গ্রেড সংখ্যা কমিয়ে সমতা আনার দাবি ২০২৫ । পে-স্কেলের বৈষম্য নিয়ে কর্মচারীদের তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে?
নতুন পে-স্কেল (৯ম জাতীয় বেতন স্কেল-২০২৫) ঘোষণার প্রক্রিয়া শুরু হতেই সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে বিদ্যমান বেতন বৈষম্য নিয়ে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ১১ থেকে ২০ গ্রেডের কর্মচারীরা ১-১০ গ্রেডের বিশাল বেতন পার্থক্যের কড়া সমালোচনা করে এটিকে সুস্পষ্ট বৈষম্য হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের দাবি, আসন্ন পে-স্কেলে শতকের ব্যবধান নয়, বরং প্রতিটি গ্রেডে কমপক্ষে ২ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকার পার্থক্য থাকতে হবে।
জানা গেছে, বর্তমানে ১১-২০ গ্রেডের প্রতিটি গ্রেডের মূল বেতনের পার্থক্য ২৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৯০০ টাকা পর্যন্ত, যা অত্যন্ত নগণ্য। অন্যদিকে ১-১০ গ্রেডে এই পার্থক্য ৭ হাজার, ৮ হাজার, ১০ হাজার এমনকি ১৫ হাজার টাকারও বেশি। কর্মচারীদের মতে, একই সরকারের অধীনে কাজ করেও বেতনের এমন আকাশ-পাতাল পার্থক্য কেবল বৈষম্যই তৈরি করে না, বরং নিম্ন গ্রেডের কর্মীদের জীবনধারণ ও মনোবলকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
‘১১-২০ গ্রেড সরকারি চাকরিজীবী জাতীয় ফোরাম’-এর মতো বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠন এই বৈষম্য নিরসনে জোর দাবি জানাচ্ছে। তাদের মূল দাবির একটি হলো, বিদ্যমান ২০টি গ্রেড কমিয়ে ১২ থেকে ১৫টি গ্রেডে রূপান্তর করা। কর্মচারীরা মনে করেন, গ্রেড সংখ্যা বেশি থাকার কারণেই উপরের গ্রেডগুলোতে বেতনের পার্থক্য অনেক বেশি এবং নিচের গ্রেডগুলোতে তা অত্যন্ত কম, যা বৈষম্যকে আরও প্রকট করে তোলে।
এ প্রসঙ্গে একজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীরা পরিবার নিয়ে চলতে হিমশিম খাচ্ছেন। সেখানে ১-১০ গ্রেডের পার্থক্য ১৫ হাজার টাকা। আমাদের গ্রেডে ২০০-৩০০ টাকার পার্থক্য, এটা কি কোনো বেতন বৃদ্ধি? ২০২৫ সালের পে-স্কেলে শতকের পার্থক্য আমরা মানবো না। কমপক্ষে একেকটি গ্রেডের পার্থক্য ২/৪/৬/৮ হাজার করে হতে হবে।”
এসব কর্মচারী ফোরামের নেতারা মনে করেন, গ্রেড সংখ্যা না কমালে এই বেতন বৈষম্য দূর করা সম্ভব হবে না। এ বিষয়ে তারা সরকারকে দ্রুত উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এবং সব সরকারি কর্মচারীকে এই যৌক্তিক দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য মত দেওয়ার অনুরোধ করেছেন।
ইতিমধ্যে জাতীয় বেতন কমিশন-২০২৫ সবার মতামত নিচ্ছে এবং কমিশনের পক্ষ থেকেও বিদ্যমান ২০টি গ্রেড ভেঙে গ্রেড কমিয়ে বেতনের অনুপাতে সামঞ্জস্য করার চিন্তা রয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কর্মচারীদের দাবি হলো, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত বর্তমানে প্রায় ১:১০ থেকে কমিয়ে ১:৪ বা ১:৬ করা হোক। এ ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বেতন কমপক্ষে ৩২,০০০ টাকা করার প্রস্তাবও উঠে আসছে।
দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সরকারি কর্মচারীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই, ন্যায্য ও বৈষম্যহীন বেতন কাঠামো প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। দ্রুত এই বেতন বৈষম্যের নিরসন করে একটি মানবিক ও কার্যকর পে-স্কেল বাস্তবায়ন করাই হোক নতুন বেতন কমিশনের প্রধান লক্ষ্য—এমনটাই প্রত্যাশা করছেন দেশের লাখ লাখ সরকারি কর্মচারী।
সরকারি কর্মচারীরা আসন্ন নবম পে-স্কেলে (২০২৫) মূলত একটি ন্যায্য, বৈষম্যহীন এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের (মূল্যস্ফীতি) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বেতন কাঠামো চান। তাদের প্রধান দাবি ও প্রত্যাশাগুলো নিম্নরূপ:
১. বেতন বৈষম্য দূরীকরণ এবং নতুন অনুপাত নির্ধারণ
- ১:৪ বা ১:৬ অনুপাত: বর্তমানে সর্বোচ্চ (গ্রেড-১) ও সর্বনিম্ন (গ্রেডের (গ্রেড-২০) বেতনের অনুপাত প্রায় ১:১০। কর্মচারীরা এই বৈষম্য কমাতে অনুপাতকে ১:৪ অথবা ১:৬ এ নামিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন।
- সুনির্দিষ্ট বেতন পার্থক্য: বিশেষ করে ১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীরা শতকের (২৫০/৩০০/৫০০ টাকা) পার্থক্য বাতিল করে প্রতিটি গ্রেডে কমপক্ষে ২ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট ও যৌক্তিক পার্থক্য রাখার দাবি জানিয়েছেন।
২. গ্রেড সংখ্যা হ্রাস
- ২০টি গ্রেড ভেঙে কমিয়ে আনা: বিদ্যমান ২০টি গ্রেডকে ভেঙে ১২ থেকে ১৫টি গ্রেডে রূপান্তর করার জোরালো দাবি উঠেছে। তাদের মতে, গ্রেড সংখ্যা বেশি হওয়ায় নিম্ন গ্রেডগুলোতে পার্থক্য কমে যায় এবং বৈষম্য সৃষ্টি হয়।
৩. সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের প্রস্তাবনা
- সর্বনিম্ন বেতন: বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে সর্বনিম্ন মূল বেতন ৩২,০০০ টাকা বা ৩৫,০০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
- সর্বোচ্চ বেতন: সর্বনিম্ন বেতনের সঙ্গে প্রস্তাবিত ১:৪ অনুপাত হিসেব করে সর্বোচ্চ মূল বেতন ১,২৮,০০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
৪. অন্যান্য আর্থিক সুবিধা ও দাবি
- ভাতা পুনর্নির্ধারণ: বাজার পরিস্থিতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, শিক্ষা ভাতাসহ অন্যান্য ভাতাদি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানোর দাবি।
- টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল: ২০১৫ সালের পে-স্কেলে বিলুপ্ত হওয়া টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল করার দাবি জানিয়েছেন অনেকে।
- অভিন্ন নিয়োগবিধি: একই সরকারের অধীনে সকল দপ্তরে এক ও অভিন্ন নিয়োগবিধি বাস্তবায়ন করা।
- শতভাগ পেনশন প্রবর্তন: কর্মচারীরা শতভাগ পেনশন প্রবর্তনের দাবিও তুলেছেন।
সংক্ষেপে বলা যায়, সরকারি কর্মচারীরা এমন একটি বেতন কাঠামো চান যা তাদের বর্তমান অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলায় সহায়তা করবে এবং বিভিন্ন গ্রেডের মধ্যেকার ব্যাপক বেতন বৈষম্য দূর করে কর্মক্ষেত্রে একটি ন্যায্য পরিবেশ নিশ্চিত করবে।
সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠনের দাবি এবং আপনার চাহিদা অনুযায়ী বৈষম্যহীনতার নীতি অনুসরণ করে ২০ গ্রেডের পরিবর্তে ১২টি গ্রেডে একটি প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো নিচে দাঁড় করানো হলো।
এই কাঠামোতে সর্বনিম্ন বেতন ধরা হয়েছে ৳৩২,০০০ এবং সর্বোচ্চ বেতন ৳১,২৮,০০০ টাকা (১:৪ অনুপাত অনুসরণ করে)। গ্রেডের পার্থক্যগুলো নিম্ন গ্রেডগুলোতে হাজারের ঘরে (কমপক্ষে ৪,০০০ টাকা) রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।
কর্মচারীদের দাবি অনুযায়ী প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো (নমুনা)
এই কাঠামোর মূল বৈশিষ্ট্য:
১. গ্রেড সংখ্যা হ্রাস: বিদ্যমান ২০টি গ্রেডকে কমিয়ে ১২টি গ্রেডে রূপান্তর করা হয়েছে, যা বৈষম্য কমাতে সহায়ক হতে পারে। ২. বেতন অনুপাত (সর্বোচ্চ: সর্বনিম্ন): এখানে সর্বনিম্ন মূল বেতন (গ্রেড-১২) ও সর্বোচ্চ মূল বেতন (গ্রেড-১) ধরে অনুপাত প্রায় ১:৪ (৪.২৬:১)। (উল্লেখ্য, কর্মচারী ফোরামগুলো ও বা ১:৪ এর দাবি জানিয়েছে, কিন্তু ২০তম গ্রেডের কাছাকাছি সকল গ্রেডকে যৌক্তিক বেতন বৃদ্ধির মাধ্যমে আনার জন্য সর্বনিম্ন গ্রেডটি সামান্য কম রাখা হয়েছে।) ৩. ১১-২০ গ্রেডের পার্থক্য: বর্তমান ১১-২০ গ্রেডের (প্রস্তাবিত গ্রেড ৭-১২) মূল বেতনের পার্থক্য সর্বনিম্ন টাকা থেকে সর্বোচ্চ টাকা পর্যন্ত রাখা হয়েছে, যা কর্মচারীদের শতকের পার্থক্য মানবো না—এই দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ৪. ১-১০ গ্রেডের পার্থক্য: বর্তমান ১-১০ গ্রেডের (প্রস্তাবিত গ্রেড ১-৬) পার্থক্যও যৌক্তিক হারে টাকা থেকে টাকা পর্যন্ত রাখা হয়েছে।
দ্রষ্টব্য: এটি কেবল কর্মচারীদের দাবি ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে প্রস্তুত করা একটি প্রস্তাবিত কাঠামো বা মডেল। জাতীয় বেতন কমিশন চূড়ান্তভাবে সরকারের আর্থিক সক্ষমতা, মূল্যস্ফীতি এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর নির্ভর করে বেতন কাঠামো নির্ধারণ করবে।



