৬ সদস্যের সংসার চালাতে হিমশিম ২০২৫ । সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার টাকা বেতনের দাবিতে সরকারি কর্মচারীরা?
দ্রুত ১:৪ বেতন কাঠামো কার্যকরের দাবি- নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আকাশছোঁয়া দামের কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায়, নিম্ন গ্রেডের সরকারি কর্মচারীদের ৬ সদস্যের সংসার চালাতে এখন চরম সংকটে পড়েছেন। বর্তমান মাসিক বেতন-ভাতা দিয়ে পরিবার পরিজনের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মচারীরা সর্বনিম্ন মাসিক বেতন ৩৫,০০০ টাকা নির্ধারণ এবং দ্রুত ১:৪ বেতন কাঠামো কার্যকরের জোর দাবি জানিয়েছেন।
ভাত-ডালের হিসাবেই টান, বাকি খরচ মেটাবে কে?
জীবনযাত্রার ব্যয়ের একটি সরল হিসাবেই কর্মচারীদের অসহায়ত্বের চিত্রটি ফুটে উঠেছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ৬ সদস্যের একটি পরিবারের শুধু ডাল, ভাত ও আলুভর্তার খরচ মেটাতেই মাসে প্রায় ২৭,০০০ টাকা খরচ হচ্ছে।
খরচের হিসাবটি নিম্নরূপ:
- প্রতি বেলা খাবারের খরচ: ৫০ টাকা (ডাল, ভাত, আলুভর্তা)
- এক দিনে তিন বেলার খরচ: টাকা
- ৩০ দিনের মোট খরচ: টাকা (প্রতিজনের)
- ৬ জন সদস্যের মোট খরচ: টাকা (শুধু ভাত, ডাল, ভর্তার জন্য)
অর্থাৎ, সর্বনিম্ন মূল বেতন যা বর্তমানে আছে, তা দিয়ে কেবল ভাত-ডাল-ভর্তার খরচ মেটানোর পরেও বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা, সন্তানের শিক্ষা, পোশাক ও অন্যান্য জরুরি সামগ্রীর খরচ মেটানোর মতো অর্থ থাকছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মচারী আক্ষেপ করে বলেন, “আমাদের মাসিক বেতন যা, তা দিয়ে ছয়জনের পরিবারের শুধু ডাল-ভাতের খরচ মেটাতে গিয়েই হাত খালি হয়ে যাচ্ছে। বাকি যে খরচ, তা কী করে সামলাবো?”
বেতন বৈষম্য নিরসনের দাবি
সরকারি কর্মচারীদের দাবি, বর্তমান বাজারে টিকে থাকতে হলে সর্বনিম্ন মূল বেতন ৩৫,০০০ টাকা করা জরুরি। এছাড়া, বেতন কাঠামোর সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গ্রেডের বেতনের অনুপাত ১:৪ হওয়া উচিত। অর্থাৎ, সর্বোচ্চ গ্রেডের মূল বেতন যদি ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা হয়, তাহলে সর্বনিম্ন গ্রেডের বেতন অন্তত ৩৫ হাজার টাকা করতে হবে।
কর্মচারী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দীর্ঘ ১০ বছর পর নতুন বেতন কমিশন গঠিত হলেও তা দ্রুত বাস্তবায়নের কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। তারা মনে করছেন, বিদ্যমান বেতন বৈষম্য তাদের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলছে। অবিলম্বে নতুন পে স্কেল বাস্তবায়ন করে তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হোক। দ্রুত এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত না নিলে, পরিবার নিয়ে রাস্তায় নামা ছাড়া তাদের কোনো উপায় থাকবে না বলেও তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
ঢাকায় ৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিবারের মাসিক খরচ কত হবে, তা নির্ভর করে জীবনযাত্রার মান, বাসস্থান, শিক্ষা এবং খাদ্যাভ্যাসের উপর। তবে বর্তমান বাজারদর (২০২৪-২০২৫) এবং বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে একটি মোটামুটি ধারণা নিচে দেওয়া হলো:
