সর্বশেষ প্রকাশিত পোস্টসমূহ

৯০-৯৭% বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ ২০২৫ । সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন বেতন কাঠামোর খসড়া চূড়ান্ত?

সরকারি কর্মচারীদের জন্য গঠিত জাতীয় বেতন কমিশন আজ সোমবার (২০ অক্টোবর) নতুন বেতন নির্ধারণের খসড়া প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে। প্রস্তাবটিতে গত ১০ বছরের ব্যবধানে সরকারি কর্মচারীদের মূল বেতন ৯০ থেকে ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের বেতন বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত এই কমিশন নির্ধারিত সময়ের আগেই আগামী ডিসেম্বরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে চায়।

খসড়া প্রস্তাবে গ্রেডভিত্তিক মূল বেতনের ব্যাপক বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। প্রস্তাব অনুযায়ী, সর্বোচ্চ গ্রেড-১ এর কর্মকর্তাদের জন্য মাসিক মূল বেতন নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার ৫৯৪ টাকা। সর্বনিম্ন গ্রেড-২০ এর কর্মচারীদের জন্য মূল বেতন প্রস্তাব করা হয়েছে ১৫ হাজার ৯২৮ টাকা।

জাতীয় বেতন কমিশন খসড়া কাঠামোতে মূল্যস্ফীতি এবং কর্মচারীদের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছে। কমিশন একইসাথে ২০৩০ সালে মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় বেতন কত বাড়তে পারে, সে সংক্রান্ত একটি সুপারিশও প্রদান করছে।

গত ২৭ জুলাই অন্তর্বর্তী সরকার সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর জাতীয় বেতন কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন দ্রুততার সাথে খসড়া প্রস্তাব চূড়ান্ত করলো, যা সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে।

নতুন বেতন কাঠামোতে বিভিন্ন গ্রেডে প্রস্তাবিত মূল বেতনের তালিকা নিচে দেওয়া হলো:

জাতীয় বেতন কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত নতুন বেতন কাঠামো (খসড়া)

গ্রেডপ্রস্তাবিত মূল বেতন (টাকায়)
গ্রেড-১১,৫০,৫৯৪
গ্রেড-২১,২৭,৪২৬
গ্রেড-৩১,০৯,০৮৪
গ্রেড-৪৯৬,৫৩৪
গ্রেড-৫৮৩,০২০
গ্রেড-৬৬৮,৫৩৯
গ্রেড-৭৫৫,৯৯০
গ্রেড-৮৪৪,৪০৬
গ্রেড-৯৪২,৪৭৫
গ্রেড-১০৩০,৮৯১
গ্রেড-১১২৪,১৩৪
গ্রেড-১২২১,৮১৭
গ্রেড-১৩২১,২৩৮
গ্রেড-১৪১৯,৬৯৩
গ্রেড-১৫১৮,৭২৮
গ্রেড-১৬১৭,৯৫৫
গ্রেড-১৭১৭,৩৭৬
গ্রেড-১৮১৬,৯৯০
গ্রেড-১৯১৬,৪৪১
গ্রেড-২০১৫,৯২৮
সূত্র: চ্যানেল ২৪

এতে বৈষম্য কতটা বাড়বে?

জাতীয় বেতন কমিশনের এই খসড়া প্রস্তাবে বেতন বৃদ্ধির হার উচ্চ শতাংশে দেখানো হলেও (৯০ থেকে ৯৭ শতাংশ), টাকার অঙ্কে এই বৃদ্ধি উচ্চ গ্রেড এবং নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের মধ্যে বিশাল পার্থক্য সৃষ্টি করবে, যা সমাজে এবং প্রশাসনে বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।

১. টাকার অঙ্কে বৈষম্য বৃদ্ধি:

সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গ্রেডের বেতনের প্রস্তাবিত পার্থক্য বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়:

  • সর্বোচ্চ গ্রেড-১: প্রস্তাবিত মূল বেতন ১,৫০,৫৯৪ টাকা।
  • সর্বনিম্ন গ্রেড-২০: প্রস্তাবিত মূল বেতন ১৫,৯২৮ টাকা।
  • বেতন অনুপাত: এই প্রস্তাব অনুযায়ী, গ্রেড-১ এর কর্মকর্তা গ্রেড-২০ এর কর্মচারীর চেয়ে প্রায় ৯.৪৭ গুণ বেশি মূল বেতন পাবেন।

