বৈষম্য । দাবীর খতিয়ান । পুন:বিবেচনা

সরকারি চাকরিতে বেতন স্কেলের চরম অন্যায্য ২০২৫ । বৈষম্য ও গ্র্যাচুইটি নিয়ে ক্ষোভ, শতভাগ উত্তোলনের ঐচ্ছিক সুবিধা পুনর্বহালের দাবি?

সরকারি চাকুরিজীবীদের বেতন স্কেলের বিভিন্ন গ্রেডের মধ্যে আকাশ-পাতাল বৈষম্য এবং পেনশনের আনুতোষিক (গ্র্যাচুইটি) উত্তোলনের বর্তমান নিয়ম নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্য গ্রেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন কাঠামোর অসামঞ্জস্যতা এবং পেনশন সংক্রান্ত কঠোর আইনের ফলে আর্থিকভাবে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বৈষম্য দূরীকরণ ও অবসরের পর আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তারা শতভাগ আনুতোষিক উত্তোলনের ঐচ্ছিক সুবিধা পুনর্বহালের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন।

গ্রেডে গ্রেডে বিপুল ব্যবধান:

কর্মচারীদের অভিযোগ, বেতন কাঠামোর উচ্চ গ্রেডগুলোতে ব্যবধান বিপুল হলেও নিম্ন গ্রেডগুলোতে তা অত্যন্ত নগণ্য। উদাহরণস্বরূপ, ৯ম গ্রেড স্কেল ২২,০০০/- টাকা এবং ৮ম গ্রেড স্কেল ২৩,১০০/- টাকা, অর্থাৎ এই দুটি গ্রেডের পার্থক্য মাত্র ১,১০০ টাকা। অথচ ৮ম গ্রেড স্কেল ২৩,১০০/- টাকা থেকে ৭ম গ্রেড স্কেল ২৯,০০০/- টাকায় ব্যবধান এক লাফে ৫,৯০০ টাকা। এই ধরনের অসামঞ্জস্যতা ৮ম গ্রেডের সাথে স্পষ্ট বৈষম্য সৃষ্টি করেছে বলে তারা মনে করেন।

ক্ষোভের মূল কারণ আরও প্রকট হয় ১১ থেকে ২০ গ্রেডের ক্ষেত্রে। এই গ্রেডগুলোতে বেতন স্কেলের পার্থক্য মাত্র ২৫০, ৩০০, ৪০০ বা ৬০০ টাকার মতো, যা বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে একেবারেই অপ্রতুল।

উচ্চতর গ্রেডে বেতন বৃদ্ধির প্রহসন:

কর্মচারীরা জানান, ১০ বছর পর উচ্চতর গ্রেড (টাইম স্কেল বা সিলেকশন গ্রেডের অনুরূপ সুবিধা) পেলেও কারও কারও ক্ষেত্রে মূল বেতন বৃদ্ধি পায় মাত্র ১০ টাকা। এই বিষয়ে একজন ক্ষুব্ধ কর্মচারী বলেন, “আমি দশ বছর ধরে নিষ্ঠার সাথে চাকরি করার পর যখন পরবর্তী স্কেল পাওয়ার কথা, তখন কমপক্ষে ৫,০০০ টাকার পার্থক্য হওয়া উচিত। অথচ ১০ বছর পর বেতন বাড়ে মাত্র ১০ টাকা। এটা একেবারেই হাস্যকর ও বেদনার বিষয়।”

আনুতোষিক নিয়ে ‘কালো আইন’ বাতিলের দাবি:

বেতন বৈষম্যের পাশাপাশি পেনশনের আনুতোষিক উত্তোলনের বর্তমান নিয়ম নিয়েও সরকারি চাকুরিজীবীরা চরমভাবে হতাশ। তারা উল্লেখ করেন, পূর্বে আনুতোষিকের শতভাগ উত্তোলনের ঐচ্ছিক সুবিধা চালু ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে সরকার একটি আইন করে আনুতোষিকের ৫০ শতাংশ টাকা বাধ্যতামূলকভাবে কেটে রাখার নিয়ম চালু করে, যা সরকারি চাকুরিজীবীদের জন্য ‘কালো আইন’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

চাকুরিজীবী সংগঠনগুলো এই নিয়মকে “স্বৈরাচারী সরকারের কালো আইন” আখ্যা দিয়ে এর তীব্র সমালোচনা করছে। তারা জোর দাবি জানিয়েছেন যে, অবসরের পর আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং দীর্ঘদিনের সেবার সঠিক মূল্য দিতে অবিলম্বে এই কালো আইন বাতিল করে পেনশনের আনুতোষিক শতভাগ উত্তোলনের ঐচ্ছিক সুবিধা পুনরায় চালু করা হোক।

এই সকল বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে সরকারি কর্মচারী সংগঠনগুলো পে-কমিশনের মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয় ও সম্মানিত সদস্যবৃন্দসহ সরকারের সম্মানিত সচিব স্যারদের কাছে সবিনয়ে দাবি জানিয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই বৈষম্য ও অসঙ্গতি দূর করে একটি ন্যায্য ও যুগোপযোগী বেতন কাঠামো প্রণয়ন এবং পেনশন সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য তারা সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

নতুন বেতন কাঠামো (পে-স্কেল) প্রণয়নের লক্ষ্যে সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠন ও সমিতির সাথে খুব শীঘ্রই পে-কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। তবে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, এসব বৈঠক ও আলোচনার সফলতা বহুলাংশে নির্ভর করবে কর্মচারী সংগঠনগুলোর উত্থাপিত দাবির যৌক্তিকতা এবং দাবির মধ্যেকার ঐকমত্যের ওপর। তাই পে-কমিশনের সামনে প্রস্তাব পেশের আগে সকল সংগঠনকে একটি কাছাকাছি এবং সুচিন্তিত কাঠামো নিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে।

বর্তমানে সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন গ্রেডে বেতন বৈষম্য, নিম্ন গ্রেডে বেতন বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া এবং দীর্ঘ বছর পর উচ্চতর গ্রেডে সামান্য বেতন বৃদ্ধির মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এসব সমস্যার সমাধানে সংগঠনগুলো একক ও শক্তিশালী দাবি নিয়ে হাজির হতে পারলে পে-কমিশন দ্রুত এবং কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ঐকমত্যই সফলতার চাবিকাঠি:

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, যদি বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠন তাদের নতুন পে-স্কেলের কাঠামো প্রস্তাবনায় ভিন্ন ভিন্ন এবং পরস্পরবিরোধী দাবি নিয়ে আসে, তবে পে-কমিশনের পক্ষে একটি সমন্বিত ও ন্যায্য সুপারিশ তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়বে। একাধিক সূত্রের দাবি, বেতন বৈষম্য দূরীকরণ, নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং যৌক্তিক হারে উচ্চতর গ্রেড সুবিধা নিশ্চিত করার মতো মৌলিক বিষয়ে যদি সংগঠনগুলো একমত হয়, তবেই বৈঠকগুলো সফল হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা চাই কর্মচারীদের যৌক্তিক দাবিগুলো পূরণ হোক। কিন্তু প্রতিটি সংগঠন যদি তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে ভিন্ন ভিন্ন কাঠামো প্রস্তাব করে, তবে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করা কঠিন। কর্মচারীদের উচিত নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে একটি সর্বসম্মত এবং বাস্তবসম্মত পে-স্কেলের কাঠামো পে-কমিশনের সামনে তুলে ধরা।”

দাবিতে থাকতে হবে যৌক্তিকতা:

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নতুন পে-স্কেলের প্রস্তাবে অবশ্যই দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা, মুদ্রাস্ফীতি এবং সরকারের সক্ষমতার দিকটি বিবেচনা করতে হবে। আবেগতাড়িত না হয়ে, বিশেষ করে নিম্ন গ্রেডগুলোতে বিদ্যমান বেতন বৈষম্য দূরীকরণ এবং উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তিতে ন্যায্য সুবিধা নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা তৈরি করা জরুরি।

সরকারি কর্মচারী সমিতিগুলোর নেতারা জানিয়েছেন, তারা ইতিমধ্যে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন এবং আশা করছেন পে-কমিশনের সামনে একটি শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ এবং যৌক্তিক দাবিনামা পেশ করা সম্ভব হবে। তাদের মূল লক্ষ্য থাকবে, সকলের জন্য একটি বৈষম্যহীন ও যুগোপযোগী বেতন কাঠামো নিশ্চিত করা।

Alamin Mia

আমি একজন সরকারী চাকরিজীবি। দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ চাকুরির সুবাদে সরকারি চাকরি বিধি বিধান নিয়ে পড়াশুনা করছি। বিএসআর ব্লগে সরকারি আদেশ, গেজেট, প্রজ্ঞাপন ও পরিপত্র পোস্ট করা হয়। এ ব্লগের কোন পোস্ট নিয়ে প্রশ্ন থাকলে বা ব্যাখ্যা জানতে পোস্টের নিচে কমেন্ট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *