ভোগান্তি কমাতে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমি মিউটেশন ২০২৫ । বন্টননামা ছাড়াই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমির যৌথ নামজারির সুযোগ আছে কি?
উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত স্থাবর সম্পত্তির নামজারি (মিউটেশন) বা রেকর্ড সংশোধনের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের ভোগান্তি নিরসনে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত এক গুরুত্বপূর্ণ পরিপত্রের মাধ্যমে এখন থেকে সকল ওয়ারিশ যৌথভাবে বন্টননামা দলিল ছাড়াই তাদের নামে নামজারি করার সুযোগ পাচ্ছেন। এই নির্দেশনাটি কার্যকর হওয়ায় জরুরি প্রয়োজনে জমি বিক্রি বা বন্ধক রাখতে গিয়ে সাধারণ নাগরিকদের দীর্ঘসূত্রিতা ও অতিরিক্ত খরচ অনেকাংশে হ্রাস পাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কেন এই পরিবর্তন?
এতদিন উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমির নামজারি বা রেকর্ড সংশোধনের ক্ষেত্রে প্রায় বাধ্যতামূলক শর্ত ছিল ‘বন্টননামা দলিল’। কিন্তু বাস্তবে সকল ওয়ারিশের অনুপস্থিতি, কেউ বিদেশে অবস্থান করা, শারীরিক দূরত্ব এবং রেজিস্ট্রি দলিলের বিপুল খরচ বহন করা সাধারণ নাগরিকদের জন্য এক দুরূহ প্রক্রিয়া ছিল। ফলস্বরূপ, বন্টননামা তৈরিতে ব্যর্থ হওয়ায় বহু মানুষ জমি সংক্রান্ত জরুরি কাজ সম্পন্ন করতে পারছিলেন না।
পরিপত্রে যা বলা হয়েছে:
ভূমি মন্ত্রণালয় গত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে (স্মারক নং-৩১.০০.০০০০.০৪২.২১.০১১.২২২) জারি করা পরিপত্রে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমির নামজারির বিষয়টি স্পষ্ট করে এই নতুন নির্দেশনা দিয়েছে।
১. যৌথ নামজারি (জমাভাগ ছাড়া):
- মৃত ব্যক্তির সকল ওয়ারিশের নাম একটি খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ওয়ারিশগণ যৌথভাবে নামজারির আবেদন করতে পারবেন।
- এক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র বা সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর কর্তৃক প্রদত্ত ওয়ারিশন সনদ সংগ্রহ করে আবেদনের সঙ্গে দাখিল করতে হবে।
- সহকারী কমিশনার (ভূমি) এই ধরনের আবেদন পাওয়ার পর বন্টননামা দলিল ছাড়াই নামজারি মামলা দায়ের করে খতিয়ানে মৃত ব্যক্তির মোট জমির মধ্যে প্রত্যেক ওয়ারিশের প্রাপ্য হিস্যা উল্লেখপূর্বক নামজারি খতিয়ান সৃজন করে দেবেন।
২. পৃথক খতিয়ানের ক্ষেত্রে বন্টননামা আবশ্যক:
- তবে, ওয়ারিশগণ যদি জমাভাগের মাধ্যমে পৃথক পৃথকভাবে খতিয়ান সৃজন করতে এবং আলাদাভাবে ভূমি উন্নয়ন কর দিতে চান, তবে সকল ওয়ারিশের সম্মতিতে কে কোন দাগে বা দাগের কোন অংশে জমি ভোগ-দখল করবেন, তা নির্ধারণ করে একটি আপস বণ্টননামা দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
- কেবল রেজিস্টার্ড বণ্টননামা দলিল ব্যবহার করেই ওয়ারিশগণ পৃথক পৃথক নামজারির আবেদন করতে পারবেন।
নাগরিক স্বস্তি:
ভূমি বিশেষজ্ঞদের মতে, নামজারির ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের এই জটিলতা নিরসনে ভূমি মন্ত্রণালয়ের এই পরিপত্র অত্যন্ত সময়োপযোগী। এর ফলে:
- সময় ও অর্থ সাশ্রয়: বন্টননামা দলিলের জন্য ওয়ারিশদের একত্রিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা এবং বিপুল খরচ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
- দ্রুত সম্পত্তি হস্তান্তর: জরুরি প্রয়োজনে কোনো ওয়ারিশ তার অংশীদারী সম্পত্তি দ্রুত বিক্রি বা বন্ধক রেখে অর্থসংস্থানের সুযোগ পাবেন।
সরকারের এই পদক্ষেপ ই-নামজারি প্রক্রিয়াকে আরও সহজ ও জনবান্ধব করবে এবং জমির মালিকানা সংক্রান্ত দীর্ঘসূত্রিতা ও হয়রানি অনেকাংশে হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। উত্তরাধিকারীদের এখন শুধু প্রয়োজনীয় ওয়ারিশন সনদ এবং অন্যান্য কাগজপত্রসহ সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে যৌথভাবে আবেদন করতে হবে।

পরিবারের অন্য সদস্য বন্টন দলিল করতে না চাইলে কি আমার অংশ নামজারি করতে পারবো?
আপনার পরিবারের অন্য সদস্যরা যদি বন্টননামা দলিল (Partition Deed) সম্পাদন করতে রাজি না হন, তাহলে আপনি শুধুমাত্র আপনার অংশের জন্য পৃথকভাবে নামজারি (Separate Mutation) করতে পারবেন না। এর কারণটি ভূমি মন্ত্রণালয়ের ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালের পরিপত্রে স্পষ্ট করা হয়েছে:
- যৌথ নামজারির সুযোগ: পরিপত্রে বন্টননামা ছাড়াই যে সরলীকৃত নামজারির সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তা হলো যৌথ নামজারি (জমাভাগ ছাড়া)। এই প্রক্রিয়ায় মৃত ব্যক্তির মোট সম্পত্তির উপর সকল ওয়ারিশকে যৌথভাবে আবেদন করতে হবে এবং সকলের প্রাপ্য হিস্যা একটি মাত্র খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত হবে। যদি পরিবারের অন্য সদস্যরা আপনার সাথে যৌথ আবেদনটি করতেও রাজি না হন, তবে এই সরলীকৃত নামজারি প্রক্রিয়াটিও করা সম্ভব হবে না।
- পৃথক নামজারির আবশ্যকতা: আপনি যদি আপনার অংশের জন্য একটি আলাদা খতিয়ান তৈরি করতে চান (অর্থাৎ জমাভাগ করতে চান), তবে পরিপত্র অনুযায়ী এটি করার জন্য রেজিস্টার্ড বন্টননামা দলিল আবশ্যক। যেহেতু অন্য সদস্যরা দলিল করতে রাজি নন, তাই আপনি এই পথেও পৃথক নামজারি করতে পারছেন না।
এই অবস্থায় আপনার করণীয় কী?
যখন ওয়ারিশদের মধ্যে বন্টন নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয় এবং কেউ বন্টননামা করতে রাজি না হন, তখন এর একমাত্র আইনগত সমাধান হলো:
- বন্টন মামলা (Partition Suit): আপনাকে দেওয়ানি আদালতে (Civil Court) অন্যান্য ওয়ারিশদের বিরুদ্ধে বন্টন মামলা দায়ের করতে হবে। আদালতের মাধ্যমে সম্পত্তি ভাগ করার আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
ডিক্রি ব্যবহার: আদালত যখন সম্পত্তির বন্টন করে একটি চূড়ান্ত ডিক্রি (Final Decree) প্রদান করবে, সেই ডিক্রিটিই রেজিস্টার্ড বন্টননামা দলিলের মতো কাজ করবে। আপনি পরবর্তীতে সেই আদালতের ডিক্রি ব্যবহার করে আপনার অংশের জন্য সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে পৃথকভাবে নামজারির আবেদন করতে পারবেন।




