সরকারি চাকরিতে পদোন্নতি বৈষম্য: হতাশা ও ক্ষোভের ৩০ বছর । উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা নবম গ্রেডে, অথচ উচ্চমান সহকারীরা উপেক্ষিত?
সরকারি দপ্তরে কর্মরত উচ্চমান সহকারী, প্রধান সহকারী ও সমপদধারীদের পদোন্নতি ও পদবি পরিবর্তন নিয়ে দীর্ঘদিনের যে বৈষম্য, তা আবারও সামনে এসেছে। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অধীনে কর্মরতদের মধ্যে কিছু কর্মকর্তার ১৪ গ্রেড থেকে একলাফে ৯ম গ্রেডে উপজেলা নির্বাচন অফিসার হিসেবে পদোন্নতি প্রাপ্তির ঘটনা এই বৈষম্যকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। অন্যদিকে, দেশের বিভিন্ন অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও দপ্তরের হাজার হাজার কর্মচারী, যারা ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে একই পদে চাকরি করে আসছেন, তাদের দাবি এখনো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের টেবিলে আটকে আছে। – সরকারি চাকরিতে পদোন্নতি বৈষম্য
দীর্ঘদিনের দাবি, আশ্বাসেই সীমাবদ্ধতা? ‘বাংলাদেশ প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাস্তবায়ন ঐক্য পরিষদ’ দীর্ঘদিন ধরে উচ্চমান সহকারী ও সমপদগুলোকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে ১০ম গ্রেডে উন্নীত করার দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের যুক্তি হলো, সচিবালয়ের কর্মচারীদের মতো একই যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। তাদের মতে, সচিবালয়ের প্রধান সহকারী ও উচ্চমান সহকারীদের পদবি পরিবর্তন করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা করা হয়েছে এবং তারা ১০ম গ্রেড সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু অন্যান্য দপ্তরের কর্মচারীদের এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আন্দোলনকারী সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বারবার শুধু কমিটি গঠন ও বৈঠকের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে কোনো অগ্রগতি হয়নি। একাধিকবার সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সুপারিশ করলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তা বাস্তবায়নে গড়িমসি করছে। ফলস্বরূপ, অনেক কর্মচারী পদোন্নতি না পেয়েই অবসরে চলে যাচ্ছেন।
উপজেলা নির্বাচন অফিসারের পদোন্নতি: এক নতুন দৃষ্টান্ত হতে যাচ্ছে, অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অধীনে কর্মরত কিছু কর্মকর্তার পদোন্নতি প্রক্রিয়া প্রশাসনিক বৈষম্যের একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তথ্য অনুযায়ী, ১৪ গ্রেডের কর্মচারীগণ সরাসরি ৯ম গ্রেডে উপজেলা নির্বাচন অফিসার হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেছেন। এটি যেখানে এক শ্রেণির কর্মচারীদের মধ্যে আশার আলো জাগাচ্ছে, সেখানে দীর্ঘকাল ধরে বঞ্চিত উচ্চমান সহকারী ও সমপদধারীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করছেন, এটি সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতার একটি বড় উদাহরণ, যেখানে এক দপ্তরের জন্য এক নিয়ম এবং অন্য দপ্তরের জন্য ভিন্ন নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছে।
সংকট সমাধানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা কি? এই বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। বারবার আন্দোলন ও স্মারকলিপি দেওয়া সত্ত্বেও তাদের পক্ষ থেকে কোনো সুস্পষ্ট আশ্বাস বা সমাধানের পথ দেখানো হয়নি। কর্মকর্তারা মনে করেন, উচ্চমান সহকারী ও প্রধান সহকারীর মতো পদগুলোর পদবি পরিবর্তন করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা করা হলে একদিকে যেমন কর্মস্পৃহা বাড়বে, তেমনি দীর্ঘদিনের বেতন বৈষম্যেরও অবসান হবে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সদিচ্ছার অভাবে এই প্রক্রিয়াটি আটকে আছে।
ঐক্য পরিষদের নেতারা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, তাদের দাবি দ্রুত বাস্তবায়ন করা না হলে তারা আরও কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা দেবেন। তারা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন, যাতে এই দীর্ঘদিনের বৈষম্যের অবসান হয় এবং তারা প্রাপ্য মর্যাদা নিয়ে চাকরি করতে পারেন।
সরকারি চাকরিতে পদোন্নতি বৈষম্য: হতাশা ও ক্ষোভের ৩০ বছর / নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর ১৪তম গ্রেড হতে উপজেলা /থানা নির্বাচন অফিসার ৯ম গ্রেড এর ২১টি পদে পদোন্নতির পরামর্শ প্রদান করায় পদোন্নতি বৈষম্য নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে।
মাঠ পর্যায়ে উচ্চমান সহকারী হতে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির দাবীর সমাধান হয়েছে কি? মাঠ পর্যায়ে উচ্চমান সহকারী, প্রধান সহকারী ও সমপদধারীদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির দাবির সমাধান এখনও হয়নি। দীর্ঘ তিন দশক ধরে এই দাবিতে আন্দোলন, স্মারকলিপি এবং মিটিং চললেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

Caption: সরকারি চাকরিতে পদোন্নতি বৈষম্য হতাশা ও ক্ষোভের ৩০ বছর
প্রশাসনিক কর্মকর্তা দাবির বর্তমান অবস্থা ২০২৫ । ৩০ বছর ধরে দাবী করে আসলেও সরকার তাতে কর্নপাত করেনি
- জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গড়িমসি: বাংলাদেশ প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাস্তবায়ন ঐক্য পরিষদ দীর্ঘদিন ধরে এই দাবি বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। তারা বারবার কমিটি গঠন এবং বৈঠকের আশ্বাস দিয়ে চলেছে, কিন্তু কোনো বাস্তব অগ্রগতি নেই।
- সচিবালয় ও অন্যান্য দপ্তরের বৈষম্য: একই শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কাজের ধরন থাকা সত্ত্বেও সচিবালয়ের প্রধান সহকারী ও উচ্চমান সহকারীদের পদবি পরিবর্তন করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা করা হয়েছে এবং তারা ১০ম গ্রেড সুবিধা পাচ্ছেন। অথচ মাঠ পর্যায়ের কর্মচারীরা একই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই বৈষম্য কর্মচারীদের মধ্যে গভীর হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
- সুপারিশ ও বাস্তবায়ন: একাধিকবার সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এই পদবি পরিবর্তন ও পদোন্নতির পক্ষে সুপারিশ করলেও তা বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি হয়নি। এতে এই কর্মচারীদের মধ্যে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে।
- আন্দোলনের হুঁশিয়ারি: সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মচারীদের ১৪ গ্রেড থেকে সরাসরি ৯ম গ্রেডে পদোন্নতি পাওয়ার ঘটনা এই ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আন্দোলনকারীরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, যদি দ্রুত এই সমস্যার সমাধান না করা হয়, তাহলে তারা আরও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। সুতরাং, মাঠ পর্যায়ের উচ্চমান সহকারী ও সমপদধারীদের এই ন্যায্য দাবিটি এখনো সমাধান হয়নি এবং তারা তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
মন্ত্রণালয়ে উচ্চমান সহকারী হতে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়?
হ্যাঁ, মন্ত্রণালয়গুলোতে উচ্চমান সহকারী ও প্রধান সহকারী পদধারীরা প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি পান। মূলত, সচিবালয়ে কর্মরত উচ্চমান সহকারী ও প্রধান সহকারীদের পদবি পরিবর্তন করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা (Administrative Officer) এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (Personal Officer) করা হয়েছে। এই পদবি পরিবর্তনের মাধ্যমে তারা ১০ম গ্রেডের সুবিধা পেয়েছেন, যা তাদের দীর্ঘদিনের দাবির একটি সমাধান। কিন্তু এই সুবিধাটি শুধুমাত্র সচিবালয়ের কর্মচারীদের জন্য সীমাবদ্ধ। দেশের বিভিন্ন অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও মাঠ পর্যায়ের দপ্তরে কর্মরত একই শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কাজের ধরন সম্পন্ন কর্মচারীরা এখনো এই পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত। ‘বাংলাদেশ প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাস্তবায়ন ঐক্য পরিষদ’ দীর্ঘদিন ধরে এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছে, কারণ তারা মনে করেন, একই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধু দপ্তরের ভিন্নতার কারণে তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। সুতরাং, আপনার প্রশ্নের উত্তর হলো, মন্ত্রণালয়ে উচ্চমান সহকারী পদধারীরা প্রশাসনিক কর্মকর্তা হন, কিন্তু এই সুযোগটি অন্যান্য দপ্তরের কর্মচারীদের জন্য এখনো নিশ্চিত হয়নি।
সরকারি ১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীদের পদোন্নতি বৈষম্য দূর করতে হলে একটি সমন্বিত ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। এই সমস্যা সমাধানে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে:
| ১. অভিন্ন নিয়োগ ও পদোন্নতি বিধিমালা প্রণয়ন: করণীয়: দেশের সকল মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি অভিন্ন নিয়োগ ও পদোন্নতি বিধিমালা প্রণয়ন করতে হবে। বর্তমানে বিভিন্ন দপ্তরের নিজস্ব বিধিমালা থাকায় এই বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। সুফল: এটি বাস্তবায়িত হলে সকল কর্মচারী একই নিয়ম ও মানদণ্ডের ভিত্তিতে পদোন্নতি পাবেন, যা বৈষম্য অনেকাংশে দূর করবে। | ২. পদবি পরিবর্তন ও গ্রেড আপগ্রেডেশন: করণীয়: সচিবালয়ের মতো অন্যান্য দপ্তর ও মাঠ পর্যায়েও উচ্চমান সহকারী, প্রধান সহকারী ও সমপদগুলোকে ‘প্রশাসনিক কর্মকর্তা’ বা সমমানের পদবিতে উন্নীত করতে হবে এবং তাদের জন্য ১০ম গ্রেড নিশ্চিত করতে হবে। সুফল: এটি শুধুমাত্র পদোন্নতি বৈষম্যই দূর করবে না, বরং কর্মচারীদের মধ্যে কাজের প্রতি আগ্রহ ও মনোবল বৃদ্ধি করবে। | ৩. বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষার ব্যবস্থা জোরদারকরণ: করণীয়: ১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীদের জন্য নিয়মিত ও স্বচ্ছ বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। নির্দিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা ও চাকরির মেয়াদ পূরণের পর এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। সুফল: এতে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি নিশ্চিত হবে এবং অপেক্ষাকৃত কম গ্রেডের কর্মচারীদেরও উচ্চ পদে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। |
| ৪. পদোন্নতি নীতিমালা সহজীকরণ: করণীয়: বর্তমানে পদোন্নতির জন্য যে জটিল ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়, তা সহজ করতে হবে। পদ শূন্য হলে দ্রুত তা পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। সুফল: এটি পদোন্নতির জট কমিয়ে আনবে এবং কর্মচারীরা দ্রুত তাদের প্রাপ্য পদোন্নতি পাবেন। | ৫. জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সক্রিয় ভূমিকা: করণীয়: এই সমস্যার সমাধানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠনের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করে তাদের দাবি-দাওয়া শুনতে হবে এবং দ্রুত তা বাস্তবায়নের জন্য সুস্পষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। সুফল: এর মাধ্যমে কর্মচারীদের মধ্যে সরকারের প্রতি আস্থা বাড়বে এবং তারা আরও বেশি মনোযোগী হয়ে কাজ করতে পারবে। | ৬. স্থায়ী পে-কমিশন গঠন: করণীয়: বেতন কমিশনকে শুধু বেতন স্কেল নিয়ে কাজ না করে, পদোন্নতি ও পদবি সংক্রান্ত বিষয়গুলোকেও তাদের সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একটি স্থায়ী পে-কমিশন গঠন করা গেলে বেতন ও পদোন্নতি সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়মিত পর্যালোচনা ও সমাধানের সুযোগ থাকবে। সুফল: এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী সমাধান দেবে এবং ভবিষ্যতের বৈষম্য রোধ করতে সাহায্য করবে। সংক্ষেপে, ১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীদের পদোন্নতি বৈষম্য দূর করতে হলে একটি সামগ্রিক প্রশাসনিক সংস্কার প্রয়োজন, যেখানে সকল কর্মচারীর জন্য সমান সুযোগ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। |



