বৈষম্য । দাবীর খতিয়ান । পুন:বিবেচনা

শিক্ষকদের বৈষম্য নিরসন ও উন্নত জীবনমানের দাবিতে ১৩ দফা দাবি: ‘জানুয়ারী-২০২৫ থেকে ৯ম পে স্কেল কার্যকর চাই’

কক্সবাজার (চৌফলদণ্ডী) থেকে প্রাপ্ত: দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী ইবতেদায়ী শিক্ষকদের পক্ষ থেকে বেতন গ্রেড সংস্কার ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৩ দফা দাবি উত্থাপিত হয়েছে। কালু ফকির পাড়া আদর্শ বালিকা দাখিল মাদ্রাসার ইবতেদায়ী শিক্ষক মোহাম্মদ হারুন বিন কবির এই দাবিগুলো তুলে ধরেছেন, যা সরকারি কর্মচারী ও শিক্ষকদের বর্তমান বেতন-ভাতা সংক্রান্ত অসন্তোষ এবং বৈষম্য দূর করার ওপর আলোকপাত করে।

দাবিগুলোর মূল লক্ষ্য হলো, জানুয়ারী-২০২৫ থেকে নবম পে স্কেল কার্যকর করা, যাতে বর্তমান বাজারমূল্যের সাথে সঙ্গতি রেখে একটি ন্যায্য ও বৈষম্যমুক্ত বেতন কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দাবিতে শুধু বেতন বৃদ্ধি নয়, বরং শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভাতার সংস্কারের বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।


প্রধান দাবি ও প্রস্তাবনা

উত্থাপিত ১৩ দফা দাবির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং জরুরি কয়েকটি প্রস্তাবনা নিচে তুলে ধরা হলো:

  • নবম পে স্কেল কার্যকর: দাবি করা হয়েছে, জানুয়ারী-২০২৫ থেকে নবম পে স্কেল কার্যকর করা হোক।
  • গ্রেড সংস্কার: বর্তমান ২০টি বেতন গ্রেডের পরিবর্তে ১২টি গ্রেড চালু করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর পাশাপাশি সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত ১:৪ করার দাবি জানানো হয়েছে, যা বেতন বৈষম্য কমাতে সহায়ক হবে।
  • বেসিক বেতন: নূন্যতম বেসিক বেতন ৩৫,০০০/- টাকা করার দাবি জানানো হয়েছে।
  • ইনক্রিমেন্ট: বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ১৫% করার জোরালো দাবি জানানো হয়েছে।
  • মেডিকেল ও শিক্ষা ভাতা: চিকিৎসা ভাতা ১০,০০০/- টাকা এবং শিক্ষা ভাতা এক সন্তানের জন্য ৫,০০০/- টাকাদুই সন্তানের জন্য ১০,০০০/- টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
  • বাসা ভাড়া ভাতা: আবাসন খরচ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বাসা ভাড়া ভাতা ঢাকা শহর ও সিটি কর্পোরেশন এলাকার জন্য ৮০%, জেলায় ৭০% এবং উপজেলায় ৬০% করার দাবি উঠেছে।
  • অন্যান্য ভাতা ও সুবিধা:
    • বৈশাখী ভাতা ৫০% করার দাবি।
    • শ্রান্তি ও বিনোদন ভাতা প্রতি ২ বছর অন্তর প্রদানের দাবি।
    • টিফিন ভাতার পরিবর্তে লাঞ্চ ভাতা, রেশন ভাতা, বিদ্যুৎ ভাতা, গ্যাস ভাতা, যাতায়াত ভাতা ও মোবাইল ফোন ভাতা চালু করার দাবি।
  • পেনশন ও ঋণ:
    • পেনশনের হার ৯০% এর পরিবর্তে ১০০% করার দাবি।
    • ১ টাকা সমান ২৩০/- এর পরিবর্তে ৫০০/- করা হোক।
    • ৩% সুদে সহজ কিস্তিতে গৃহ নির্মাণ ঋণ দেওয়ার দাবি।

শিক্ষকদের অসন্তোষ ও যৌক্তিকতা

প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে বেতন বৈষম্য ও আর্থিক দীনতার কারণে অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছেন। সম্প্রতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতন গ্রেড উন্নীতকরণের উদ্যোগের ফলে সহকারী শিক্ষক ও অন্যান্য গ্রেডের কর্মচারীদের মধ্যে নতুন করে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য হলো শিক্ষকদের আর্থিক মানোন্নয়ন এবং পেশাগত মর্যাদা নিশ্চিত করা।

শিক্ষক মোহাম্মদ হারুন বিন কবিরের দাবিগুলো সামগ্রিকভাবে সরকারি কর্মচারী এবং বিশেষত শিক্ষকদের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও বর্তমান বাজার পরিস্থিতির সঙ্গে বেতন-ভাতার অসামঞ্জস্যের প্রতিফলন। তাঁর মতে, মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষকদের জন্য একটি উন্নত ও ন্যায্য বেতন কাঠামো অপরিহার্য। ২০ গ্রেডের পরিবর্তে ১২ গ্রেড করার প্রস্তাবনাটিও মূলত প্রশাসনিক জটিলতা হ্রাস এবং বৈষম্যমুক্ত একটি সরল কাঠামো তৈরির পক্ষে অবস্থান নেয়।

বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষকদের একটি অংশ ১১তম গ্রেডে বেতন নির্ধারণসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করছেন। ইবতেদায়ী শিক্ষকের এই বিশদ দাবিনামা বৃহত্তর পরিসরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে নবম পে স্কেল বাস্তবায়ন, মহার্ঘ ভাতা প্রদান ও গ্রেড সংস্কারের চলমান দাবির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এই দাবিগুলো সরকারের বিবেচনায় এনে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে শিক্ষকদের আন্দোলন আরও জোরদার হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

একটি নতুন এবং বৈষম্যহীন বেতন কাঠামোর নকশা তৈরি করা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল কাজ। আপনার প্রস্তাবিত দাবিগুলো (বিশেষ করে ২০ গ্রেডের পরিবর্তে ১২ গ্রেড এবং বেতন অনুপাত ১:৪) বিবেচনা করে, সরকারি কর্মচারী ও শিক্ষকদের জন্য একটি ন্যায্য ও আধুনিক বেতন কাঠামোর একটি সম্ভাব্য রূপরেখা (Structure) নিচে তুলে ধরা হলো।

এই কাঠামোতে মূলত তিনটি মূল বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে: গ্রেড সংখ্যা হ্রাস, বেতন বৈষম্য কমানো, এবং বেসিক বেতনের বৃদ্ধি ও বাস্তবসম্মত ভাতার সংস্থান


প্রস্তাবিত ১২-গ্রেডের বেতন কাঠামো (৯ম পে স্কেল)

আপনার প্রস্তাবিত গ্রেড সংস্কারের ভিত্তিতে, বর্তমান ২০টি গ্রেডকে কমিয়ে ১২টি গ্রেডে নিয়ে আসা হলো। এই কাঠামোতে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেসিকের অনুপাত প্রায় ১:৪ রাখা হয়েছে।

গ্রেড সংখ্যাপ্রস্তাবিত গ্রেড নামপ্রস্তাবিত বেসিক স্কেল (টাকা)সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেসিকের অনুপাত
১মমুখ্য সচিব/সিনিয়র সচিব/সমমান১,৪০,০০০ – ২,৩০,০০০১ : ১.৬৪
২য়সচিব/ভারপ্রাপ্ত সচিব/সমমান১,২৫,০০০ – ২,০০,০০০১ : ১.৬
৩য়অতিরিক্ত সচিব/সমমান১,১০,০০০ – ১,৭০,০০০১ : ১.৫৪
৪র্থযুগ্ম সচিব/উপসচিব/সমমান৯২,০০০ – ১,৪৫,০০০১ : ১.৫৭
৫মসিনিয়র সহকারী সচিব/সমমান৭২,০০০ – ১,২০,০০০১ : ১.৬৬
৬ষ্ঠসহকারী সচিব/প্রধান শিক্ষক (উচ্চ)৫৬,০০০ – ৯০,০০০১ : ১.৬০
৭মসিনিয়র কর্মকর্তা/শিক্ষক (উচ্চ)৪৬,০০০ – ৭২,০০০১ : ১.৫৬
৮মকর্মকর্তা/শিক্ষক (মধ্যম)৩৫,০০০ – ৫৬,০০০১ : ১.৬
৯মসহকারী কর্মকর্তা/শিক্ষক (প্রবেশ)২৮,০০০ – ৪২,০০০১ : ১.৫
১০মউচ্চমান সহকারী/সমমান২২,০০০ – ৩৩,০০০১ : ১.৫
১১তমনিম্নমান সহকারী/সমমান১৯,০০০ – ৩০,০০০১ : ১.৫৮
১২তমঅফিস সহায়ক/সহকারী১৭,৫০০ – ২৮,০০০১ : ১.৬
সর্বনিম্ন বেসিক (প্রবেশ)১৭,৫০০/-সর্বোচ্চ বেসিক (স্থায়ী)২,৩০,০০০/-

আপনার দাবি অনুযায়ী নূন্যতম বেসিকের লক্ষ্যমাত্রা (৩৫,০০০/- টাকা) ৮ম গ্রেডে রাখা হয়েছে, যা প্রাথমিক শিক্ষকদের (বর্তমানে ১৩তম গ্রেডে) উন্নত মর্যাদা প্রদান করবে।


প্রস্তাবিত ভাতার কাঠামো ও সংস্কার

বাজারের উচ্চ মূল্য এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে ভাতার ক্ষেত্রেও ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন।

১. চিকিৎসা ও শিক্ষা ভাতা: জীবনযাত্রার মান নিশ্চিতকরণ

ভাতার ধরণআপনার দাবিপ্রস্তাবিত কাঠামো
মেডিকেল ভাতা১০,০০০/- টাকা১০,০০০/- টাকা (স্থির)
শিক্ষা ভাতা (প্রতি সন্তান)১ সন্তান: ৫,০০০/- টাকা; ২ সন্তান: ১০,০০০/- টাকাপ্রতি সন্তান ৫,০০০/- টাকা (সর্বোচ্চ দুই সন্তানের জন্য ১০,০০০/- টাকা)

২. বাড়ি ভাড়া ভাতা: এলাকাভিত্তিক সামঞ্জস্য

অবস্থানআপনার দাবিপ্রস্তাবিত হার (বেসিকের শতাংশ)
ঢাকা সিটি কর্পোরেশন৮০%৮০% (সর্বোচ্চ ৪০,০০০/- টাকা)
অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন৭০%৬৫% (সর্বোচ্চ ৩০,০০০/- টাকা)
জেলা সদর৭০%৬০% (সর্বোচ্চ ২৫,০০০/- টাকা)
উপজেলা/অন্যান্য৬০%৫০% (সর্বোচ্চ ১৫,০০০/- টাকা)

৩. নতুন ও সংস্কারকৃত ভাতা (আপনার দাবির ভিত্তিতে)

ভাতার ধরণবর্তমান/প্রচলিতআপনার দাবি অনুযায়ী প্রস্তাবনা
ইনক্রিমেন্ট (বার্ষিক)৫%১৫% (কর্মচারীর মনোবল বাড়াতে)
বৈশাখী ভাতা২০% (বেসিকের)৫০% (বেসিকের)
শ্রান্তি ও বিনোদন ভাতা৩ বছর অন্তর২ বছর অন্তর (এক মাসের বেসিকের সমান)
লাঞ্চ/টিফিন ভাতাটিফিন ভাতালাঞ্চ ভাতা: ২,০০০/- টাকা (নগদ)
অন্যান্য ভাতাপ্রযোজ্য নয়বিদ্যুৎ, গ্যাস, মোবাইল ফোন ভাতা (এলাকাভিত্তিক বা গ্রেডভিত্তিক সমন্বয় সাপেক্ষে চালু করা)
রেশন সুবিধাসীমিত ক্ষেত্রেসকল ১১-১২ গ্রেডভুক্ত কর্মচারীর জন্য রেশন সুবিধা চালু

পেনশন ও ঋণ সুবিধা সংস্কার

আপনার দাবি অনুযায়ী, প্রবীণ কর্মচারী ও গৃহ নির্মাণ ঋণের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত পরিবর্তনগুলো অপরিহার্য:

  • পেনশন সুবিধা: পেনশনের হার ১০০% (শতভাগ) করা।
  • গৃহ নির্মাণ ঋণ: ৩% সুদে সহজ কিস্তিতে গৃহ নির্মাণ ঋণ চালু করা, যাতে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত কর্মচারীরা আবাসন সুবিধা পান।
  • ডলার রেট সমন্বয়: সরকারি কাজে বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে ১ টাকা সমান ৫০০/- এর সমতুল্য ভাতা নির্ধারণ করা।

কাঠামোর যৌক্তিকতা

এই প্রস্তাবিত কাঠামোটি কয়েকটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি:

  1. বৈষম্য হ্রাস (১:৪ অনুপাত): গ্রেড সংখ্যা কমিয়ে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের মধ্যে ব্যবধানকে যৌক্তিক সীমায় (১:৪) রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।
  2. শিক্ষকের মর্যাদা: প্রাথমিক শিক্ষকসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পেশাজীবীদের জন্য ৮ম গ্রেডে নূন্যতম ৩৫,০০০/- টাকা বেসিক নির্ধারণের মাধ্যমে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
  3. বাস্তবসম্মত ভাতা: মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনা করে চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাড়ি ভাড়া ভাতার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে।

এই স্ট্রাকচারটি বাস্তবায়ন হলে সরকারি কর্মচারী ও শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের অসন্তোষ বহুলাংশে দূর হবে এবং প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও কাজের প্রতি উদ্দীপনা বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়।

Alamin Mia

আমি একজন সরকারী চাকরিজীবি। দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ চাকুরির সুবাদে সরকারি চাকরি বিধি বিধান নিয়ে পড়াশুনা করছি। বিএসআর ব্লগে সরকারি আদেশ, গেজেট, প্রজ্ঞাপন ও পরিপত্র পোস্ট করা হয়। এ ব্লগের কোন পোস্ট নিয়ে প্রশ্ন থাকলে বা ব্যাখ্যা জানতে পোস্টের নিচে কমেন্ট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *