বৈষম্য । দাবীর খতিয়ান । পুন:বিবেচনা

সরকারি চাকরিজীবীদের ইনক্রিমেন্ট সংকট ২০২৫ । জাতীয় বেতন স্কেল সংস্কারের জরুরি দাবি কেন উঠছে?

২০১৫ সালের বেতন স্কেল কার্যকর হওয়ার পর থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের একটি বড় অংশ, বিশেষ করে যারা তাদের বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছেছেন, তারা নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে, তারা একদিকে যেমন আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, অন্যদিকে তেমনি কর্মজীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তাদের মনোবলও ভেঙে যাচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করলেও তা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।– সরকারি চাকরিজীবীদের ইনক্রিমেন্ট সংকট ২০২৫

ইনক্রিমেন্ট বন্ধের কারণ ও ভুক্তভোগীদের হতাশা কোথায়? ২০১৫ সালের বেতন স্কেলে আগের মতো পরবর্তী গ্রেডে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উন্নীত হওয়ার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে, অনেক সরকারি কর্মচারী তাদের কর্মজীবনের শেষ ৫ থেকে ৬ বছরে বা তারও আগে বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছে যান। এরপর থেকে তাদের আর কোনো বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট যোগ হয় না। অথচ এই সময়টায় তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পায় এবং অবসরের প্রস্তুতি নিতে হয়। দীর্ঘকাল ধরে একই বেতনে থাকার কারণে অনেক কর্মচারী হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন এবং এটি তাদের কর্মদক্ষতার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অনেকে ইনক্রিমেন্ট না পেয়েই অবসরে চলে গেছেন, যা তাদের পেনশনকেও প্রভাবিত করছে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ এবং এর সীমাবদ্ধতা কি? জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এই সমস্যার সমাধানে সুপারিশ করেছে যে, সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছানোর পর কোনো কর্মচারী যদি দুই বছর একই ধাপে থাকেন, তবে তাকে পরবর্তী উপরের গ্রেডের বেতন দেওয়া যেতে পারে। এই সুপারিশটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও, ভুক্তভোগীদের মতে এতে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ধাপের স্বল্পতা আপনার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০তম থেকে ৮ম গ্রেড পর্যন্ত অধিকাংশ স্কেলে সর্বোচ্চ ধাপের বেতন পরের গ্রেডের শেষ ধাপের প্রায় সমান। এর ফলে, একজন কর্মচারী দুই বছর অপেক্ষা করে পরবর্তী গ্রেডে উন্নীত হলেও তার বেতন খুব বেশি বাড়ছে না। এটি সমস্যার একটি আংশিক সমাধান মাত্র।

আপনার প্রস্তাবিত সমাধান: বেতন স্কেলের ধাপ বৃদ্ধির যৌক্তিকতা কি? এই সমস্যার একটি কার্যকর সমাধান হিসেবে আপনি বেতন স্কেলের ধাপগুলো বাড়ানোর যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা বেশ যৌক্তিক। আপনার প্রস্তাব অনুযায়ী, যদি নিম্নোক্ত ধাপগুলো যুক্ত করা হয়, তবে এটি আরও বেশি সংখ্যক কর্মচারীকে উপকৃত করবে:

  • ২০ থেকে ৮ম গ্রেড: এই গ্রেডগুলোতে আরও ৩টি করে ধাপ যুক্ত করা।
  • ৭ম গ্রেড: ২টি ধাপ বাড়ানো।
  • ৬ষ্ঠ, ৫ম ও ৪র্থ গ্রেড: যথাক্রমে ৩টি, ২টি ও ২টি ধাপ বাড়ানো।
  • ৩য় ও ২য় গ্রেড: ১টি করে ধাপ বাড়ানো।

এই পদ্ধতি কার্যকর হলে বেতন স্কেলের সিলিং-এ পৌঁছানো কর্মচারীরা ইনক্রিমেন্ট পেতে থাকবেন এবং তাদের আর্থিক ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। এই প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হলে এটি বিদ্যমান সমস্যার একটি টেকসই সমাধান হতে পারে। তবে, ১ম গ্রেডের ক্ষেত্রে ধাপ বাড়ানোর সুযোগ না থাকলেও এই পর্যায়ের চাকরিজীবীদের মেয়াদ সাধারণত কম থাকে।

বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের জন্য জাতীয় বেতন স্কেল, ২০১৫ অনুযায়ী, প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট তারিখে (সাধারণত ১লা জুলাই) তাদের মূল বেতনের ওপর একটি স্বয়ংক্রিয় বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) যুক্ত হয়। এই ইনক্রিমেন্ট সাধারণত ৫% হয়ে থাকে। তবে, এই ইনক্রিমেন্ট শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট গ্রেডের বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ ধাপ (সিলিং) পর্যন্ত প্রযোজ্য। যখন কোনো কর্মচারী এই সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যান, তখন তাঁর মূল বেতন আর বাড়ে না।

সাবেক কর্মচারীদের অন্তর্ভুক্তির দাবি? হ্যাঁ। এই প্রস্তাবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো যারা ইতোমধ্যেই পিআরএল বা অবসরে চলে গেছেন, তাদেরও এই সুবিধার আওতায় আনা। যদি এই বর্ধিত ধাপগুলো ২০১৫ সালের বেতন স্কেল কার্যকরের তারিখ থেকে কার্যকর করা হয়, তবেই তারা এই সুবিধা পাবেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। এটি একটি ন্যায্য দাবি, যা বাস্তবায়িত হলে অনেক অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী উপকৃত হবেন।

Caption: Increment Chart 2015

ইনক্রিমেন্ট চার্টে সমস্যা কোথায়? সামগ্রিকভাবে, এই চার্টটি ইনক্রিমেন্ট এবং পদোন্নতির যে চিত্র তুলে ধরে, তাতে দেখা যায় যে, সরকারি কর্মচারীদের একটি বড় অংশের জন্য চাকরির শেষ প্রান্তে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই। এটিই এই বেতন স্কেলের সবচেয়ে বড় সমস্যা।

  1. সীমিত ধাপ এবং ইনক্রিমেন্ট স্থবিরতা: এই চার্টে প্রতিটি গ্রেডের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক ধাপ রয়েছে। একজন কর্মচারী যখন তার গ্রেডের সর্বশেষ ধাপে পৌঁছান, তখন তার আর কোনো বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট যোগ হয় না। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন কর্মচারী ১৫তম গ্রেডে যোগ দেন এবং ২০ বছরে তার বেতন ১০,৮০০ টাকা থেকে ১৪তম ধাপের ১৯,৮৬০ টাকায় পৌঁছায়, তখন তার বেতন আর বাড়বে না। এটি বিশেষ করে সেইসব কর্মচারীদের জন্য একটি বড় সমস্যা, যারা তাদের চাকরির শেষ পর্যায়ে (সাধারণত ৫-১০ বছর) এসে এই সিলিংয়ে পৌঁছে যান। এর ফলে, তারা আর্থিক ক্ষতির শিকার হন এবং অবসরের পর তাদের পেনশনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

     

  2. টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বিলুপ্তি: ২০১৫ সালের বেতন স্কেলে আগের প্রচলিত টাইম স্কেল এবং সিলেকশন গ্রেড ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। পূর্বে, যদি কোনো কর্মচারী একটি নির্দিষ্ট সময় (যেমন ৮ বা ১২ বছর) একই পদে বা গ্রেডে কাজ করতেন, তবে তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে উচ্চতর গ্রেডে উন্নীত হতে পারতেন। এই সুবিধাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই একই গ্রেডে দীর্ঘদিন কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন, যা তাদের কর্মজীবনের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।

     

  3. নিম্ন গ্রেডে ইনক্রিমেন্টের স্বল্পতা: আপনার চার্টটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০ থেকে ১২তম গ্রেডে ইনক্রিমেন্টের পরিমাণ অনেক কম। এ কারণে, একজন কর্মচারী দীর্ঘদিন ধরে ইনক্রিমেন্ট পেলেও তার মূল বেতনে খুব বেশি পার্থক্য হয় না। এতে করে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীরা আর্থিক দিক থেকে তেমন লাভবান হতে পারেন না এবং তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়।

দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান কেন?

সরকারি কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা এখন সরকারের কাছে এই সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছেন। এই সমস্যাটি দীর্ঘদিনের এবং এর সমাধানে কোনো বিলম্ব হলে তা সরকারি কর্মচারীদের কর্মোদ্দীপনাকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। নতুন বেতন কমিশন যখন কাজ করছে, তখন এই বিষয়গুলোকে নতুন বেতন কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করে দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

সিলিং এ পৌছে যাওয়াদের নিয়ে নতুন পে স্কেলে কেমন সমাধান আসা উচিত? নতুন পে স্কেল বা বেতন কাঠামোতে সিলিংয়ে পৌঁছে যাওয়া সরকারি কর্মচারীদের সমস্যার সমাধানে কয়েকটি কার্যকর ও টেকসই পদ্ধতি বিবেচনা করা যেতে পারে। শুধুমাত্র ইনক্রিমেন্ট বন্ধ না করে তাদের জন্য এমন একটি ব্যবস্থা থাকা উচিত, যা তাদের কর্মজীবনের শেষ পর্যায়েও কাজের প্রতি আগ্রহ ধরে রাখে এবং আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বর্ধিত ধাপ বা ‘টাইম স্কেল’ পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। ২০১৫ সালের বেতন স্কেলে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বন্ধ করে দেওয়ায় এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। নতুন পে স্কেলে এই সমস্যা সমাধানের জন্য একটি আধুনিক রূপরেখা তৈরি করা যেতে পারে। যেমন:

ধাপ বৃদ্ধি: আপনার প্রস্তাবিত সমাধান অনুযায়ী, প্রতিটি গ্রেডের ধাপ সংখ্যা যৌক্তিকভাবে বাড়ানো যেতে পারে। বিশেষ করে, ২০ থেকে ৮ম গ্রেড পর্যন্ত ৩টি এবং অন্যান্য উপরের গ্রেডগুলোতে ২-১টি করে অতিরিক্ত ধাপ যুক্ত করা। এর ফলে, কর্মচারীরা ইনক্রিমেন্ট পেতে থাকবেন এবং সিলিংয়ে পৌঁছানোর সময়সীমা আরও দীর্ঘ হবে।

সয়ংক্রিয় গ্রেড আপগ্রেডেশন: সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছানোর পর নির্দিষ্ট সময় (যেমন ২ বা ৩ বছর) অতিবাহিত হলে কর্মচারীদেরকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেডে উন্নীত করার একটি বিধান রাখা যেতে পারে। এটি প্রচলিত টাইম স্কেলের একটি উন্নত সংস্করণ হতে পারে।

কর্মদক্ষতার ওপর ভিত্তি করে বিশেষ ইনসেনটিভ বা ভাতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? শুধু সময় নয়, কর্মদক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকেও মূল্যায়ন করা উচিত।পারফরম্যান্স- ভিত্তিক ইনক্রিমেন্ট সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছানোর পরও কর্মচারীদের জন্য পারফরম্যান্স-ভিত্তিক ইনক্রিমেন্টের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বার্ষিক কর্মমূল্যায়ন (Annual Performance Report – APR) অনুযায়ী যারা নির্ধারিত মানদণ্ড পূরণ করবেন, তারা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ইনক্রিমেন্ট হিসেবে পাবেন। এতে কাজের প্রতি তাদের আগ্রহ বজায় থাকবে। বিশেষ ভাতা সিলিংয়ে পৌঁছে যাওয়া কর্মচারীদের জন্য একটি বিশেষ “অভিজ্ঞতা ভাতা” বা “সিনিয়র ইনসেনটিভ” চালু করা যেতে পারে। এই ভাতা বেতনের ওপর একটি নির্দিষ্ট হারে যোগ হবে, যা তাদের দীর্ঘদিনের চাকরির স্বীকৃতি হিসেবে কাজ করবে।

পেনশন এবং অন্যান্য সুবিধা উন্নত করতে হবে

চাকরির শেষ প্রান্তে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।পেনশন গণনা পদ্ধতি পরিবর্তন: সিলিংয়ে আটকে থাকার কারণে পেনশন প্রাপ্তিতে যে ক্ষতি হয়, তা পুষিয়ে দেওয়ার জন্য পেনশন গণনা পদ্ধতি সংস্কার করা যেতে পারে। যেমন: শেষ বেতনের পরিবর্তে শেষ কয়েক বছরের গড় বেতন ধরে পেনশন গণনা করা।স্বাস্থ্য বীমা: নতুন পে স্কেলে সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি সার্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এতে কর্মজীবনের শেষ দিকে এসে চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে যে দুশ্চিন্তা থাকে, তা অনেকাংশে দূর হবে।
এসব পরিবর্তন কার্যকর করা হলে এটি শুধু সিলিংয়ে পৌঁছে যাওয়া কর্মচারীদের সমস্যার সমাধান করবে না, বরং নতুন প্রজন্মের সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যেও একটি ইতিবাচক বার্তা দেবে যে, সরকার তাদের কর্মজীবনের প্রতিটি ধাপকে গুরুত্ব দেয়।

Alamin Mia

আমি একজন সরকারী চাকরিজীবি। দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ চাকুরির সুবাদে সরকারি চাকরি বিধি বিধান নিয়ে পড়াশুনা করছি। বিএসআর ব্লগে সরকারি আদেশ, গেজেট, প্রজ্ঞাপন ও পরিপত্র পোস্ট করা হয়। এ ব্লগের কোন পোস্ট নিয়ে প্রশ্ন থাকলে বা ব্যাখ্যা জানতে পোস্টের নিচে কমেন্ট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *