বেতন কমিশন নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্যের তীব্র নিন্দা সরকারি কর্মচারীদের ২০২৫। ‘অযৌক্তিক’ বেতন কাঠামো নিয়ে জাতীয় দৈনিকে অসঙ্গতিপূর্ণ সংবাদ প্রচারের অভিযোগ
সরকারি কর্মচারীদের নতুন বেতন স্কেল নির্ধারণের জন্য গঠিত জাতীয় বেতন কমিশন সোমবার (২০ অক্টোবর) যে খসড়া প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে বলে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে, তা নিয়ে তীব্র অসন্তোষ ও নিন্দা প্রকাশ করেছেন সরকারি কর্মচারীরা। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খসড়া বেতনের প্রস্তাবকে ‘সম্পূর্ণ বৈষম্যযুক্ত ও অযৌক্তিক’ উল্লেখ করে এই ধরনের অসঙ্গতিপূর্ণ সংবাদ প্রচারের জন্য সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমগুলোর নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
খসড়া প্রস্তাবে অসঙ্গতিপূর্ণ বেতন কাঠামো প্রচার:
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, জাতীয় বেতন কমিশন নাকি ৯০ থেকে ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে। প্রকাশিত তথ্যে গ্রেডভিত্তিক যে মূল বেতনের প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে, তা নিয়েই সবচেয়ে বেশি বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
প্রকাশিত খসড়া প্রস্তাব অনুযায়ী, গ্রেডভিত্তিক মূল বেতনের চিত্রটি ছিল নিম্নরূপ:

সরকারি কর্মচারীদের অভিযোগ, এই খসড়া বেতনের কাঠামোতে নিম্ন গ্রেডগুলোতে (১৩ থেকে ২০) বেতনের পার্থক্য খুবই সামান্য এবং সামগ্রিকভাবে বেতন বৃদ্ধির হার অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক। বিশেষ করে, যখন উচ্চ গ্রেডগুলোতে বিপুল বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে, তখন নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের জন্য প্রকাশিত বেতন বৃদ্ধির পরিমাণ অত্যন্ত হতাশাজনক।
১:৪ বেতন কাঠামোতে ১২টি গ্রেডে জাতীয় বেতন স্কেল দিতে হবে। ৯/৬ কোন বেতন কাঠামো মেনে নেয়া হবে না।

গণমাধ্যমের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন:
যুগান্তর, আমার দেশ, সোনালী নিউজ, আর টিভি, নিউজ ২৪, দেশ রূপান্তর সহ বেশ কিছু জাতীয় দৈনিকে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রের উল্লেখ ছাড়াই এই খসড়া বেতন কাঠামোর সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করা হয়েছে। সরকারি কর্মচারীরা অভিযোগ করেছেন, এ ধরনের সংবেদনশীল বিষয়ে তথ্য যাচাই না করে ভিত্তিহীন সংবাদ পরিবেশন সম্পূর্ণ নৈতিকতা বহির্ভূত কাজ।
সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন ফোরাম থেকে গণমাধ্যমগুলোর এই ভূমিকা নিয়ে তীব্র নিন্দা ও ঘৃণা প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের মতে, সঠিক তথ্য না দিয়ে অনুমানভিত্তিক সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও ক্ষোভ সৃষ্টি করা হচ্ছে, যা জাতীয় বেতন কমিশনের কার্যক্রমেও প্রভাব ফেলতে পারে।
কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন ডিসেম্বরে:
প্রসঙ্গত, মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে গত ২৭ জুলাই জাতীয় বেতন কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন আগামী মাসে অর্থাৎ ডিসেম্বরের মধ্যেই সরকারের কাছে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের আগেই নতুন বেতন স্কেল কার্যকর করার পরিকল্পনা রয়েছে এবং কর্মচারীরা ২০২৬ সালের জানুয়ারি মাস থেকেই নতুন বেতন স্কেলে বেতন-ভাতা পেতে পারেন। তবে খসড়া নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্যের বিষয়ে কমিশন বা সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সরকারি কর্মচারীরা অবিলম্বে বেতন কমিশনের পক্ষ থেকে একটি স্বচ্ছ ও যৌক্তিক বেতন কাঠামো প্রণয়ন এবং গণমাধ্যমগুলোকে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সঠিক তথ্য প্রচারের আহ্বান জানিয়েছেন।
৬ সদস্যের জন্য কেন ১৫৯২৮ টাকা অযৌক্তিক?
৬ সদস্যের একটি পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর জন্য এই পরিমাণ অর্থ বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত কম।
- খাদ্য ব্যয় (Food Cost): ছয়জন মানুষের জন্য তিন বেলা পুষ্টিকর খাবারের জোগান দিতে যে পরিমাণ চাল, ডাল, মাছ, মাংস, তেল, সবজি ইত্যাদি কিনতে হয়, তার বাজার মূল্য এখন অনেক বেশি। ১৫,৯২৮ টাকা থেকে খাদ্যের পেছনে একটি বড় অংশ ব্যয় হয়ে যাবে, যা গুণগত মান বজায় রেখে জোগান দেওয়া কঠিন।
- বাসস্থান ও ভাড়া (Housing and Rent): অধিকাংশ সরকারি কর্মচারীকেই বাড়ি ভাড়া করে থাকতে হয়। মহানগর বা জেলা শহরগুলোতে একটি ৬ সদস্যের পরিবারের থাকার উপযোগী ন্যূনতম বাসস্থানের মাসিক ভাড়া প্রায়শই এই মূল বেতনের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। যদিও মূল বেতনের সঙ্গে বাড়ি ভাড়া ভাতা যুক্ত হয়, তারপরও মোট প্রাপ্তি জীবনযাত্রার ব্যয় বহনের জন্য পর্যাপ্ত নাও হতে পারে।
- শিক্ষা ব্যয় (Education Cost): ৬ সদস্যের পরিবারে সাধারণত একাধিক স্কুলগামী শিশু থাকে। তাদের স্কুলের বেতন, টিউটর ফি, বই-খাতা, পোশাক এবং অন্যান্য শিক্ষা সরঞ্জাম বাবদ মাসিক খরচ উল্লেখযোগ্য।
- চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা (Medical and Healthcare): একটি বড় পরিবারের সদস্যদের নিয়মিত এবং জরুরি চিকিৎসার জন্য নিয়মিত ব্যয়ের প্রয়োজন হয়। স্বাস্থ্যসেবা খরচ মেটানোর পর এই বেতনের খুব সামান্যই অবশিষ্ট থাকে।
সামাজিক মর্যাদা ও ক্রয়ক্ষমতা
- ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস (Reduced Purchasing Power): মুদ্রাস্ফীতির কারণে টাকার মান কমে যাওয়ায় ১৫,৯২৮ টাকা দিয়ে যা কেনা সম্ভব, তা কয়েক বছর আগের তুলনায় অনেক কম।
- ন্যূনতম মজুরি ও সামাজিক চাহিদা (Minimum Wage and Social Needs): সমাজে মর্যাদা নিয়ে টিকে থাকতে পোশাক-আশাক, যাতায়াত, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ইন্টারনেট সংযোগ ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা মেটানোর পরেও একটি পরিবারের জরুরি প্রয়োজন, যেমন: আকস্মিক অসুস্থতা বা উৎসব-পার্বণে ব্যয় করার মতো সংস্থান রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
মূলত, গ্রেড-২০ এর এই ১৫,৯২৮ টাকা বেসিক বেতনটি একটি অদক্ষ কর্মচারীর সর্বনিম্ন ধাপ হলেও, ৬ সদস্যের মতো বড় পরিবারের ভরণপোষণ এবং তাদের জন্য একটি সম্মানজনক জীবনযাত্রার নিশ্চয়তা দিতে এই বেতন কাঠামোকে বাস্তবতার নিরিখে অপর্যাপ্ত বলে মনে করা হয়। এই কারণেই সরকারি কর্মচারীরা এই বেতন কাঠামোকে ‘অযৌক্তিক’ বলে নিন্দা জানিয়েছেন।
সরকারি কর্মচারীগণ কি ১:১০ অনুপাত বেতন কাঠামো ২০টি গ্রেডে চায়?
সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন অংশ, বিশেষ করে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীরা (১১-২০ গ্রেড), বেতন কাঠামোর সর্বোচ্চ (গ্রেড-১) এবং সর্বনিম্ন (গ্রেড-২০) মূল বেতনের অনুপাত ১:১০-এর চেয়ে কম রাখার দাবি জানায়।
বর্তমানে বিদ্যমান ২০টি গ্রেডে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত প্রায় ১০:১। তবে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারী সংগঠনগুলো এই অনুপাতকে বৈষম্যমূলক মনে করে এবং তা কমিয়ে আনার দাবি জানায়।
- সংগঠনের দাবি: ‘১১-২০ গ্রেড সরকারি চাকুরিজীবী ফোরাম’-এর মতো সংগঠনগুলো ১:৪ বা ১:৬ অনুপাতে নতুন পে স্কেল কার্যকর করার দাবি জানিয়েছে। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত কমালে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে এবং গ্রেডভিত্তিক বৈষম্য কমবে।
- কমিশনের ভাবনা: অন্যদিকে, জাতীয় বেতন কমিশন বিদ্যমান ১০:১ অনুপাতটি বা তার কাছাকাছি, অর্থাৎ ৮:১ থেকে ১০:১-এর মধ্যে রাখার বিষয়ে পর্যালোচনা করছে। কমিশন মূলত প্রতিবেশী দেশ এবং বর্তমান পদ্ধতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে।
সুতরাং, সরকারি কর্মচারীরা সামগ্রিকভাবে ১:১০ অনুপাত চান না, বরং ১১ থেকে ২০ গ্রেডের কর্মচারীরা বৈষম্য দূর করার জন্য এই অনুপাতটি কমিয়ে ১:৪ বা ১:৬ করার দাবি জানিয়েছে।



