এমপিও শিক্ষকদের দাবী দাওয়া ২০২৫ । শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কি পরিবর্তন, প্রস্তাব ও প্রত্যাশা শিক্ষকদের?
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে এবং বেতন ভাতাদিতেও পরিবর্তন আনা প্রয়োজন-শিক্ষক হিসেবে প্রকৃত মর্যাদা দিতে সংস্কারগুলো আশু করা দরকার–এমপিও শিক্ষকদের দাবী দাওয়া ২০২৫
শিক্ষা খাতে কি বরাদ্দ বৃদ্ধি করা দরকার? হ্যাঁ। শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের ২০% অথবা জিডিপির ৬% শিক্ষায় বরাদ্ধ নিশ্চিত করা। শিক্ষা পরিকল্পনা ও বাজেটের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে যাতে বৈষম্যহীন, মতাদর্শ, অঞ্চল ও জেন্ডার নির্বিশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রকৃত উন্নয়ন ও কল্যাণ এবং শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে সহায়ক। যুব সমাজের কর্মসংস্থানের জন্য সুনির্দিষ্ট জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে কর্মমুখী, সর্বজনীন ও বিজ্ঞানভিত্তিক যুগোপযোগী শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করা এবং এ সংক্রান্ত সরকারি উদ্যোগ ফলপ্রসূ করতে ও কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। বেসরকারি কলেজে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নিয়োগে ২০২১ সালের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালার সংশ্লিষ্ট ধারা বাতিল করে ২০১০ এর নীতিমালা পুনর্বহাল করার জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষায় বৈশ্বিক মান অর্জন এবং গুণগত রূপান্তর নিশ্চিত করতে শিক্ষা সংক্রান্ত বিদেশে প্রশিক্ষণ প্রদানের ক্ষেত্রে বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের আনুপাতিক হারে সুযোগ প্রদান। কমপক্ষে ৫০% কোটা সংরক্ষণ করতে হবে।
বর্তমানে শিক্ষা খাতে বাজেট কত? ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে বাজেট হলো ৯৫,৬৪৪ কোটি টাকা। এটি মোট জাতীয় বাজেটের ১২.১% এবং জিডিপির প্রায় ২.১%। এই বাজেটকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়েছে: প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়: ৩৫,৪০৩ কোটি টাকা।শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ: ৪৭,৫৬৩ কোটি টাকা। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ: ১২,৬৭৮ কোটি টাকা। তবে, ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী, শিক্ষা খাতে একটি দেশের জিডিপির ৪-৬% এবং জাতীয় বাজেটের ১৫-২০% বরাদ্দ করা উচিত। সেই হিসেবে, বাংলাদেশের বর্তমান বাজেট আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চেয়ে কম।
এমপিও শিক্ষকদের বেতন কেন বৃদ্ধি করা দরকার? এমপিও শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তার পেছনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে।এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা সরকারি শিক্ষকদের তুলনায় অনেক কম বেতন পান। বর্তমান বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায়, তাঁদের সীমিত বেতন দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। বেতন বৃদ্ধি করা হলে তাঁদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে এবং তাঁরা নিশ্চিন্তে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। পর্যাপ্ত বেতন না পেলে শিক্ষকরা তাঁদের পেশার প্রতি আগ্রহ হারাতে পারেন। ভালো বেতন কাঠামো থাকলে মেধাবী এবং যোগ্যতাসম্পন্ন তরুণরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে উৎসাহিত হবেন। এর ফলে শিক্ষার সার্বিক মান উন্নত হবে। বেতন বৃদ্ধি হলে শিক্ষকদের মধ্যে পেশাগত সন্তুষ্টি বাড়বে। তাঁরা নিজেদেরকে আরও বেশি মূল্যবান মনে করবেন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতা বাড়বে।
গ্রেড জটিলতা কমাতে হবে? হ্যাঁ। বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশা একসময় অত্যন্ত সম্মানজনক ছিল। কিন্তু সীমিত বেতনের কারণে অনেক সময় এই পেশার মর্যাদা কমে গেছে। বেতন বৃদ্ধি করা হলে শিক্ষকরা সমাজে আরও বেশি মর্যাদা পাবেন। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বেতন গ্রেড একই। এটি প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি করে। প্রধান শিক্ষকদের বেতন গ্রেড বৃদ্ধি পেলে এই ধরনের জটিলতা নিরসন হবে।সরকারি শিক্ষকরা যেখানে পেনশনসহ নানা ধরনের আর্থিক সুবিধা পান, সেখানে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য এই ধরনের সুযোগ সীমিত। বেতন বৃদ্ধি করা হলে তাঁদের ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তা কিছুটা নিশ্চিত হবে।
এমপিও (Monthly Pay Order) ভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সরকারি শিক্ষকদের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। তাদের বেতন জাতীয় বেতন স্কেলের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হলেও, কিছু ক্ষেত্রে সুবিধা কম।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মূল বেতন তাদের গ্রেড ও শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। যেমন, একজন প্রশিক্ষণবিহীন সহকারী শিক্ষক (মাধ্যমিক) ১২,৫০০ টাকা থেকে শুরু করেন এবং ১০ম গ্রেডে মূল বেতন ১৬,০০০ টাকা পান। বর্তমানে শিক্ষকদের জন্য বাড়ি ভাড়া ভাতা ১,০০০ টাকা। যদিও এটি অপ্রতুল এবং তা বাড়ানোর জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি চলে আসছে। চিকিৎসা ভাতা হিসেবে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা মাসিক ৫০০ টাকা পান। সরকার কর্তৃক ঘোষিত বিশেষ সুবিধা, যা মূল বেতনের ১০% থেকে ১৫% পর্যন্ত হতে পারে, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরাও পান। এটি তাদের মোট বেতন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। সরকারি কর্মচারীদের মতো এমপিওভুক্ত শিক্ষকরাও বছরে দুটি উৎসব ভাতা পান। তবে, সরকারি শিক্ষকরা মূল বেতনের ১০০% উৎসব ভাতা পেলেও, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা পান ২৫%। কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এটি ৫০%। পহেলা বৈশাখে এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীরা মূল বেতনের ২০% বৈশাখী ভাতা পান।
Caption: MPO Teacher Bangladesh
এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ২০২৫ । প্রাথমিক স্তর পরবর্তী সুনির্দিষ্ট জাতীয় পরিকল্পনা ও নীতিমালার ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করার মাধ্যমে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসনে অন্তবর্তীকালীন সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। সম যোগ্যতা সম অভিজ্ঞতা ও সম দায়িত্বে নিয়োজিত বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য সরকারি শিক্ষকদের অনুরূপ –
- ২০১৫ সালের ৮ম জাতীয় পে স্কেলের আলোকে মূল বেতনের ৪০ – ৫০% বাড়ি ভাড়া প্রদান। (বর্তমানে দেয়া হচ্ছে মাত্র ১০০০/- টাকা)।
- মূল বেতনের ১০০% উৎসব ভাতা প্রদান (বর্তমানে দেয়া হচ্ছে মাত্র ২৫%)। (সাম্প্রতিক ঘোষণা মাত্র ২৫%)
- চিকিৎসা ভাতা ১৫০০ টাকা প্রদান (বর্তমানে দেয়া হচ্ছে মাত্র ৫০০ টাকা)।
- বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের পরিবর্তে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের পুর্নাঙ্গ পেনশন প্রদান (বর্তমানে ২ বছর পর কল্যাণ ট্রাস্ট ও ৩ বছর পর অবসর সুবিধা বোর্ড থেকে প্রবিধান অনুযায়ী কিছু টাকা দেয়া হয়)। সর্বজনীন পেনশন স্কীমে বেসরকারি শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়।
- দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতিতে জীবন যাত্রার সীমাহীন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারীদের ৫০% মহার্ঘ ভাতা প্রদান।
- কলেজ পর্যায়ে প্রভাষক হিসেবে ৮ বছর পূর্তিতে সরাসরি সহকারী অধ্যাপক এবং ২০১০ সালের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালায় সৃস্ট সহযোগী অধ্যাপক পদ পুনর্বহাল এবং অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতি প্রদান (বর্তমানে সহকারী অধ্যাপক পরবর্তী কোন পদোন্নতি নেই)। এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকদের বিশেষ বিবেচনায় পদোন্নতি প্রদান।
- ২০২১ সালের বেসরকারি শিক্ষকদের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালায় প্রদত্ত উচ্চমাধ্যমিক কলেজে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক পদের পরিবর্তে পূর্বের (২০১০ সালের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী) সহকারী অধ্যাপক পদ পুনর্বহাল করা।
- শিক্ষা মন্ত্রণালয়াধীন দপ্তর, অধিদপ্তর, শিক্ষা বোর্ড, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন দপ্তরে আনুপাতিক হারে সরকারি শিক্ষকদের পাশাপাশি এমপিওভুক্ত কলেজ শিক্ষকদের প্রেষণে নিয়োগ প্রদান।
- সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সমধারার সমস্তরের প্রতিষ্ঠান ও সম পর্যায়ের পদে বদলীর ব্যবস্থা গ্রহণ।
- বেসরকারি কলেজে বিধি সম্মতভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত, এমপিওর শর্ত পূরণকারী নন এমপিও এবং অনার্স ও মাস্টার্সে পাঠদানরত শিক্ষকদের স্ট্যাপিং প্যাটার্নভুক্ত করে এমপিওভুক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ।
- জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ডিগ্রি (পাস), অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ে পাঠদানরত শিক্ষকদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরূপ কলেজ শিক্ষকদের চাকুরীর বয়স ৬৫ বৎসর নির্ধারণ করা।
পেনশন ও অবসর কল্যাণ সুবিধা পেতে এত দেরি হয় কেন?
বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারীদের পূর্নাঙ্গ পেনশন ব্যবস্থা চালুর পূর্ব পর্যন্ত মহামান্য হাইকোর্টের রায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ড থেকে শিক্ষক ও কর্মচারীদের প্রাপ্যতা অবসর গ্রহণের ৬ মাসের মধ্যে প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর আলোকে সংবিধিবদ্ধ “স্থায়ী শিক্ষা কমিশন” গঠন করে কারিকুলাম যুগোপযোগীকরণ, শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্য নিরসন এবং শিক্ষা সংক্রান্ত সকল সমস্যার সমাধান নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এনটিআরসিএ এর পরিবর্রতে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর আলোকে সংবিধিবদ্ধ “শিক্ষক নিয়োগ কমিশন” গঠন করে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
পেনশন ও অবসর সুবিধা: সরকারি শিক্ষকদের মতো এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা পেনশন পান না। তবে, তাঁরা অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে কিছু আর্থিক সুবিধা পান। এর জন্য তাঁদের বেতন থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ কর্তন করা হয়। | এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বর্তমানে ইলেক্ট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (EFT) পদ্ধতির মাধ্যমে সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়। | বাড়ি ভাড়া এবং চিকিৎসা ভাতা বাড়ানোর জন্য শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি রয়েছে এবং বিভিন্ন সময়ে তা বাড়ানোর আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। |