সর্বশেষ প্রকাশিত পোস্টসমূহ

জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ । বাংলাদেশের জুলাই সনদে কি আছে জেনে নিন

ঐতিহাসিক ঐকমত্যে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ প্রকাশ: সংবিধান ও রাষ্ট্রকাঠামোতে ব্যাপক সংস্কারের ঘোষণা

ঢাকা, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫:

সুদীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের পর গণতান্ত্রিক ও মানবিক মর্যাদার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের লক্ষ্যে গঠিত ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ কর্তৃক আজ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হলো ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ । অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশনের উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, জোট ও শক্তিসমূহের পারস্পরিক ও সম্মিলিত আলোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সংবিধান, নির্বাচন, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কারের বিষয়ে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে

মোট ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের অংশগ্রহণে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনার ভিত্তিতে প্রণীত এই সনদকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং গণঅভ্যুত্থানের বীর শহীদ ও আহতদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার স্মারক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে

সনদের মূল ঐকমত্য ও সংস্কার প্রস্তাবনা:

জুলাই জাতীয় সনদে সংবিধান সংশোধনের সাপেক্ষে যেসব কাঠামোগত, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের বিষয়ে ঐক্যমত অর্জিত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো:

১। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন:

  • সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হবে
  • সংসদ ভেঙ্গে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ (নব্বই) দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে
  • তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ের জন্য ৫ (পাঁচ) সদস্যের একটি ‘নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই কমিটি’ গঠিত হবে। এই কমিটির সদস্যরা হবেন: প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলের) এবং সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি
  • কোনো বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হলে, বাছাই কমিটিতে আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের দুইজন বিচার বিভাগীয় প্রতিনিধি যুক্ত হবেন

২। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও নাগরিকত্বের পরিবর্তন:

  • সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে বিদ্যমান নীতিগুলোর সঙ্গে ‘ধর্মেীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’ যুক্ত করা হবে
  • সংবিধানে ঘোষণা করা হবে যে, বাংলাদেশ একটি বহু-জাতি-গোষ্ঠী, বহু-ধর্মী, বহু-ভাষী ও বহু-সংস্কৃতির দেশ
  • নাগরিকদের পরিচয়ের ক্ষেত্রে বিদ্যমান অনুচ্ছেদ ৬(২)-এ বর্ণিত ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন’ বিধানটি প্রতিস্থাপন করে কেবল ”বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশি” বলিয়া পরিচিত হইবেন” মর্মে বিধান যুক্ত করা হবে

৩। নির্বাহী প্রধানের ক্ষমতার ভারসাম্য ও সময়সীমা:

  • একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী পদে যত মেয়াদ বা যত বারই হোন না কেন, সর্বোচ্চ ১০ (দশ) বছর থাকতে পারবেন
  • প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ব্যক্তি একই সঙ্গে দলীয় প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন না মর্মে বিধান যুক্ত করার বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে

৪। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি ও অভিশংসন প্রক্রিয়া:

  • রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনার লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। তিনি কারো পরামর্শ ছাড়াই নিজ এখতিয়ারবলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, আইন কমিশন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ প্রদান করতে পারবেন
  • রাষ্ট্রদ্রোহ, গুরুতর অসদাচরণ বা সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করার ক্ষেত্রে আইনসভার নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ (প্রস্তাবিত) উভয়ের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনের বিধান যুক্ত হবে

৫। জবাবদিহিতা ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সংস্কার:

  • সংবিধান বিলুপ্তি ও স্থগিতকরণের অপরাধ সংক্রান্ত বিদ্যমান অনুচ্ছেদ ৭ক এবং ৭খ বিলুপ্ত করা হবে
  • সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের জন্য প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশন (JAC) গঠন করা হবে
  • সংবিধানে ন্যায়পাল (Ombudsman) পদটি প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং তাঁর নিয়োগ একটি বাছাই কমিটির মাধ্যমে সম্পন্ন হবে
  • প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনারদের নিয়োগের জন্য একটি বাছাই কমিটি গঠনের বিষয়ে ঐক্যমত হয়েছে

সনদটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কর্তৃক ১৪ অক্টোবর, ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে । এই সনদে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

গণভোটে তো কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয় উল্লেখ থাকবে না। জনগণ কিসের উপর ভিত্তি করে গণভোটে হ্যা/ না ভোট দিবে? সনদের ৬(ক) অনুচ্ছেদের ৩ নং দফায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, সংবিধানের কিছু সুনির্দিষ্ট মৌলিক বিষয় সংশোধনের ক্ষেত্রে জনগণের মতামত (গণভোট) প্রয়োজন হবে। এই সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলোই হবে গণভোটের ভিত্তি। গণভোটে জনগণ কীসের ভিত্তিতে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেবেন, তার বিশদ ব্যাখ্যা নিচে তুলে ধরা হলো:

গণভোটের সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তু

জুলাই জাতীয় সনদ অনুযায়ী, নিম্নোক্ত মৌলিক বিষয়গুলো সংশোধনের জন্য জাতীয় সংসদের উভয় কক্ষে পাস হওয়ার পরেও গণভোটের মাধ্যমে জনগণের চূড়ান্ত অনুমোদন নিতে হবে:

১. সংবিধানের প্রস্তাবনা (Preamble) এবং মৌলিক অনুচ্ছেদসমূহ: সংবিধানের প্রস্তাবনাসহ সুনির্দিষ্ট কতগুলো অনুচ্ছেদ, যেমন— অনুচ্ছেদ ৮ (রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি), ৪৮ (রাষ্ট্রপতি), ৫৬ (মন্ত্রিসভা) এবং ১৪২ (সংবিধান সংশোধন) সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোট লাগবে

২. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা: সংবিধানে নতুন করে যুক্ত হতে যাওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমূহ (অনুচ্ছেদ ৫৮ক, ২ক পরিচ্ছেদ: ৫৮খ, ৫৮গ, ৫৮ঘ ও ৫৮ঙ) ভবিষ্যতে সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের প্রয়োজন হবে

জনগণ কীভাবে ‘হ্যাঁ’/’না’ ভোট দেবেন?

যেহেতু সংবিধানের এই মৌলিক কাঠামো ও গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলো গণভোটের বিষয়বস্তু, তাই জনগণ নিম্নোক্তভাবে তাদের মতামত জানাবেন:

  • ‘হ্যাঁ’ ভোট: সংবিধানের উল্লিখিত মৌলিক অনুচ্ছেদগুলোতে প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো গ্রহণ ও অনুমোদন করার পক্ষে সম্মতি জানালে জনগণ ‘হ্যাঁ’ ভোট দেবেন।
  • ‘না’ ভোট: প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলোর সাথে দ্বিমত পোষণ করে তা প্রত্যাখ্যান করতে চাইলে জনগণ ‘না’ ভোট দেবেন।

অর্থাৎ, গণভোটে কোনো অস্পষ্ট বা সাধারণ প্রশ্ন থাকবে না, বরং সুনির্দিষ্টভাবে তালিকাভুক্ত সাংবিধানিক বিষয়গুলোর সংশোধনের বিষয়ে জনগণের সরাসরি সিদ্ধান্ত চাওয়া হবে।

জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫

Alamin Mia

আমি একজন সরকারী চাকরিজীবি। দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ চাকুরির সুবাদে সরকারি চাকরি বিধি বিধান নিয়ে পড়াশুনা করছি। বিএসআর ব্লগে সরকারি আদেশ, গেজেট, প্রজ্ঞাপন ও পরিপত্র পোস্ট করা হয়। এ ব্লগের কোন পোস্ট নিয়ে প্রশ্ন থাকলে বা ব্যাখ্যা জানতে পোস্টের নিচে কমেন্ট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *