জীবনযাত্রার ব্যয়ের নতুন চিত্র ২০২৫ । ৬ সদস্যের পরিবারের ন্যূনতম মাসিক খরচ প্রায় ৫৯,০০০ টাকা?
সম্প্রতি মোঃ হানিফা দেওয়ান কর্তৃক প্রস্তুতকৃত একটি মাসিক পারিবারিক খরচের তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে, ৬ সদস্যের একটি পরিবারের ন্যূনতম জীবনযাত্রা বজায় রাখতে প্রতি মাসে প্রায় ৫৮,৮৫০ টাকা বা আনুমানিক ৫৯,০০০ টাকা প্রয়োজন। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার সামগ্রিক ব্যয় বৃদ্ধির এই সময়ে, এই তালিকাটি সাধারণ পরিবারের উপর আর্থিক চাপের একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরেছে।-জীবনযাত্রার ব্যয়ের নতুন চিত্র ২০২৫
দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পরিবারের সবচেয়ে বড় অংশ হলো খাবার খরচ, যার জন্য মাসে প্রায় ২৭,০০০ টাকা প্রয়োজন। এই হিসাবটি করা হয়েছে প্রতি বেলায় প্রতিজনের জন্য ৫০ টাকা ধরে (৫০ টাকা x ৩ বেলা x ৬ জন x ৩০ দিন)।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যয় হলো বাসা ভাড়া, যা একটি সাধারণ পরিবার উপযোগী বাসস্থানের জন্য ধরা হয়েছে ১২,০০০ টাকা।
অন্যান্য প্রধান ব্যয়গুলো হলো:
- দুই সন্তানের পড়াশোনার খরচ: স্কুল ফি, খাতা-কলম ইত্যাদির জন্য ৫,০০০ টাকা।
- চিকিৎসা খরচ: সাধারণ রোগ ও ওষুধের জন্য ৫,০০০ টাকা।
- বিদ্যুৎ বিল: ফ্যান, লাইট, ফ্রিজসহ ২,০০০ টাকা।
- যাতায়াত খরচ: ন্যূনতম যাতায়াত ব্যয়ের জন্য ২,০০০ টাকা।
এছাড়াও, গ্যাস বিল (১,৩৫০ টাকা), টিফিন/বার্তা খরচ (১,০০০ টাকা), জামাকাপড়, তেল, সাবান ইত্যাদি (৩,০০০ টাকা), এবং পানি ও ময়লার বিল (৫০০ টাকা) এই মোট ব্যয়ের অংশ।
তালিকাটি স্পষ্টভাবে দেখায় যে, কেবলমাত্র ন্যূনতম চাহিদাগুলো পূরণ করতেও একটি পরিবারকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এই ব্যয়ের হিসাবটি মূলত একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনযাত্রার ব্যয় তুলে ধরেছে, যেখানে বিলাসবহুল কোনো সুযোগ-সুবিধার হিসাব অন্তর্ভুক্ত নেই।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এই ধরণের হিসাব সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় সম্পর্কে একটি বাস্তব ধারণা দেয় এবং সরকারের নীতি নির্ধারণে সহায়ক হতে পারে, বিশেষ করে যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং মজুরি কাঠামো পুনর্বিবেচনা করার প্রশ্ন আসে।
খরচের সংক্ষিপ্ত তালিকা (মাসিক):
এই তথ্যটি স্পষ্ট করে যে, ৬ সদস্যের একটি পরিবারকে বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে হলে প্রতি মাসে প্রায় ৫৯,০০০ টাকা আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
মোঃ হানিফা দেওয়ান কর্তৃক উপস্থাপিত ৬ সদস্যের পরিবারের ন্যূনতম মাসিক ব্যয় ৫৮,৮৫০ টাকা (প্রায় ৫৯,০০০ টাকা) বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিম্নগ্রেডের সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি বাস্তবসম্মত এবং জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় বেতনের ভিত্তি হওয়া উচিত।
এই ব্যয়ের হিসাবকে মানদণ্ড ধরে নিম্নগ্রেডের (সাধারণত গ্রেড ১৭ থেকে ২০ বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী) কর্মচারীদের জন্য একটি ন্যায্য জাতীয় বেতন কাঠামো কেমন হওয়া উচিত, তা নিচে বিশ্লেষণ করা হলো:
১. ন্যূনতম মূল বেতন নির্ধারণ (ফ্লোর স্যালারি)
জাতীয় বেতন স্কেলের সর্বনিম্ন গ্রেড (২০তম গ্রেড) বা কর্মচারীদের প্রাথমিক গ্রেডে এমনভাবে বেতন নির্ধারণ করতে হবে যাতে সকল প্রকার ভাতা যোগ করে তাঁদের মোট মাসিক আয় অন্ততপক্ষে উল্লিখিত ৫৯,০০০ টাকার কাছাকাছি হয়।
বর্তমানে (২০১৫ সালের স্কেল অনুযায়ী) ২০তম গ্রেডের কর্মচারীর মূল বেতন ₹৮,২৫০ টাকা, যা অত্যন্ত অপ্রতুল। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও পে-কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, নতুন স্কেলে সর্বনিম্ন মূল বেতন ১৬,৫০০ টাকা বা তারও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো (৬ সদস্যের পরিবারের ব্যয় অনুসারে):
গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা:
- বাড়ি ভাড়া ভাতা: কর্মচারীর মূল বেতনের একটি নির্দিষ্ট শতাংশ হিসেবে বাড়ি ভাড়া ভাতা প্রদান করা হয়। যেহেতু আপনার তালিকায় বাসা ভাড়া ১২,০০০ টাকা ধরা হয়েছে, তাই মূল বেতন নির্ধারণের সময় এই ১২,০০০ টাকা যেন আবশ্যিকভাবে বাড়ি ভাড়া ভাতা দিয়ে পূরণ হয়, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
- খাদ্য নিরাপত্তা: ৫৯,০০০ টাকার মধ্যে ২৭,০০০ টাকা শুধু খাদ্য খরচ, যা মোট ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক। বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী খাদ্যপণ্য ভর্তুকি বা ন্যায্যমূল্যে (রেশন সুবিধা) সরবরাহ করার ব্যবস্থা থাকলে বেতনের উপর চাপ কমবে।
২. ভাতার পরিমাণ যৌক্তিকীকরণ
জাতীয় বেতন কাঠামোতে নিম্নগ্রেডের কর্মচারীদের জন্য বিভিন্ন ভাতার পরিমাণ বাজারমূল্য এবং প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে সংশোধন করা উচিত:
৩. সর্বোচ্চ-সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত (Ratio)
জাতীয় বেতন কমিশনের পর্যালোচনায় সাধারণত সর্বোচ্চ (গ্রেড-১) ও সর্বনিম্ন (গ্রেড-২০) বেতনের অনুপাত ৮:১ থেকে ১০:১ এর মধ্যে রাখার কথা বলা হয়।
যদি সর্বনিম্ন গ্রেডের (২০তম) মূল বেতন ৩০,০০০ টাকা ধরা হয়, তবে এই অনুপাত অনুসারে সর্বোচ্চ গ্রেডের (১ম) মূল বেতন দাঁড়াবে ২,৪০,০০০ টাকা থেকে ৩,০০,০০০ টাকা।
বাজার পরিস্থিতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনা করে, নিম্নগ্রেডের জীবনধারণের প্রয়োজনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এই অনুপাত নির্ধারণ করা উচিত, যাতে সর্বনিম্ন বেতন কোনোভাবেই ন্যূনতম জীবনযাত্রার ব্যয়ের নিচে না থাকে।
৪. মূল্যস্ফীতির সাথে সমন্বয়
মূল্যস্ফীতির কারণে প্রায়শই কর্মচারীর জীবনযাত্রার মান কমে যায়। তাই নতুন কাঠামোতে এমন একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা থাকা উচিত, যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় পরপর (যেমন: ২ বা ৩ বছর অন্তর) মূল্যস্ফীতির হার অনুযায়ী বেতন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৃদ্ধি পাবে। সর্বশেষ বেতন কমিশনও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে বেতন সমন্বয়ের পদ্ধতি নিরূপণে কাজ করছে।