  • লক্ষ্য পূরণ: যদি ৭০-১০০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির ফলে সর্বনিম্ন গ্রেডের কর্মচারীর বেতন ৩৫ হাজার টাকা বা তার কাছাকাছি পৌঁছায়, তবে এটি তাদের অন্যতম প্রধান দাবি পূরণ করবে।
  • আপেক্ষিক সন্তুষ্টি: যদি কোনো কর্মচারীর বর্তমান সর্বনিম্ন বেতন ২০ হাজার টাকা হয় এবং সেটি ১০০ শতাংশ বেড়ে ৪০ হাজার টাকা হয়, তাহলে এটি অবশ্যই একটি বড় স্বস্তি এনে দেবে।

৩. বেতন বৈষম্য হ্রাস (Grade Reduction)

কর্মচারী সংগঠনগুলো বর্তমান ২০টি গ্রেড কমিয়ে ১২টিতে নামিয়ে আনার এবং বেতন বৈষম্যের অনুপাত ১:১০ থেকে কমিয়ে ১:৪ করার প্রস্তাব করেছে।

  • মানসিক সন্তুষ্টি: যদি পে কমিশন এই গ্রেড হ্রাস এবং বৈষম্য কমানোর প্রস্তাবগুলো কার্যকরভাবে গ্রহণ করে, তবে নিম্নগ্রেডের কর্মচারীদের মধ্যে শুধু আর্থিক নয়, মানসিক সন্তুষ্টিও বৃদ্ধি পাবে। তারা মনে করবে যে তাদের দীর্ঘদিনের মর্যাদা ও ন্যায্যতার দাবি পূরণ হয়েছে।

উপসংহার

সংক্ষেপে বলা যায়, ৭০-১০০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি নিম্নগ্রেডের কর্মচারীদের জন্য একটি বড় ইতিবাচক পদক্ষেপ হবে এবং এটি তাদের তাৎক্ষণিক প্রত্যাশা পূরণে সহায়ক হবে। তবে, এটি কেবল তখনই স্থায়ী স্বস্তি দেবে, যখন পে স্কেলে মূল্যস্ফীতিজনিত বঞ্চনা পুষিয়ে নেওয়া হবে, প্রস্তাবিত সর্বনিম্ন বেতন কাঠামো অর্জন হবে, এবং গ্রেড কাঠামোতে বৈষম্য হ্রাস করা হবে। অন্যথায়, এটি কেবল একটি ‘সাময়িক উপশম’ হয়ে থাকবে।

Alamin Mia

আমি একজন সরকারী চাকরিজীবি। দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ চাকুরির সুবাদে সরকারি চাকরি বিধি বিধান নিয়ে পড়াশুনা করছি। বিএসআর ব্লগে সরকারি আদেশ, গেজেট, প্রজ্ঞাপন ও পরিপত্র পোস্ট করা হয়। এ ব্লগের কোন পোস্ট নিয়ে প্রশ্ন থাকলে বা ব্যাখ্যা জানতে পোস্টের নিচে কমেন্ট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *