উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমির নামজারিতে নতুন নিয়ম: বণ্টননামা ছাড়াই করা যাবে ‘যৌথ খতিয়ান’
উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমি বা স্থাবর সম্পত্তির নামজারি (মিউটেশন) নিয়ে সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের ভোগান্তি লাঘবে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। গত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে জারি করা এক বিশেষ পরিপত্রের মাধ্যমে জানানো হয়েছে, এখন থেকে রেজিস্টার্ড বণ্টননামা দলিল ছাড়াই উত্তরাধিকারীরা যৌথভাবে নামজারি বা খতিয়ান সংশোধন করতে পারবেন।
কী আছে নতুন এই নির্দেশনায়?
ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এস এম সালেহ আহমেদ স্বাক্ষরিত এই পরিপত্রে মূলত দুটি বিষয় স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে:
১. বণ্টননামা ছাড়াই যৌথ নামজারি: মৃত ব্যক্তির সকল ওয়ারিশ যদি একটি খতিয়ানে নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে চান (জমাভাগ ছাড়া), তবে তাদের আর রেজিস্টার্ড বণ্টননামা দলিলের প্রয়োজন হবে না। এক্ষেত্রে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র বা সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর প্রদত্ত ‘ওয়ারিশন সনদ’ দাখিল করলেই সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রত্যেকের প্রাপ্য হিস্যা উল্লেখ করে যৌথ খতিয়ান সৃজন করে দেবেন।
২. পৃথক খতিয়ানের ক্ষেত্রে শর্ত: তবে ওয়ারিশগণ যদি নিজেদের অংশ আলাদা করে (জমাভাগ করে) পৃথক পৃথক খতিয়ান তৈরি করতে চান এবং আলাদাভাবে ভূমি উন্নয়ন কর দিতে চান, তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই বিধি মোতাবেক একটি আপস বণ্টননামা দলিল সম্পাদন করে তা রেজিস্ট্রি করতে হবে।
কেন এই উদ্যোগ?
মন্ত্রণালয় লক্ষ্য করেছে যে, অনেক ক্ষেত্রে ওয়ারিশদের কেউ বিদেশে থাকা, শারীরিক অসুস্থতা বা পারিবারিক দূরত্বের কারণে সবার উপস্থিতিতে বণ্টননামা দলিল করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এছাড়া রেজিস্ট্রি দলিলের মোটা অংকের খরচ মেটাতেও হিমশিম খান সাধারণ নাগরিকরা। এই জটিলতার কারণে অনেক সময় বৈধ ওয়ারিশ হওয়া সত্ত্বেও মানুষ তাদের সম্পত্তি বিক্রি বা বন্ধক রাখতে পারছিলেন না। নাগরিকদের এই হয়রানি বন্ধ করতেই এই স্পষ্টীকরণ জারি করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত
ভূমি বিশেষজ্ঞরা এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে বলছেন, এর ফলে জমির মালিকানা সংক্রান্ত দীর্ঘসূত্রিতা কমবে। বিশেষ করে ই-নামজারি প্রক্রিয়া আরও সহজ ও জনবান্ধব হবে। এর ফলে উত্তরাধিকারীরা দ্রুততম সময়ে তাদের অংশ নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় দাপ্তরিক কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন।
নাগরিকদের জন্য করণীয়:
যারা যৌথভাবে নামজারি করতে চান, তাদের প্রয়োজনীয় ওয়ারিশন সনদ এবং প্রাসঙ্গিক কাগজপত্রসহ স্থানীয় সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে আবেদন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পরিপত্রে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, বণ্টননামা দলিল নেই—এই অজুহাতে কোনোভাবেই ওয়ারিশদের যৌথ নামজারির আবেদন প্রত্যাখ্যান করা যাবে না।

বন্টননামা ছাড়া কি জমি বিক্রি করা যাবে?
হ্যাঁ, বণ্টননামা ছাড়াও জমি বিক্রি করা সম্ভব, তবে সেটি কিছু নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের নতুন পরিপত্র এবং প্রচলিত ভূমি আইন অনুযায়ী বিষয়টি নিচে সহজভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:
১. যৌথ খতিয়ান থাকলে বিক্রি সম্ভব
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এর পরিপত্র অনুযায়ী, আপনারা যদি সকল ওয়ারিশ মিলে বণ্টননামা ছাড়াই একটি যৌথ খতিয়ান (যেখানে সবার নাম ও কার কতটুকু অংশ তা উল্লেখ আছে) তৈরি করে নেন, তবে আপনি আপনার অংশ বিক্রি করতে পারবেন।
২. ক্রেতার ঝুঁকি ও সম্মতি
বণ্টননামা না থাকলে জমির সীমানা (অর্থাৎ আপনি কোন পাশ থেকে জমি বিক্রি করছেন) সুনির্দিষ্ট থাকে না। আপনি শুধু আপনার ‘অবিভক্ত হিস্যা’ বা অংশ বিক্রি করছেন। এক্ষেত্রে:
ক্রেতাকে বোঝাতে হবে যে তিনি একটি যৌথ খতিয়ানের অংশ কিনছেন।
পরবর্তীতে জমি দখলে নিতে বা সীমানা চিহ্নিত করতে ক্রেতাকে অন্য ওয়ারিশদের সাথে আপস করতে হবে অথবা ‘বাটোয়ারা মামলা’ করতে হতে পারে।
অনেক ক্রেতা ঝামেলার ভয়ে বণ্টননামা ছাড়া জমি কিনতে চান না।
৩. দাগ নম্বর ও দখল সংক্রান্ত জটিলতা
যদি জমিটি অনেকগুলো দাগে (Plot) থাকে এবং আপনি সুনির্দিষ্ট কোনো একটি দাগের নির্দিষ্ট অংশ বিক্রি করতে চান, তবে বণ্টননামা দলিল থাকা আবশ্যক। বণ্টননামা ছাড়া আপনি আইনগতভাবে বলতে পারেন না যে “আমি উত্তর পাশের এই অংশটিই বিক্রি করছি”। আপনি কেবল আপনার মোট শতাংশের মালিকানা হস্তান্তর করতে পারেন।
৪. আমমোক্তারনামা (Power of Attorney)
যদি কোনো ওয়ারিশ বিদেশে থাকে বা সরাসরি উপস্থিত হতে না পারে, তবে তিনি অন্য কাউকে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দিয়ে দিলে বণ্টননামা দলিল করা সহজ হয়। আর বণ্টননামা দলিল হয়ে গেলে জমি বিক্রি করা এবং ভালো দাম পাওয়া অনেক সহজ হয়ে যায়।
সারসংক্ষেপ: আপনি যদি আপনার অংশ বিক্রি করতে চান এবং ক্রেতা রাজি থাকে, তবে নতুন পরিপত্র অনুযায়ী যৌথ নামজারি খতিয়ান ব্যবহার করেই আপনি বিক্রয় দলিল সম্পাদন করতে পারবেন। এক্ষেত্রে অন্য ওয়ারিশদের কোনো বাধা দেওয়ার আইনি সুযোগ নেই যদি আপনি আপনার প্রাপ্য অংশের বেশি বিক্রি না করেন।


