পে-স্কেল I গেজেট । প্রজ্ঞাপন । পরিপত্র

জাতীয় বেতন স্কেলের ক্রমবিকাশ: ১৯৭৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত একটি বিশ্লেষণ

বাংলাদেশ সরকারের প্রথম জাতীয় বেতন স্কেল (১ম পে-স্কেল) প্রবর্তিত হয় ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে । এরপর থেকে সরকারি কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের সাথে সঙ্গতি রেখে পর্যায়ক্রমে মোট আটটি বেতন স্কেল কার্যকর করা হয়েছে। নিচে প্রথম থেকে অষ্টম পে-স্কেল পর্যন্ত বেতনের কাঠামো এবং সময়কাল বিশ্লেষণ করা হলো:


১. প্রথম পে-স্কেল: ১৯৭৩ 🇧🇩

  • কার্যকর সময়কাল: জুলাই ১৯৭৩

  • সর্বোচ্চ স্কেল: টাকা ২,০০০.০০ (নির্ধারিত)

  • সর্বনিম্ন স্কেল (৯ম স্কেল): টাকা ১৪৫-৬-২০৫-ইবি-৭-২৭৫

দ্রষ্টব্য: প্রথম পে-স্কেলের ১, ২, ৩ এবং ৪নং স্কেলগুলো বাস্তবায়িত হয়নি


২. দ্বিতীয় পে-স্কেল: ১৯৭৭ 💰

  • কার্যকর সময়কাল: ১ জুলাই, ১৯৭৭

  • প্রবর্তক আইন: Services (Grades, Pay and Allowances) Order, 1977

  • স্কেলের সংখ্যা: ২১টি গ্রেড

  • সর্বোচ্চ স্কেল (গ্রেড I): টাকা ৩,০০০ (নির্ধারিত)

  • সর্বনিম্ন স্কেল (গ্রেড XXI): টাকা ২২৫-৬-৩১৫


৩. তৃতীয় পে-স্কেল: ১৯৮৫ 💵

  • নাম: Services (Pay and Allowances) Order, 1985

  • কার্যকর সময়কাল: ১ জুন, ১৯৮৫

  • বৈশিষ্ট্য: এটি মূলত পূর্বের বিদ্যমান New National Grade and Scale (১৯৭৭) এর Modified New Scales হিসেবে কার্যকর হয়

  • সর্বোচ্চ স্কেল (১ নং): টাকা ৬,০০০ (নির্ধারিত) (যা পূর্বের ৩০০০ টাকার বিপরীতে)

  • সর্বনিম্ন স্কেল (২০ নং): টাকা ৫০০-২০-৮৬০ (যা পূর্বের ২২৫-৬-৩১৫ এর বিপরীতে)


৪. চতুর্থ পে-স্কেল: ১৯৯১ 💸

  • কার্যকর সময়কাল: ১ জুলাই, ১৯৯১

  • সর্বোচ্চ স্কেল (১ নং): টাকা ১০,০০০ (নির্ধারিত) (যা পূর্বের ৬০০০ টাকার বিপরীতে)

  • সর্বনিম্ন স্কেল (২০ নং): টাকা ৯০০-১৮০×৩৫-১৫৩০ (যা পূর্বের ৫০০-২০-৮৬০ এর বিপরীতে)


৫. পঞ্চম পে-স্কেল: ১৯৯৭ 📈

  • কার্যকর সময়কাল: ১ জুলাই, ১৯৯৭

  • সর্বোচ্চ স্কেল (১ নং): টাকা ১৫,০০০ (নির্ধারিত) (যা পূর্বের ১০০০০ টাকার বিপরীতে)

  • সর্বনিম্ন স্কেল (২০ নং): টাকা ১৫০০-৫০×১৮-২৪০০ (যা পূর্বের ৯০০-১৮০×৩৫-১৫৩০ এর বিপরীতে)


৬. ষষ্ঠ পে-স্কেল: ২০০৫ 📊

  • কার্যকর সময়কাল: ১ জানুয়ারি, ২০০৫

  • সর্বোচ্চ স্কেল (১ নং): টাকা ২৩,০০০ (নির্ধারিত) (যা পূর্বের ১৫০০০ টাকার বিপরীতে)

  • সর্বনিম্ন স্কেল (২০ নং): টাকা ২৪০০-১০০০×৭-৩১০০-ইবি-১১০×১১-৪৩১০ (যা পূর্বের ১৫০০-৫০×১৮-২৪০০ এর বিপরীতে)


৭. সপ্তম পে-স্কেল: ২০০৯ 🧑‍💻

  • নাম: জাতীয় বেতনস্কেল ২০০৯

  • কার্যকর সময়কাল: ১ জুলাই, ২০০৯

  • সর্বোচ্চ স্কেল (গ্রেড ১): টাকা ৪০,০০০ (নির্ধারিত) (যা পূর্বের ২৩০০০ টাকার বিপরীতে)

  • সর্বনিম্ন স্কেল (গ্রেড ২০): টাকা ৪১০০-১৯০×৭-৫৪৩০-ইবি-২১০×১১-৭৭৪০ (যা পূর্বের ২৪০০-১০০০×৭-৩১০০-ইবি-১১০×১১-৪৩১০ এর বিপরীতে)


৮. অষ্টম পে-স্কেল: ২০১৫ (সরকারি কর্মচারী ও ব্যাংক/বীমা/আর্থিক প্রতিষ্ঠান) 🏦

এই পে-স্কেলে সরকারি কর্মচারী এবং ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা হয়

A. সরকারি কর্মচারী:

  • কার্যকর সময়কাল: ১ জুলাই, ২০১৫

  • গ্রেড: ২০টি (উপলব্ধ তথ্যে গ্রেড ১ থেকে ১১ পর্যন্ত উল্লেখ নেই)

  • গ্রেড ১২ (পূর্বের গ্রেড ১২, ০৯): টাকা ১১৩০০-২৭৩০০

  • গ্রেড ২০ (পূর্বের গ্রেড ২০): টাকা ৮২৫০-২০০১০

B. ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান:

  • কার্যকর সময়কাল: ১ জুলাই, ২০১৫

  • সর্বোচ্চ স্কেল (গ্রেড ১): টাকা ৭৮,০০০ (নির্ধারিত) (যা পূর্বের ৪০০০০ টাকার বিপরীতে)

  • সর্বনিম্ন স্কেল (গ্রেড ১১, ২০): টাকা ১২৫০০-৩০২৩০

১৯৭৩ থেকে ২০১৫ পে স্কেল স্ট্রাকচার বাংলাদেশ pdf File Download

প্রতি ৫ বছর পর পর কি জাতীয় বেতন কাঠামো ঘোষণা করা হয়েছে?

না, প্রতি পাঁচ বছর পর পর জাতীয় বেতন কাঠামো ঘোষণা করা হয়নি।

বাংলাদেশে সাধারণত মুদ্রাস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং সরকারি কর্মচারীদের অর্থনৈতিক অবস্থার সার্বিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে একটি নতুন বেতন স্কেল ঘোষণা করা হয়। যদিও প্রতি পাঁচ বছর পর পর নতুন বেতন কমিশন গঠনের একটি রীতি বা প্রত্যাশা রয়েছে (যেমনটি নবম পে-স্কেলের আলোচনার ক্ষেত্রেও এসেছে), তবে বাস্তবে এর সময়কাল বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন হয়েছে।


জাতীয় বেতন স্কেলের সময়কাল বিশ্লেষণ (১৯৭৩–২০১৫)

১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মোট আটটি জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষণার ক্ষেত্রে বাস্তবে যে সময় ব্যবধান দেখা যায়, তা নিম্নরূপ:

ক্রমপে-স্কেলঘোষণার বছরপূর্ববর্তী স্কেলের সঙ্গে পার্থক্য
১.প্রথম পে-স্কেল১৯৭৩(প্রথম স্কেল)
২.দ্বিতীয় পে-স্কেল১৯৭৭৪ বছর
৩.তৃতীয় পে-স্কেল১৯৮৫৮ বছর
৪.চতুর্থ পে-স্কেল১৯৯১৬ বছর
৫.পঞ্চম পে-স্কেল১৯৯৭৬ বছর
৬.ষষ্ঠ পে-স্কেল২০০৫৮ বছর
৭.সপ্তম পে-স্কেল২০০৯৪ বছর
৮.অষ্টম পে-স্কেল২০১৫৬ বছর

এই বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, বেতন কাঠামো ঘোষণার ক্ষেত্রে ৪ বছর, ৬ বছর এবং ৮ বছরের ব্যবধান ছিল। অর্থাৎ, পাঁচ বছরের চক্রটি কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়নি।

৯ম পে স্কেল এত বছর পেরিয়ে গেলেও কেন হচ্ছে না?

৮ম পে-স্কেল (২০১৫) ঘোষণার পর সাধারণত প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নতুন পে-কমিশন গঠন ও বেতন কাঠামো ঘোষণার প্রত্যাশা থাকলেও, প্রায় দশ বছর পার হয়ে গেলেও ৯ম পে-স্কেল এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। এর পেছনে প্রধানত রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উভয় ধরনের কারণ রয়েছে।


🛑 ৯ম পে-স্কেল বাস্তবায়নে বিলম্বের প্রধান কারণসমূহ

১. রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং সরকারের হস্তান্তর 🏛️

  • নির্বাচনের অপেক্ষা: অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের বক্তব্য অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারীদের নতুন পে-স্কেল দেওয়ার মতো বড় সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকার না নিয়ে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার নেবে। এটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করেছে।

  • দায়িত্ব হস্তান্তর: যদিও জাতীয় বেতন কমিশন, ২০২৫ গঠিত হয়েছে এবং তারা প্রতিবেদন তৈরির কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে, কিন্তু নতুন বেতন স্কেলের গেজেট প্রকাশ ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নতুন সরকারের উপর ছেড়ে দেওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।

২. দুর্বল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং আর্থিক চাপ 📉

  • রাজস্ব আহরণের স্থবিরতা: গত ১৭ বছরে জিডিপির আকার বড় হলেও, এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে রাজস্ব আহরণ বাড়েনি। ফলে সরকারের আর্থিক সক্ষমতা একটি নতুন, বড় আকারের পে-স্কেল ঘোষণার জন্য যথেষ্ট নয়।

  • দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি: যদিও কর্মচারীরা জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং লাগামহীন মূল্যস্ফীতির কারণে নতুন স্কেলের দাবি করছেন, কিন্তু এই মূল্যস্ফীতিই নতুন বেতন স্কেল বাস্তবায়নে সরকারের উপর আর্থিক চাপ আরও বাড়াচ্ছে।

  • কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি: সরকারি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে লাগাম টানতে না পারায় সরকারের ওপর ভর্তুকি ও অন্যান্য আর্থিক চাপ বেড়েছে, ফলে নতুন পে-স্কেল ঘোষণা করা হলে সেই চাপ আরও বাড়বে।

৩. কর্মচারীদের দাবি ও কমিশনের কার্যক্রম 📝

  • কমিশন গঠন: বিলম্ব হলেও, অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই ২০২৫-এ সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খানের নেতৃত্বে জাতীয় বেতন কমিশন, ২০২৫ গঠন করেছে।

  • দাবি-দাওয়া: কর্মচারীরা শুধু নতুন বেতন কাঠামো নয়, ২০১৫ সালের পে-স্কেল থেকে বাদ পড়া টাইম স্কেলসিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল, বেতন জ্যেষ্ঠতা ফিরিয়ে আনা, এবং বৈষম্যমুক্ত বেতন স্কেলের মতো দীর্ঘদিনের বঞ্চনা দূর করারও দাবি জানিয়েছেন। এই সমস্ত দাবি পর্যালোচনা করে সুপারিশ প্রণয়ন করতে কমিশনের সময় লাগছে।

৪. পাঁচ বছর অন্তর নিয়ম না মানা 🕰️

  • বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি পাঁচ বছর পর পর কমিশন গঠনের কথা থাকলেও, ৮ম পে-স্কেল ঘোষণার পর এরই মধ্যে ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। এই দীর্ঘসূত্রতা নিজেই একটি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা।

ফলে, ৯ম পে-স্কেল চূড়ান্ত সুপারিশের পর্যায়ে থাকলেও, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এর বাস্তবায়ন ঝুলে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

Alamin Mia

আমি একজন সরকারী চাকরিজীবি। দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ চাকুরির সুবাদে সরকারি চাকরি বিধি বিধান নিয়ে পড়াশুনা করছি। বিএসআর ব্লগে সরকারি আদেশ, গেজেট, প্রজ্ঞাপন ও পরিপত্র পোস্ট করা হয়। এ ব্লগের কোন পোস্ট নিয়ে প্রশ্ন থাকলে বা ব্যাখ্যা জানতে পোস্টের নিচে কমেন্ট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *