অবসরে একজন সচিব কত টাকা পেনশন পান? জেনে নিন হিসাবের বিস্তারিত নিয়ম
সরকারি চাকরিতে একজন সচিব সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে আসীন থাকেন। চাকরির মেয়াদ শেষে তাদের পেনশন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে জনমনে প্রায়ই কৌতূহল দেখা যায়। জাতীয় বেতন স্কেল ও সরকারি গেজেট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একজন সচিবের পেনশন মূলত তার শেষ মূল বেতন (Basic Salary) এবং চাকরির মেয়াদের ওপর নির্ভর করে। তবে আনুমানিক হিসাবে দেখা যায়, মাসিক পেনশন ও চিকিৎসা ভাতা মিলিয়ে এই অংকটি বেশ সম্মানজনক।
পেনশন গণনার মূল ভিত্তি সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, পেনশনের পরিমাণ নির্ধারণের প্রধান মাপকাঠি হলো কর্মকর্তার শেষ মূল বেতন। একজন সচিব বা গ্রেড-২ ভুক্ত কর্মকর্তার ক্ষেত্রে জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী সর্বোচ্চ মূল বেতন আনুমানিক ৭৪,৪০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। পেনশনের হার সাধারণত এই মূল বেতনের ৯০ শতাংশ ধরা হয়।
পেনশন নির্ধারণের সাধারণ সূত্রটি হলো:
মাসিক পেনশন = (শেষ মূল বেতন × ৯০%) ÷ ২
এখানে উল্লেখ্য, মোট পেনশনের অর্ধেক (৫০%) সরকার এককালীন আনুতোষিক বা গ্র্যাচুইটি হিসেবে প্রদান করে এবং বাকি অর্ধেক মাসিক পেনশন হিসেবে দেওয়া হয়।
বাস্তব উদাহরণ ও টাকার অংক যদি একজন সচিবের শেষ মূল বেতন ৭৪,৪০০ টাকা হয়, তবে তার পেনশনের হিসাবটি দাঁড়াবে নিম্নরূপ:
১. মোট প্রাপ্য: ৭৪,৪০০ টাকার ৯০% = ৬৬,৯৬০ টাকা। ২. মাসিক পেনশন: এই অর্থের অর্ধেক অর্থাৎ (৬৬,৯৬০ ÷ ২) = ৩৩,৪৮০ টাকা।
অর্থাৎ, শুধুমাত্র মূল মাসিক পেনশন হিসেবেই তিনি পাবেন ৩৩,৪৮০ টাকা। তবে এর সঙ্গে যুক্ত হবে চিকিৎসা ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা।
চিকিৎসা ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা শুধুমাত্র মূল পেনশনই নয়, অবসরের পর জীবনযাত্রার মান বজায় রাখতে সরকার চিকিৎসা ভাতার ব্যবস্থাও রেখেছে।
চিকিৎসা ভাতা: ৬৫ বছরের কম বয়সী পেনশনারদের জন্য মাসিক ১,৫০০ টাকা এবং ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে হলে মাসিক ২,৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা প্রদান করা হয়।
উৎসব ভাতা: বাংলা নববর্ষ এবং দুই ঈদে মূল পেনশনের সমপরিমাণ বা নির্ধারিত হারে উৎসব ভাতাও প্রাপ্য হন তারা।
ফলে, চিকিৎসা ভাতার ৩,০০০ টাকা (বয়সভেদে কম-বেশি) যোগ করলে মাস শেষে একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিবের হাতে আসা অর্থের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।
এককালীন প্রাপ্তি (গ্র্যাচুইটি) মাসিক পেনশনের বাইরেও বড় একটি অংক এককালীন বা গ্র্যাচুইটি হিসেবে পাওয়া যায়। প্রতি ১ টাকার বিপরীতে নির্দিষ্ট হারে (যেমন ২৩০ টাকা বা তার বেশি, যা চাকরির মেয়াদের ওপর নির্ভর করে) এই টাকা হিসাব করা হয়। ফলে অবসরের পরপরই একজন সচিব প্রায় কোটি টাকার কাছাকাছি বা তার বেশি এককালীন অর্থ পেতে পারেন।
নীতিমালা ও ভবিষ্যৎ পরিবর্তন এই হিসাবটি মূলত জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫-এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি। তবে পেনশনের চূড়ান্ত পরিমাণ নির্ধারণের জন্য সরকারি সর্বশেষ গেজেট এবং চাকরির মোট মেয়াদকাল (Length of Service) বিবেচনায় নেওয়া হয়। ভবিষ্যতে সরকার যদি নতুন পে-স্কেল (যেমন ৯ম পে-স্কেল) ঘোষণা করে, তবে এই অংক আনুপাতিক হারে আরও বৃদ্ধি পাবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, একজন সচিবের পেনশন ও আনুতোষিক সুবিধা শুধুমাত্র একটি গাণিতিক হিসাব নয়, বরং দীর্ঘ কর্মজীবনের স্বীকৃতি। তবে গ্রেড ও ধাপ অনুযায়ী টাকার পরিমাণে সামান্য তারতম্য হতে পারে।
বিভিন্ন গ্রেডের বিসিএস কর্মকর্তাদের পেনশন তালিকা
বিসিএস কর্মকর্তাদের (ক্যাডার) পেনশন মূলত নির্ধারিত হয় তারা কোন গ্রেড থেকে এবং কত টাকা মূল বেতনে অবসরে যাচ্ছেন তার ওপর। সাধারণত একজন কর্মকর্তা চাকরির শেষ পর্যায়ে তার গ্রেডের সর্বোচ্চ ধাপে (Highest Step) বা এর কাছাকাছি বেতনে পৌঁছান।
নিচে জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫ অনুযায়ী বিভিন্ন গ্রেডের কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ মূল বেতনের ভিত্তিতে আনুমানিক মাসিক পেনশনের একটি তালিকা দেওয়া হলো।
গণনার সূত্র: (শেষ মূল বেতন × ৯০%) ÷ ২ = মাসিক নিট পেনশন।
এর সাথে চিকিৎসা ভাতা ১,৫০০ টাকা (৬৫ বছরের নিচে) যোগ করে মোট মাসিক প্রাপ্য দেখানো হয়েছে।
বিসিএস কর্মকর্তাদের গ্রেডভিত্তিক আনুমানিক মাসিক পেনশন তালিকা
| পদমর্যাদা ও গ্রেড (উদাহরণ) | গ্রেডের সর্বোচ্চ মূল বেতন (আনুমানিক) | মাসিক নিট পেনশন (মূল) | চিকিৎসা ভাতা সহ মোট মাসিক প্রাপ্তি |
| গ্রেড-১ (সচিব/সিনিয়র সচিব) | ৭৮,০০০ টাকা (ফিক্সড) | ৩৫,১০০ টাকা | ৩৬,৬০০ টাকা |
| গ্রেড-২ (অতিরিক্ত সচিব) | ৭৬,৪৯০ টাকা | ৩৪,৪২০ টাকা | ৩৫,৯২০ টাকা |
| গ্রেড-৩ (যুগ্ম সচিব) | ৭৪,৪০০ টাকা | ৩৩,৪৮০ টাকা | ৩৪,৯৮০ টাকা |
| গ্রেড-৪ (উপ-সচিব) | ৭১,২০০ টাকা | ৩২,০৪০ টাকা | ৩৩,৫৪০ টাকা |
| গ্রেড-৫ (সিনিয়র সহকারী সচিব) | ৬৯,৮৫০ টাকা | ৩১,৪৩৩ টাকা | ৩২,৯৩৩ টাকা |
| গ্রেড-৬ (সহকারী সচিব/অন্যান্য) | ৬৭,০১০ টাকা | ৩০,১৫৫ টাকা | ৩১,৬৫৫ টাকা |
| গ্রেড-৯ (এন্ট্রি লেভেল ক্যাডার) | ৫৩,০৬০ টাকা | ২৩,৮৭৭ টাকা | ২৫,৩৭৭ টাকা |
(বি:দ্র: গ্রেড-৯ এ সাধারণত কেউ অবসরে যান না, তবে স্কেলের সর্বোচ্চ সীমা বোঝার জন্য এটি দেওয়া হলো। একজন কর্মকর্তা সাধারণত পদোন্নতি পেয়ে উপরের গ্রেডগুলোতে গিয়ে অবসরে যান।
এই তালিকার সাথে আরও যা প্রাপ্য হবেন:
১. এককালীন গ্র্যাচুইটি (Gratuity):
উপরের টেবিলে যে মাসিক পেনশন দেখানো হয়েছে, সেটি মোট পেনশনের মাত্র ৫০%। বাকি ৫০% সরকার কিনে নেয় (সমর্পণ), যার বিনিময়ে কর্মকর্তা এককালীন বিশাল অংকের টাকা পান।
প্রতি ১ টাকার বিনিময়ে বর্তমানে ২৩০ টাকা (চাকরির মেয়াদ ২০ বছর বা তার বেশি হলে) পাওয়া যায়।
উদাহরণ: গ্রেড-১ এর একজন কর্মকর্তার এককালীন প্রাপ্তি প্রায় ৮০ লাখ টাকার বেশি হতে পারে।
২. চিকিৎসা ভাতা:
৬৫ বছরের কম বয়স পর্যন্ত: ১,৫০০ টাকা (তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে)।
৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে: ২,৫০০ টাকা।
৩. উৎসব ভাতা:
প্রতি বছর দুটি ঈদে এবং বাংলা নববর্ষে মূল পেনশনের সমপরিমাণ বা নির্ধারিত হারে বোনাস পাবেন।
সতর্কীকরণ:
এই হিসাবটি জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫-এর সর্বোচ্চ সীমার ওপর ভিত্তি করে তৈরি। চাকরির মেয়াদ কম হলে বা পেনশনের সময় মূল বেতন কম থাকলে এই অংক কিছুটা কম হতে পারে। সঠিক হিসাবের জন্য কর্মকর্তার শেষ পে-স্লিপ এবং সার্ভিস বুকের তথ্য প্রয়োজন।