৬ সদস্যের পরিবারের মাসিক খরচের সম্ভাব্য হিসাব (ঢাকায়)
ঢাকায় একটি ৬ সদস্যের (২ জন প্রাপ্তবয়স্ক ও ৪ জন শিশু/কিশোর অথবা ৪ জন প্রাপ্তবয়স্ক ও ২ জন শিশু) পরিবারের জন্য ন্যূনতম ও মধ্যম মানের জীবনযাত্রার জন্য মাসিক খরচ দুটি ভিন্ন পরিসরে বিবেচনা করা যেতে পারে:
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ:
১. বাসস্থান (বাড়ি ভাড়া): এটি সবচেয়ে বড় খরচ। ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা বা তুলনামূলক দূরবর্তী টিনশেড বা ছোট ফ্ল্যাটের ভাড়া কম হলেও, ধানমন্ডি, গুলশান, বারিধারা, উত্তরায় ভালো মানের ফ্ল্যাটের ভাড়া অনেক বেশি হবে। ২. খাদ্য খরচ: আপনার দেওয়া হিসাবে শুধু ডাল-ভাত-ভর্তার খরচ ২৭,০০০ টাকা হলেও, একটি ৬ সদস্যের পরিবারের সুষম খাদ্যের (মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ফল, সবজি) জন্য মাসিক ২৫,০০০ থেকে ৪৫,০০০ টাকা লাগতে পারে। ৩. শিক্ষা ব্যয়: সন্তানরা যদি ভালো মানের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ে, তবে শিক্ষা খাতে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকার বেশিও খরচ হতে পারে। ৪. সঞ্চয়: এই হিসাবে সঞ্চয় বা আপদকালীন তহবিলের জন্য কোনো বড় অর্থ রাখা হয়নি। স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে গেলে মাসিক খরচের পাশাপাশি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা সঞ্চয় করা আবশ্যক।
সংক্ষেপে বলা যায়, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বর্তমানে কমপক্ষে ৬০,০০০ থেকে ৭০,০০০ টাকা না হলে ৬ সদস্যের একটি পরিবার ঢাকায় খুব কষ্টে চলতে পারে, যেখানে বাড়ি ভাড়া অপেক্ষাকৃত কম এবং খাদ্যে আপস করতে হয়। আর যদি স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ মধ্যবিত্ত জীবনযাপন করতে চান, তবে মাসিক ১,০০,০০০ টাকা থেকে ১,৫০,০০০+ টাকা প্রয়োজন হতে পারে।
সরকারি কর্মচারীরা মূলত বৈষম্যহীন ও ন্যায্য একটি নতুন বেতন কাঠামো চান, যা বর্তমান বাজারদরের সাথে সংগতিপূর্ণ হবে। তাদের প্রধান দাবি এবং প্রস্তাবগুলো নিম্নরূপ:
১. মূল দাবি: ১:৪ বেতন কাঠামো এবং সর্বনিম্ন বেতন ৩৫,০০০ টাকা
- বেতন অনুপাত: সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত ১:৪ নির্ধারণ করে নতুন পে স্কেল কার্যকর করা।
- অনেক ফোরাম সর্বোচ্চ বেতন ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা এবং সর্বনিম্ন বেতন ৩২ হাজার টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছে (যা ১:৪ অনুপাতের কাছাকাছি)। আপনার প্রশ্নে উল্লেখিত ৩৫,০০০ টাকা সর্বনিম্ন বেতন করার দাবিও অত্যন্ত জোরালো।
- দ্রুত বাস্তবায়ন: দ্রুত নবম জাতীয় বেতন স্কেল বা নতুন পে স্কেল কার্যকর করা। অনেক কর্মচারী সংগঠন আগামী ৩১ ডিসেম্বরের (২০২৫) মধ্যে এটি বাস্তবায়নের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন।
২. গ্রেড ও কাঠামো পরিবর্তন
- গ্রেড সংখ্যা হ্রাস: বর্তমানে থাকা ২০টি গ্রেড ভেঙে ১২ থেকে ১৫টি গ্রেডে বেতন কাঠামো পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মাধ্যমে গ্রেড বৈষম্য ও পদোন্নতির জটিলতা কমানো লক্ষ্য।
- টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল: ২০১৫ সালের পে স্কেলে বাতিল হওয়া টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল করার দাবি জানানো হয়েছে।
৩. ভাতা বৃদ্ধি ও পুনর্নির্ধারণ
মূল বেতনের পাশাপাশি জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন ভাতা বৃদ্ধির দাবি জানানো হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
৪. অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দাবি
- পেনশন সুবিধা: গ্র্যাচুইটির (আনুতোষিক) হার ২৩০ টাকার পরিবর্তে ৫০০ টাকা করা এবং শতভাগ পেনশন প্রবর্তন করা।
- বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট): বর্তমান ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ করা।
- এক ও অভিন্ন নিয়োগবিধি: সকল দপ্তরের কর্মচারীদের জন্য এক ও অভিন্ন নিয়োগবিধি প্রণয়ন করা এবং নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের পদবি/পদনাম পরিবর্তন করে পদোন্নতির সুযোগ বাড়ানো।
মোটকথা, সরকারি কর্মচারীরা এমন একটি বেতন কাঠামো চান যা বাজারে টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট আর্থিক নিরাপত্তা দেবে এবং বিদ্যমান বেতন বৈষম্য দূর করবে।
বর্তমানে নবম জাতীয় পে স্কেল নিয়ে সরকারি কর্মচারীদের পক্ষ থেকে যেসব দাবি ও প্রস্তাবনা এসেছে, তার ওপর ভিত্তি করে একটি প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো (নমুনা) তৈরি করা হলো। এটি কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠনের সম্মিলিত দাবির ভিত্তিতে তৈরি, চূড়ান্ত সরকারি ঘোষণা নয়।
এই কাঠামোতে মূলত দুটি প্রধান পরিবর্তন প্রস্তাব করা হয়েছে: ক. গ্রেড সংখ্যা হ্রাস এবং খ. সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত ১:৪ বা ১:৬ (এখানে ১:৪ অনুপাত ধরে দেখানো হলো)।
সরকারি কর্মচারীদের প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো (নমুনা)
(নবম জাতীয় পে স্কেলের জন্য ১১-২০ গ্রেড সরকারি কর্মচারী ফোরাম এবং অন্যান্য সংগঠনের প্রস্তাবিত দাবির ভিত্তিতে)
১. মূল বেতনের কাঠামো
কর্মচারী সংগঠনগুলো বিদ্যমান ২০টি গ্রেড ভেঙে গ্রেড সংখ্যা কমানোর এবং সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত ১:৪ বা ১:৬ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে। এখানে ১৩টি গ্রেড (প্রস্তাবিত) এবং সর্বনিম্ন মূল বেতন ৩৫,০০০ টাকা (আপনার দাবিকৃত) ও সর্বোচ্চ মূল বেতন ১,৪০,০০০ টাকা (১:৪ অনুপাত ধরে) বিবেচনা করা হলো:
২. প্রস্তাবিত ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা
৩. কর্মজীবনের অন্যান্য সুবিধা
- টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড: অবিলম্বে পুনর্বহাল করা।
- এক ও অভিন্ন নিয়োগবিধি: সকল দপ্তর ও অধিদপ্তরে একই নিয়োগবিধি প্রণয়ন করা এবং ব্লক পোস্ট বাতিল করে নিয়মিত পদোন্নতির ব্যবস্থা করা।
রেশন সুবিধা: সরকারি কর্মচারীদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা চালু করা।