বৈষম্য । দাবীর খতিয়ান । পুন:বিবেচনা

গ্রেড বৈষম্যের যাঁতাকলে ‘দেশ রক্ষার কারিগর’ ২০২৫ । সৈনিক/কনস্টেবলদের ন্যায্যতার দাবি উঠেছে?

নিলয় আদনান, ঢাকা: একই রাষ্ট্রের সেবক, অথচ বেতন-গ্রেড ও কর্মঘণ্টার হিসেবে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। একদিকে, দেশের শিক্ষা কাঠামোকে মজবুত করা প্রাথমিক শিক্ষকরা (সহকারী) বেতন স্কেলের ১৩তম গ্রেডে (বেসিক ১১,০০০/-) থেকেও এখন ১০ম গ্রেড প্রাপ্তির জন্য সোচ্চার। অন্যদিকে, দেশের সীমান্ত ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত সৈনিক/কনস্টেবলরা বছরের পর বছর ধরে পড়ে আছেন ১৭তম গ্রেডে (বেসিক ৯,০০০/-), যা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে তাঁদের মধ্যে।

শিক্ষকদের গ্রেড উন্নয়নের দাবি ন্যায্য হলেও, সৈনিক/কনস্টেবলদের মতো অধিক পরিশ্রমী এবং ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত কর্মীদের গ্রেড অপরিবর্তিত থাকায় এটি এখন ‘ইনসাফ’ বা ন্যায্যতার প্রশ্নে পরিণত হয়েছে।


গ্রেড ও বেতনের তুলনামূলক চিত্র

জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী, প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক বর্তমানে ১৩তম গ্রেডে বেতন পান, যার মূল স্কেল ১১,০০০/- টাকা। অন্যদিকে, সৈনিক ও কনস্টেবলদের বেতন শুরু হয় ১৭তম গ্রেডে, যার মূল স্কেল ৯,০০০/- টাকা।

পদবিবর্তমান গ্রেডমূল বেতন (বেসিক)
প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক১৩তম গ্রেড১১,০০০/-
সৈনিক/কনস্টেবল১৭তম গ্রেড৯,০০০/-

কর্মঘণ্টা ও ঝুঁকির পার্থক্য

সৈনিক ও কনস্টেবলদের কাজের ধরন এবং ঝুঁকি প্রাথমিক শিক্ষকদের তুলনায় বহুলাংশে ভিন্ন ও চ্যালেঞ্জিং।

  • শিক্ষক: সপ্তাহে ৫ দিন, দৈনিক ৭ ঘণ্টা কাজ করেন। তাঁরা বছরজুড়ে সরকারি ছুটি, ঈদ, পূজা এবং অন্যান্য দিবসে নিয়মিত ছুটি ভোগ করেন।
  • সৈনিক/কনস্টেবল: সপ্তাহে ৭ দিন, দৈনিক ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা (ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি) ডিউটি করেন। নিয়মিত ডিউটির পাশাপাশি পিটি, প্যারেড, ওয়ার্কিং ও গেইমসে অংশ নিতে হয়। সরকারি ছুটির দিনগুলোতে তাঁদের ডিউটির চাপ প্রায়শই বহুগুণ বেড়ে যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তাঁরা সর্বদা শত্রুর বুলেট বা জননিরাপত্তা বজায় রাখার ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন এবং দুই মাসের আগে ছুটি পাওয়া তাঁদের জন্য কঠিন।

শিক্ষাগত যোগ্যতায় পরিবর্তন, গ্রেডে স্থবিরতা

পূর্বে সৈনিক/কনস্টেবল পদে প্রবেশের ন্যূনতম যোগ্যতা এসএসসি/সমমান হলেও, বর্তমানে চাকরির বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে ৯০ শতাংশেরও বেশি নিয়োগপ্রাপ্ত সদস্য অনার্স/ডিগ্রি সম্পন্ন করে আসছেন। অনেকে চাকরিতে কর্মরত অবস্থায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন। শিক্ষাগত যোগ্যতার এই উন্নতি সত্ত্বেও তাঁদের জন্য বেতন গ্রেডের কোনো পরিবর্তন না আসাটা হতাশার জন্ম দিয়েছে।


দেশের দুই কারিগর: ইনসাফের দাবি

শিক্ষকরা যেমন মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে সমাজের সর্বোচ্চ সম্মান পান এবং তাঁদের ১০ম গ্রেডের দাবি যৌক্তিক, ঠিক তেমনি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা সৈনিক/কনস্টেবলরাও ‘দেশ রক্ষার কারিগর’। তাদের এই কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ সেবার যথার্থ মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন।

সৈনিক/কনস্টেবলদের দীর্ঘদিনের দাবি, তাঁরা যেন অন্তত শিক্ষকদের সমপর্যায়ে না হলেও, তাঁদের কাজের গুরুত্ব ও ঝুঁকির বিপরীতে একটি ন্যায্য গ্রেড পান।

এই বৈষম্য দূর করে দেশ রক্ষার কারিগরদের জীবনযাত্রার মান ও মানসিক সন্তুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য ১৭তম গ্রেডে থাকা সৈনিক/কনস্টেবলদের বেতন গ্রেড যৌক্তিক স্তরে উন্নীত করার দাবি এখন সময়ের।

নিম্নগ্রেডে বেতন কম হওয়াতে কেউ থাকতে চায় না?

কম বেতনের কারণে কর্মীরা তাদের দৈনন্দিন আর্থিক চাহিদা মেটাতে এবং জীবনযাত্রার মান ধরে রাখতে হিমশিম খান। পরিবার বা নিজের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার জন্য তাদের আরও বেশি বেতনের প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে যদি সৈনিক/কনস্টেবলদের মতো অতিরিক্ত পরিশ্রম ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য বেতন তুলনামূলকভাবে কম হয়, তখন কর্মীদের মধ্যে এই ধারণা জন্মায় যে তাঁদের পরিশ্রমের ন্যায্য মূল্যায়ন হচ্ছে না। এটি তাঁদের মনোবল ভেঙে দেয়।

১. পেশাগত উন্নতি ও স্বীকৃতি

নিম্ন গ্রেড প্রায়শই নির্দেশ করে যে পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ সীমিত। কর্মীরা সব সময় এমন একটি প্রতিষ্ঠানে থাকতে চান যেখানে কাজের মাধ্যমে উচ্চতর গ্রেডে উন্নীত হওয়া এবং বেতন বৃদ্ধির সুযোগ থাকে। নিম্ন গ্রেডে স্থবিরতা তাঁদের মনে হতাশার জন্ম দেয়।

২. সামাজিক মর্যাদা ও তুলনামূলক বৈষম্য

একই সমাজে বা পেশায় অন্যদের তুলনায় কম বেতনের কারণে কর্মীদের মধ্যে সামাজিক মর্যাদা এবং তুলনামূলক বৈষম্যের অনুভূতি সৃষ্টি হয়। আপনার দেওয়া উদাহরণে, শিক্ষকদের (১৩তম গ্রেড) তুলনায় সৈনিক/কনস্টেবলদের (১৭তম গ্রেড) বেতন কম হওয়ায় এই বৈষম্য আরও স্পষ্ট।

৩. মেধাবী কর্মীদের ধরে রাখা কঠিন

উচ্চশিক্ষিত ও মেধাবী কর্মীরা (যেমন আপনার বলা অনার্স/ডিগ্রি সম্পন্ন সৈনিক/কনস্টেবলরা) সব সময় এমন চাকরি খুঁজবেন যা তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও দক্ষতার সঠিক মূল্যায়ন করে। নিম্ন গ্রেডে দীর্ঘদিন থাকলে তাঁরা আরও ভালো বেতন ও সুযোগ-সুবিধার সন্ধানে অন্য পেশা বা প্রতিষ্ঠানে চলে যেতে চান। ফলস্বরূপ, কম বেতনের নিম্ন গ্রেডগুলি প্রায়শই কর্মীদের জন্য একটি ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’ বা সাময়িক আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে, যেখানে তারা কেবল আরও ভালো সুযোগ না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে।

সৈনিক (সেনাবাহিনী) এবং কনস্টেবল (পুলিশ) উভয় পদের মূল বেতন সাধারণত ১৭তম গ্রেড-এর সমতুল্য স্কেলে শুরু হয়।

১. মূল বেতন (Basic Pay)

  • বেসিক স্কেল: জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী, ১৭তম গ্রেডের মূল বেতন স্কেল হলো ৯,০০০/- টাকা (সর্বনিম্ন)। এটি সময়ের সাথে বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট (বেতন বৃদ্ধি) সহ বাড়ে।

  • প্রশিক্ষণকালীন বেতন: নিয়োগের পর প্রশিক্ষণ চলাকালীন একটি নির্দিষ্ট হারে ভাতা বা বেতন দেওয়া হয়, যা পূর্ণ বেসিক বেতনের চেয়ে সামান্য কম থাকতে পারে।

২. বিভিন্ন প্রকার ভাতা (Allowances)

মূল বেতনের সঙ্গে বিভিন্ন প্রকার ভাতা যুক্ত হয়ে মোট বেতন তুলনামূলকভাবে বেশি হয়। এই ভাতাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

ভাতার প্রকারপরিমাণ (আনুমানিক)মন্তব্য
বাড়ি ভাড়া ভাতাবেসিক বেতনের ৫০% বা নির্ধারিত হারেএলাকাভেদে (যেমন ঢাকা, চট্টগ্রাম, বা অন্যান্য এলাকা) তারতম্য হতে পারে।
চিকিৎসা ভাতা১,৫০০ টাকা (মাসিক)পরিবার সহ চিকিৎসা সুবিধা।
রেশন সুবিধাখাদ্য সামগ্রী বাবদ সুবিধাসামরিক ও অন্যান্য বাহিনীর জন্য সরকার নির্ধারিত দামে বা বিনামূল্যে রেশন দেওয়া হয়।
ঝুঁকি ভাতানির্দিষ্ট হারেবিশেষ করে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর জন্য ঝুঁকি বিবেচনা করে দেওয়া হয়।
অন্যান্য ভাতাযাতায়াত ভাতা, পোশাক ভাতা, ধোলাই/টিফিন ভাতা, শিক্ষা ভাতা ইত্যাদি।পদবি ও কর্মস্থলের ওপর নির্ভর করে এর পরিমাণ কম-বেশি হয়।

💰 মোট বেতন (Total Salary) এর ধারণা

একজন নবীন সৈনিক বা কনস্টেবল প্রশিক্ষণ শেষে চাকরিতে যোগদানের পর সকল ভাতা সহ মোট বেতন সাধারণত ১৫,০০০/- টাকা থেকে শুরু করে ২৪,০০০/- টাকা বা তার বেশি হতে পারে।

Alamin Mia

আমি একজন সরকারী চাকরিজীবি। দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ চাকুরির সুবাদে সরকারি চাকরি বিধি বিধান নিয়ে পড়াশুনা করছি। বিএসআর ব্লগে সরকারি আদেশ, গেজেট, প্রজ্ঞাপন ও পরিপত্র পোস্ট করা হয়। এ ব্লগের কোন পোস্ট নিয়ে প্রশ্ন থাকলে বা ব্যাখ্যা জানতে পোস্টের নিচে কমেন্ট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *