ঈদ বোনাস I নববর্ষ । দূর্গাপূজা

বৈষম্য ভাঙার ডাক ২০২৫ । উৎসব ভাতা হোক সবার সমান, চাই আনন্দময় সমতা?

উৎসব মানে আনন্দ, আর সেই আনন্দের মূল ভিত্তি যদি হয় অর্থনৈতিক সমতা, তবেই তা হয়ে ওঠে সর্বজনীন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দেশের ছোট-বড় সকল চাকরিজীবীর জন্য ঈদ বোনাস এবং বৈশাখী ভাতা-র পরিমাণে যে সুস্পষ্ট বৈষম্য বিদ্যমান, তা উৎসবের আনন্দকেও ম্লান করে দিচ্ছে। একই বাজারে সবাই কেনাকাটা করলেও, বেতনের স্কেল অনুযায়ী ভাতার ভিন্নতা তৈরি করেছে এক গভীর উৎসব বৈষম্য। এই বৈষম্য ভাঙার জোরালো দাবি উঠেছে সাধারণ চাকরিজীবীদের পক্ষ থেকে।

এক বাজার, দুই বাস্তবতা

সাধারণ মানুষ বলছেন, একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা কর্মচারী যেই বাজার থেকে কোরবানির গরু কেনেন কিংবা ঈদের বাজার সারেন, একজন নিম্নপদস্থ কর্মচারীও সেই একই বাজারে যান। দেশের কোথাও স্কেল অনুযায়ী আলাদা বাজারের ব্যবস্থা নেই, যেখানে কম দামে পণ্য পাওয়া যায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বাজারের এই একরৈখিক পরিস্থিতিতে, কম বেতনের কর্মচারী তার অল্প অঙ্কের উৎসব ভাতা দিয়ে পরিবারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।

‘আনন্দ সামন সমান’—এই যুক্তিতে সাধারণ চাকরিজীবীরা বলছেন, যেহেতু সবার জন্য বাজার এক, তাই উৎসব ভাতা সবার জন্য সমান হতে হবে। যদি উচ্চ বেতন স্কেলের ব্যক্তি মূল বেতনের সমান বোনাস পান, তবে নিম্ন বেতন স্কেলের ব্যক্তিকেও আনন্দের সমতা নিশ্চিত করতে ন্যূনতম একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের সমান ভাতা দেওয়া উচিত, যা দিয়ে উৎসবের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়।

‘আনন্দ’ নয়, ‘চাপ’ তৈরি করছে বৈষম্য

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সরকারি কর্মচারী হতাশার সাথে বলেন, “আমার মূল বেতনের ওপর ভিত্তি করে বোনাস আসে, যা দিয়ে ঈদের সময় কিছুই কিনতে পারি না। আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বোনাস পান। আমরা তো একই বাজারে যাচ্ছি। এই বৈষম্য উৎসবের আনন্দ না দিয়ে বরং মানসিক চাপ তৈরি করে।” বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষক-কর্মচারীও একই ধরনের বৈষম্যের শিকার। তারা মূল বেতনের তুলনায় অনেক কম হারে উৎসব ভাতা পান।

অন্যদিকে, পহেলা বৈশাখের মতো সর্বজনীন উৎসবের জন্য চালু হওয়া বৈশাখী ভাতার ক্ষেত্রেও একই বৈষম্য লক্ষ্যণীয়। মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বৈশাখী ভাতা পেলেও, বেতনের স্কেল ছোট হওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের বৈশাখী ভাতা নামমাত্র হয়ে দাঁড়ায়। উৎসবের সর্বজনীনতা বজায় রাখতে এই ভাতা স্কেলের ভিত্তিতে না হয়ে একটি ফ্ল্যাট রেটে বা সবার জন্য ন্যূনতম একটি মানসম্মত অঙ্কে নির্ধারণের দাবি উঠেছে।

এই উৎসব বৈষম্য কেবল আর্থিক তারতম্য নয়, এটি সামাজিক ও মানসিক সমতার ক্ষেত্রেও প্রশ্ন তুলছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এই বৈষম্য নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সর্বস্তরের চাকরিজীবীরা, যাতে দেশের প্রতিটি ঘরে উৎসবের আনন্দ সত্যিকার অর্থেই সমান হতে পারে।

নিঃসন্দেহে আপনার পর্যবেক্ষণটি বাংলাদেশের নিম্ন গ্রেডের চাকরিজীবীদের জন্য একটি কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরেছে। মূল বেতনের সমপরিমাণ বোনাস নীতিগতভাবে শুনতে ভালো লাগলেও, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং উৎসবের বাড়তি খরচের বাজারে এটি নিম্ন আয়ের কর্মীদের জন্য কোনো কার্যকর সুবিধা নয়, বরং এক ধরনের উৎসবের বৈষম্য তৈরি করে।

১. ‘মূল বেতনের সমান’ বোনাসের ফাঁক

বাংলাদেশে উৎসব ভাতা বা বোনাস সাধারণত মূল বেতনের সমান দেওয়া হয়। কিন্তু নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীর মূল বেতনই (Basic Salary) তুলনামূলকভাবে অনেক কম

ধরুন, একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মূল বেতন ৬৫,০০০ টাকা হলে, তার বোনাস ৬৫,০০০ টাকা। অন্যদিকে, একজন অফিস সহকারীর মূল বেতন যদি ১০,০০০ টাকা হয়, তার বোনাসও হয় মাত্র ১০,০০০ টাকা। অথচ উভয়কেই একই বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করতে হয়।

  • বাজারের সমতা: বাজারে গরুর মাংস বা চালের দাম গ্রেড অনুযায়ী আলাদা হয় না। একটি মাঝারি আকারের কোরবানির পশুর ন্যূনতম দাম ৫০,০০০ থেকে ৭০,০০০ টাকা।
  • বোনাসের অসামঞ্জস্য: ১০,০০০ টাকার বোনাস দিয়ে কোনোভাবেই সেই কর্মচারী কোরবানির পশু কেনার সামর্থ্য রাখেন না। এমনকি কোরবানির পশুর একটি অংশ (ভাগ) নিতে গেলেও তার এই বোনাসের প্রায় পুরোটাই খরচ হয়ে যায়।

২. আনন্দ বনাম বিসর্জন: নিম্ন গ্রেডের কর্মীদের বাস্তবতা

আপনার কথা অনুযায়ী, এই সীমিত বোনাস নিম্ন আয়ের কর্মীদের জন্য আনন্দের চেয়ে বিসর্জনের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।

  • কোরবানি দিতে গিয়ে ত্যাগ: যদি কোনো কর্মচারী কোরবানি দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন, তবে তাকে পুরো বছরের জমানো টাকা অথবা ধার-দেনা করে সেই অর্থের সংস্থান করতে হয়। বোনাস হিসেবে পাওয়া ১০,০০০-১৫,০০০ টাকা দিয়ে তিনি শুধু কোরবানির অংশের (ভাগ) খরচ মেটাতে পারেন।
  • অন্যান্য আনন্দ বিসর্জন: কোরবানির এই খরচ মেটানোর পর তাঁর হাতে আর টাকা থাকে না। ফলে পরিবারের জন্য নতুন জামাকাপড় কেনা, শিশুদের আবদার মেটানো, বা গ্রামে যাতায়াতের মতো অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় আনন্দগুলো তিনি বিসর্জন দিতে বাধ্য হন। এই সময় উচ্চ গ্রেডের কর্মীরা যখন বিলাসবহুলভাবে উৎসব পালন করেন, তখন নিম্ন গ্রেডের কর্মীদের পরিবারে চলে নীরব হতাশা।

৩. সমাধান কী হতে পারে?

এই আর্থিক বৈষম্য দূর করে উৎসবে সবার জন্য ‘আনন্দের সমতা’ নিশ্চিত করতে হলে ভাতার নীতিমালায় পরিবর্তন আনা জরুরি।

  • ন্যূনতম ফিক্সড বোনাস (Minimum Fixed Bonus): মূল বেতনের সমান বোনাস দেওয়ার পাশাপাশি একটি ন্যূনতম ফিক্সড বোনাস নির্ধারণ করা যেতে পারে। যেমন— সকল কর্মচারীর জন্য অন্তত ২৫,০০০ টাকা অথবা ৩০,০০০ টাকা (বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে) ঈদ বোনাস নিশ্চিত করা। এর ফলে, উচ্চ গ্রেডের কর্মীরা তাদের মূল বেতনের সমান (যা ন্যূনতম ফিক্সড বোনাসের চেয়ে বেশি) বোনাস পাবেন, আর নিম্ন গ্রেডের কর্মীরা তাদের কম মূল বেতনের চেয়ে বেশি, অর্থাৎ নির্ধারিত ন্যূনতম ফিক্সড বোনাসটি পাবেন।
  • প্রান্তিক মানুষের বাজার সুবিধা: সরকারিভাবে উৎসবের আগে নিম্ন আয়ের কর্মীদের জন্য বিশেষ দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বা মাংসের ব্যবস্থা (যেমন- ওএমএস বা ফেয়ার প্রাইস শপ) করা গেলে, এই চাপ কিছুটা কমতে পারে।

এই বৈষম্য নিরসন কেবল আর্থিক সুবিচারই নয়, এটি একটি মানবিক ও সামাজিক সমতারও প্রতিফলন। আশা করা যায়, সংশ্লিষ্ট নীতি-নির্ধারকরা দ্রুতই এই বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

Alamin Mia

আমি একজন সরকারী চাকরিজীবি। দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ চাকুরির সুবাদে সরকারি চাকরি বিধি বিধান নিয়ে পড়াশুনা করছি। বিএসআর ব্লগে সরকারি আদেশ, গেজেট, প্রজ্ঞাপন ও পরিপত্র পোস্ট করা হয়। এ ব্লগের কোন পোস্ট নিয়ে প্রশ্ন থাকলে বা ব্যাখ্যা জানতে পোস্টের নিচে কমেন্ট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *