জাতীয় বেতন কমিশন ২০২৫ । মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতির ২২ দফা দাবি পেশ করেছেন?
জাতীয় বেতন কমিশন, ২০২৫-এর (National Pay Commission, 2025) সাথে মতবিনিময় সভায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতি তাদের বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেছে। সমিতির পক্ষ থেকে মোট ২২টি দাবি সম্বলিত একটি তালিকা পেশ করা হয়, যার মধ্যে বেতন গ্রেড হ্রাস, পেনশন, ভাতা ও ঋণ সুবিধার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন চাওয়া হয়েছে।
প্রধান দাবিসমূহ:
- গ্রেড হ্রাস ও বেতন অনুপাত: বিদ্যমান ২০টি গ্রেডের পরিবর্তে ১২টি গ্রেডে বেতন কাঠামো নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০১৫ সালের পে-স্কেলের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত ১:১০ কে বৈষম্যমূলক উল্লেখ করে, ২০২৫ সালের পে-স্কেলে তা ন্যূনতম ১:৪ (৩৫০০০:১৪০০০০ টাকায়) করার দাবি জানানো হয়েছে।
- পেনশন ও গ্রাচ্যুইটি:
- পেনশন ৯০% এর পরিবর্তে ১০০% নির্ধারণ।
- গ্রাচ্যুইটি ২৩০ টাকার পরিবর্তে ৫০০ টাকা নির্ধারণ।
- পেনশনের ১০০% সমর্পণ পুনর্বহাল।
- ৬৫ বছর উর্ধ্ব মাসিক পেনশনপ্রাপ্ত অবসরভোগী ও আজীবন পারিবারিক পেনশনভোগীর নীট পেনশনের পরিমাণ ৫০% এর পরিবর্তে ৮০% নির্ধারণ।
- অবসরভোগী ও আজীবন পারিবারিক পেনশনভোগীদের ন্যূনতম পেনশনের পরিমাণ ৩০০০ এর পরিবর্তে ১০০০০ টাকা নির্ধারণ।
- ভাতা বৃদ্ধি:
- শিক্ষা সহায়ক ভাতা সন্তানপ্রতি বিদ্যমান ৫০০ টাকার পরিবর্তে ন্যূনতম ৩০০০ টাকা নির্ধারণ।
- সরকারি কর্মচারীদের সন্তানদের স্কুল/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় প্রতিবছর শিক্ষা বর্ষের শুরুতে এককালীন ন্যূনতম ১০০০০ টাকা সহায়তা ভাতা প্রদান।
- চিকিৎসা ভাতা বিদ্যমান ১৫০০ টাকার পরিবর্তে ন্যূনতম ৫০০০ টাকা নির্ধারণ।
- ৬৫ বছর উর্ধ্ব পেনশনভোগীর ক্ষেত্রে মাসিক চিকিৎসা ভাতা ২৫০০ টাকার পরিবর্তে ন্যূনতম ১০০০০ টাকা নির্ধারণ।
- টিফিন ভাতা ২০০ টাকার পরিবর্তে লাঞ্চ ভাতা ন্যূনতম ৮০০০ টাকা এবং যাতায়াত ভাতা ৩০০ টাকার পরিবর্তে ন্যূনতম ৩০০০ টাকা নির্ধারণ।
- বাংলা নববর্ষ ভাতা ২০% এর পরিবর্তে মূল বেতনের সমপরিমাণ নির্ধারণ।
- সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য যৌক্তিক হারে মোবাইল ভাতা ও ইন্টারনেট ভাতা নির্ধারণ।
- অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা:
- টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুর্নবহাল।
- শ্রান্তি বিনোদন ছুটি ও ভাতা ০৩ বছরের পরিবর্তে প্রতি ০২ বছর অন্তর অন্তর প্রদান।
- ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা বিমা সুবিধা প্রদান।
- সচিবালয়ে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য রেশন ও সচিবালয় ভাতা প্রদান।
- সচিবালয়ে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ন্যূনতম ৩০% ঝুঁকি ভাতা প্রদান।
- গৃহনির্মাণের জন্য বিনা সুদে ৫০ লক্ষ টাকা ঋণ প্রদান।
- বিদ্যমান মটর সাইকেল ঋণ ৩৫০০০ টাকার পরিবর্তে বিনা সুদে ৫ লক্ষ টাকার ঋণ প্রদান এবং প্রতিবছর ১০% হারে অবচয় নির্ধারণ।
- বিদ্যমান ১৮ মাসের ছুটি নগদায়ন সুবিধার পরিবর্তে ছুটি পাওনা সাপেক্ষে মোট অর্জিত ছুটির নগদায়ন সুবিধা প্রদান।
- পেনশনারদের ৫০% হারে বাড়ি ভাড়া প্রদান।
- সরকারি কোয়ার্টার-এর বাসা ভাড়ার জন্য সিলিং নির্ধারণ।
- পদোন্নতিতে ন্যূনতম সুবিধা প্রদান এবং সার্ভিস বেনিফিট প্রদান।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোঃ মিজানুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক মোঃ মনির হোসেন স্বাক্ষরিত এই দাবিনামাটি জাতীয় বেতন কমিশন, ২০২৫-এর কাছে দাখিল করা হয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতির ২২ দফা দাবি
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতি কর্তৃক প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো (গ্রেড ও অনুপাত)

বেতন অনুপাত সংক্রান্ত প্রস্তাবনা:
- বর্তমান অনুপাত (২০১৫): ১:১০ (সর্বোচ্চ : সর্বনিম্ন)
- প্রস্তাবিত অনুপাত (২০২৫): ন্যূনতম ১:৪ (সর্বোচ্চ : সর্বনিম্ন)
- সমিতি একটি উদাহরণস্বরূপ সর্বনিম্ন বেতন ৩৫,০০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ বেতন ১,৪০,০০০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে।
সংক্ষেপে, সমিতিটি ২০টি গ্রেডের পরিবর্তে ১২টি গ্রেড প্রবর্তনের দাবি জানিয়েছে এবং বেতন স্কেলের অনুপাত ১:১০ থেকে কমিয়ে ১:৪ করার কথা বলেছে।
সরকার কি এমন প্রস্তাব গ্রহণ করবে?
জাতীয় বেতন কমিশন, ২০২৫-এর কাছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতির যে প্রস্তাবগুলি দেওয়া হয়েছে, সরকার সেগুলোর সবকটি হুবহু গ্রহণ করবে কি না, তা বলা সম্ভব নয়। বেতন কমিশন এবং সরকার বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। প্রস্তাব গ্রহণের বিষয়টি যে প্রধান কারণগুলোর ওপর নির্ভর করে, তা নিচে উল্লেখ করা হলো:
১. জাতীয় বেতন কমিশনের ভূমিকা
- বিশ্লেষণ ও সুপারিশ: জাতীয় বেতন কমিশন, ২০২৫, শুধুমাত্র এই একটি সমিতির দাবি নয়, বরং অন্যান্য সকল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সংগঠন, বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ এবং সাধারণ জনগণের কাছ থেকে মতামত (যেমন প্রশ্নমালার মাধ্যমে) গ্রহণ করে। এরপর সকল তথ্য-উপাত্ত, দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা, মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিশ্লেষণ করে তারা সরকারের কাছে সুপারিশ পেশ করবে।
- বাস্তবায়নযোগ্যতা: সমিতিটি ২০টি গ্রেডকে ১২টিতে নামিয়ে আনা এবং সর্বোচ্চ-সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত ১:১০ থেকে ১:৪-এ নামিয়ে আনার যে প্রস্তাব করেছে, কমিশন সেটির প্রশাসনিক ও আর্থিক বাস্তবায়নের প্রভাব খতিয়ে দেখবে।
২. সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাপকাঠি
- আর্থিক সক্ষমতা: প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো এবং ভাতা বৃদ্ধির (যেমন: সর্বনিম্ন বেতন ৩৫,০০০, গৃহনির্মাণ ঋণ ৫০ লক্ষ, চিকিৎসা ভাতা ৫,০০০) জন্য সরকারের বার্ষিক বাজেটে কী পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে, সেটি একটি বড় বিষয়। দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি না করে সরকার যে পরিমাণ অর্থ বহন করতে পারবে, সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
- অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা: এত বড় বেতন বৃদ্ধি (৯০-৯৭ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির একটি প্রাথমিক আলোচনা রয়েছে) দেশের মূল্যস্ফীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, তা সরকার বিবেচনা করবে। বড় ধরনের বেতন বৃদ্ধি অনেক সময় বাজারে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
- সামাজিক ন্যায্যতা: কেবল গ্রেড-ভিত্তিক বৈষম্য দূরীকরণই নয়, বরং সরকারি ও বেসরকারি খাতের কর্মীদের মধ্যে এবং সমাজের অন্যান্য স্তরের মানুষের সাথেও যেন একটি যৌক্তিক ব্যবধান বজায় থাকে, সেদিকে সরকার লক্ষ্য রাখবে। উদাহরণস্বরূপ, সব গ্রেডেই ১:৪ অনুপাত গ্রহণ করা হলে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের বিশেষ সুবিধা বা দায়িত্বের গুরুত্ব কিছুটা উপেক্ষিত হতে পারে।
- প্রশাসনিক যৌক্তিকতা: গ্রেড সংখ্যা ২০টি থেকে ১২টিতে নামিয়ে আনার ফলে পদোন্নতি, নিয়োগ এবং প্রশাসনিক কাঠামোতে কী ধরনের পরিবর্তন আসবে এবং তা কাজে গতি আনবে কি না, সেটাও বিবেচনা করা হবে।
চূড়ান্ত কথা হলো, সরকার সকল দাবি হুবহু গ্রহণ না-ও করতে পারে, তবে মূল্যস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি মাথায় রেখে একটি যৌক্তিক এবং কার্যকর বেতন কাঠামো চূড়ান্ত করা হবে, যেখানে অনেকগুলো প্রস্তাবের কিছু অংশ অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।



