মাতৃত্বকালীন ভাতা (গর্ভবতী ভাতা): আবেদন পদ্ধতি ও বিস্তারিত নিয়মাবলী
বাংলাদেশ সরকার দেশের দরিদ্র ও অসহায় গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টির অভাব দূর করতে এবং স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে ‘মাতৃত্বকালীন ভাতা’ (বর্তমানে যা ‘মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি’র অন্তর্ভুক্ত) প্রদান করে থাকে। আপনি যদি এই ভাতার যোগ্য হন, তবে ঘরে বসেই অনলাইনে বা সরাসরি ইউনিয়ন পরিষদে যোগাযোগ করে আবেদন করতে পারেন।
মাতৃত্বকালীন ভাতা পাওয়ার প্রধান শর্তসমূহ
এই ভাতা পেতে হলে আবেদনকারীকে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়:
গর্ভকাল: আবেদন করার সময় অবশ্যই গর্ভবতী হতে হবে। এটি প্রথম বা দ্বিতীয় গর্ভধারণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
বয়স: মায়ের বয়স কমপক্ষে ২০ বছর হতে হবে।
আর্থিক অবস্থা: পরিবারের মাসিক আয় ১৫০০ টাকার নিচে হতে হবে।
সম্পত্তি: নিজস্ব কোনো কৃষি জমি বা মৎস্য চাষের পুকুর থাকা যাবে না (কেবল বসতবাড়ি থাকতে পারে)।
বিশেষ অগ্রাধিকার: দরিদ্র প্রতিবন্ধী মায়েরা এই ভাতার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন।
ভাতার পরিমাণ ও সময়কাল
মাসিক ভাতা: প্রতি মাসে ৮০০ টাকা।
প্রদানের নিয়ম: সাধারণত প্রতি ৬ মাস অন্তর ৪৮০০ টাকা করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের (বিকাশ/নগদ/রকেট) মাধ্যমে পাঠানো হয়।
মোট সময়কাল: প্রথম বা দ্বিতীয় সন্তানের ক্ষেত্রে ২৪ মাস (২ বছর) পর্যন্ত এই সুবিধা পাওয়া যায়। মোট ভাতার পরিমাণ ১৯,২০০ টাকা।
বিশেষ ক্ষেত্রে: বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে ৩৬ মাস পর্যন্ত ভাতা পাওয়া যেতে পারে।
আবেদন করতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করার আগে নিচের ডকুমেন্টগুলো গুছিয়ে রাখুন:
আবেদনকারীর পাসপোর্ট সাইজের ২ কপি ছবি।
জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) বা জন্ম নিবন্ধন সনদ।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত গর্ভকালীন সনদ।
টিকা কার্ডের কপি।
নাগরিকত্ব সনদ (চেয়ারম্যান/মেয়র কর্তৃক)।
টাকা গ্রহণের জন্য নিজের নামে নিবন্ধিত একটি মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর (বিকাশ/নগদ/রকেট ইত্যাদি)।
অনলাইনে আবেদন করার নিয়ম (ধাপে ধাপে)
বর্তমানে সরকার এই প্রক্রিয়াকে ডিজিটাল করেছে। আবেদন করতে নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করুন:
ওয়েবসাইট: অনলাইন রেজিস্ট্রেশন লিঙ্ক
ধাপ ১ (ব্যক্তিগত তথ্য): সাইটে গিয়ে আপনার এনআইডি (NID) নম্বর ও জন্ম তারিখ দিন। নাম, পিতা-মাতার নাম ও অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্য সঠিকভাবে পূরণ করুন।
ধাপ ২ (ঠিকানা): বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা সঠিকভাবে লিখুন।
ধাপ ৩ (আর্থ-সামাজিক তথ্য): এখানে আপনার পরিবারের আয়, বসতবাড়ি এবং জমির তথ্য দিন। মনে রাখবেন, আয়ের পরিমাণ ১৫০০ টাকার নিচে হলে নির্বাচনের সম্ভাবনা বেশি থাকে।
ধাপ ৪ (পেমেন্ট তথ্য): আপনি যে মাধ্যমে টাকা নিতে চান (যেমন: বিকাশ বা নগদ) সেটি সিলেক্ট করুন এবং সঠিক মোবাইল নম্বর দিন।
ধাপ ৫ (ছবি ও স্বাক্ষর): আপনার পাসপোর্ট সাইজের ছবি এবং একটি সাদা কাগজে করা স্বাক্ষর আপলোড করুন।
সবশেষে তথ্যগুলো পুনরায় যাচাই করে ‘সংরক্ষণ করুন’ বাটনে ক্লিক করে আবেদনটি জমা দিন এবং কপিটি প্রিন্ট করে রাখুন।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য
আবেদনের সময়: প্রতি মাসের ১ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে সাধারণত আবেদন গ্রহণ করা হয়।
যাচাই-বাছাই: অনলাইনে আবেদন করার পর আপনার দেওয়া তথ্যগুলো মাঠ পর্যায়ে যাচাই করা হবে। তথ্য ভুল প্রমাণিত হলে আবেদন বাতিল হয়ে যাবে।
সহযোগিতা: কোনো সমস্যা হলে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয়ে যোগাযোগ করুন।

দেশে মোট কত লক্ষ মহিলা বর্তমানে এ ভাতা পাচ্ছেন?
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ১৫ লাখের বেশি মা এই ভাতার অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন এবং আগামী অর্থবছরের বাজেটে এই সংখ্যা আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
সরকারের বিভিন্ন প্রতিবেদন ও সাম্প্রতিক বাজেট (২০২৪-২৫ এবং ২০২৫-২৬ এর প্রস্তাবনা) থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বর্তমান চিত্রটি নিচে দেওয়া হলো:
বর্তমান সুবিধাভোগী: বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ১৫ লাখ ৪৫ হাজার থেকে ১৬ লাখ ৫৫ হাজার জন নারী ‘মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি’-র (যা পূর্বে মাতৃত্বকালীন ভাতা ও ল্যাকটেটিং মাদার ভাতা ছিল) আওতায় রয়েছেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এই সংখ্যা বাড়িয়ে ১৭ লাখ ৭১ হাজার জনে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য: সরকারের জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে দেশের ০ থেকে ৪ বছর বয়সী মোট শিশুর প্রায় ৫০ শতাংশ বা প্রায় ৬৫ লক্ষ শিশুকে এই কর্মসূচির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সুবিধার আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে।
সংক্ষেপে: বর্তমানে প্রায় ১৫.৫ লক্ষ থেকে ১৬.৫ লক্ষ নারী সরাসরি এই ভাতা পাচ্ছেন।