পূর্ববর্তী কাঠামোতে এই অনুপাত (বা সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের পার্থক্য) কত ছিল, তার ওপর নির্ভর করবে বৈষম্য কতটা বাড়ল। কিন্তু টাকার অঙ্কে এই বিপুল পরিমাণ ব্যবধান (প্রায় ১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৬৬ টাকা) সমাজে আর্থিক বৈষম্যকে আরও গভীর করবে।

২. উচ্চ গ্রেডের জন্য জীবনযাত্রার মানের পার্থক্য:

গ্রেড-১ থেকে গ্রেড-৯ পর্যন্ত উচ্চ বেতনের কর্মকর্তারা কেবল মূল বেতনই বেশি পাবেন না, একইসাথে তারা আনুষঙ্গিক সুবিধা (যেমন: বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা ইত্যাদি) মূল বেতনের ওপর ভিত্তি করে অনেক বেশি পাবেন।

  • গ্রেড-১ ও গ্রেড-২০ এর বাড়ি ভাতার পার্থক্য: যদি নিয়ম অনুযায়ী বাড়ি ভাড়া মূল বেতনের একটি নির্দিষ্ট শতাংশ হয়, তবে ১.৫ লক্ষ টাকার ওপর ধার্য হওয়া বাড়ি ভাড়া ১৫ হাজার টাকার ওপর ধার্য হওয়া বাড়ি ভাতার চেয়ে বহুগুণ বেশি হবে। এতে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে মূল বেতনের প্রস্তাবিত বৃদ্ধি সামান্যই ভূমিকা রাখবে, অন্যদিকে উচ্চ গ্রেডের কর্মকর্তারা সহজেই মূল্যস্ফীতিকে ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হবেন।

৩. মধ্যম ও নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের অসন্তোষ:

প্রস্তাবে গ্রেড-৯ (প্রথম শ্রেণির প্রবেশ পদ) এবং তার নিচের গ্রেডগুলোর মধ্যে বেতন পার্থক্য অপেক্ষাকৃত কম রাখা হয়েছে, যা নিম্ন ও মধ্যম গ্রেডের কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে:

  • গ্রেড-১৮ (১৬,৯৯০ টাকা) ও গ্রেড-২০ (১৫,৯২৮ টাকা) এর মধ্যে পার্থক্য মাত্র ১,০৬২ টাকা।
  • গ্রেড-৯ (৪২,৪৭৫ টাকা) ও গ্রেড-১০ (৩০,৮৯১ টাকা) এর মধ্যে পার্থক্য প্রায় ১১,৫০০ টাকা।

এই সামান্য পার্থক্য নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের দক্ষতা ও গ্রেড পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিশেষ উৎসাহ নাও দিতে পারে।

এই খসড়া প্রস্তাবটি সাধারণভাবে বেতন বাড়ালেও, টাকার অঙ্কের বিশাল ব্যবধানের কারণে উচ্চ ও নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের মধ্যে বৈষম্য উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। এই বৈষম্য কেবল অর্থনৈতিক নয়, প্রশাসনিক ও সামাজিক মর্যাদা (Status) ভিত্তিক বৈষম্যকেও আরও প্রকট করে তুলবে। কমিশনের উচিত ছিল নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত আরও কমিয়ে আনার চেষ্টা করা।

আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে কি বৈষম্য দূর করা গেল না?

আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সরাসরি বেতন কাঠামোয় বৈষম্য দূর করতে না পারার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে। বেতন কমিশন গঠন এবং কাঠামো চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়াটি স্বভাবতই একটি আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়, যেখানে কয়েকটি মূল সমস্যা কাজ করে:

১. উচ্চ গ্রেডের প্রভাব ও স্বার্থের সংঘাত (Influence of Higher Grades)

জাতীয় বেতন কমিশনের প্রধান এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সাধারণত উচ্চপদস্থ আমলা (সচিব/সাবেক সচিব পদমর্যাদার) হয়ে থাকেন। বেতন কাঠামো নির্ধারণের সময় তাদের মধ্যে নিজেদের এবং তাদের সমপর্যায়ের কর্মকর্তাদের স্বার্থ রক্ষা করার একটি স্বাভাবিক প্রবণতা কাজ করে।

  • স্বার্থের অগ্রাধিকার: অনেক ক্ষেত্রে, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা চান যেন তাদের বেতন বৃদ্ধি শতাংশের হিসেবে নয়, বরং টাকার অঙ্কে বিপুল পরিমাণে বাড়ে, যাতে সামগ্রিক সুবিধাদি (বিশেষ করে বাড়িভাড়া ও অন্যান্য ভাতা) অনেক বেশি হয়। এই মানসিকতার কারণে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত কমানোর দিকে খুব বেশি মনোযোগ দেওয়া হয় না।

২. কাঠামোগত স্থিতিশীলতা বজায় রাখার চেষ্টা (Maintaining Structural Hierarchy)

আমলাতন্ত্রে গ্রেড-ভিত্তিক কঠোর পদমর্যাদা এবং ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কাঠামো রয়েছে। বেতন কাঠামো এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে এই পদমর্যাদার কঠোর অনুক্রম (hierarchy) প্রতিফলিত হয়।

  • ঐতিহ্যগত অনুপাত: কমিশনগুলো প্রায়শই পূর্ববর্তী বেতন স্কেলগুলোর সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত (Ratio) পুরোপুরি ভেঙে দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়। তারা মনে করে, অনুপাত খুব বেশি কমালে প্রশাসনে গ্রেডভিত্তিক শৃঙ্খলায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উৎসাহ কমে যেতে পারে। এটি কাঠামোর স্থিতিশীলতা রক্ষার নামে বৈষম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।

৩. সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রিতা ও রক্ষণশীলতা (Bureaucratic Inertia)

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেকোনো বড় ধরনের পরিবর্তন, যেমন বৈষম্য কমানোর জন্য সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত নাটকীয়ভাবে কমানো, তা সহজে অনুমোদিত হয় না।

  • দীর্ঘসূত্রিতা: বৈষম্য দূর করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশগুলো বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পর্যালোচনা এবং অনুমোদনের সময় পিছিয়ে যায় বা বাতিল হয়ে যায়
  • রক্ষণশীল মনোভাব: আমলাতন্ত্রের অভ্যন্তরে একটি রক্ষণশীল মনোভাব কাজ করে, যা প্রচলিত নিয়মের বাইরে যেতে চায় না। ফলে বৈষম্য দূর করার সাহসী বা উদ্ভাবনী পদক্ষেপগুলো প্রায়শই আমলাতান্ত্রিক জটিলতার বেড়াজালে আটকে যায়।

৪. রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব (Lack of Political Will)

যদিও কমিশন আমলাদের দ্বারা গঠিত, কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনুমোদন সাপেক্ষ। রাজনৈতিক নেতৃত্বের যদি বৈষম্য দূর করার দৃঢ় সদিচ্ছা না থাকে, তবে তারা আমলাতন্ত্রের জমা দেওয়া রক্ষণশীল বা পক্ষপাতদুষ্ট কাঠামোকেই গ্রহণ করে নিতে পারে। আমলারা তখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে সামনে রেখে নিজেদের সুবিধাজনক কাঠামোকে বৈধতা দিতে পারে।

সুতরাং, বলা যায় যে, জাতীয় বেতন কমিশন সাধারণত আমলাতন্ত্রের অভ্যন্তর থেকে পরিচালিত হয়। এই আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উচ্চ গ্রেডের স্বার্থ রক্ষা এবং পদমর্যাদার কঠোর অনুক্রম বজায় রাখার প্রবণতা প্রবল থাকে, যা কার্যকরভাবে বৈষম্য দূর করার পথে প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করে।

Alamin Mia

আমি একজন সরকারী চাকরিজীবি। দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ চাকুরির সুবাদে সরকারি চাকরি বিধি বিধান নিয়ে পড়াশুনা করছি। বিএসআর ব্লগে সরকারি আদেশ, গেজেট, প্রজ্ঞাপন ও পরিপত্র পোস্ট করা হয়। এ ব্লগের কোন পোস্ট নিয়ে প্রশ্ন থাকলে বা ব্যাখ্যা জানতে পোস্টের নিচে কমেন্ট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *