নতুন পে স্কেলের প্রস্তাব ২০২৫ । ১:৪ অনুপাত, ১২ গ্রেডে সর্বনিম্ন ৩৫,০০০ টাকা বেতন কাঠামোর জোরালো দাবি সরকারি কর্মচারীদের?
নতুন পে স্কেলের প্রস্তাব: ১:৪ অনুপাত, ১২ গ্রেডে সর্বনিম্ন ৩৫,০০০ টাকা বেতন- সরকারি কর্মচারীদের জন্য বেতন কাঠামো পরিবর্তনের জোরালো দাবি:জাতীয় পে কমিশন-২০২৫ (প্রস্তাবিত) এর অধীনে সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি নতুন বেতন কাঠামো কার্যকরের আলোচনা চলছে, যেখানে ১২টি গ্রেড এবং ১:৪ অনুপাত বজায় রেখে সর্বনিম্ন ৩৫,০০০ টাকা বেতনের প্রস্তাব সামনে এসেছে। সংযুক্ত ছবিতে এই প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোতে গ্রেডভিত্তিক মূল বেতনের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যমান ২০টি গ্রেড থেকে কমিয়ে ১২টি গ্রেড প্রবর্তনের দাবি জানানো হচ্ছে, যা সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে বিরাজমান বেতন বৈষম্য দূরীকরণে সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রস্তাবিত কাঠামোর প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
সংযুক্ত ছবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোতে গ্রেড (১ থেকে ২০) এবং তার বিপরীতে তিনটি ভিন্ন পে-কোডের (১-২০, ১-১৬, ১-২২) অধীনে মূল বেতনের হিসাব দেখানো হয়েছে। যদিও শিরোনামে ১:৪ অনুপাত এবং ১২টি গ্রেডের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু ছকে গ্রেড ১ থেকে ২০ পর্যন্ত মূল বেতনের তথ্য দেখানো হয়েছে, যা বর্তমান গ্রেডিং পদ্ধতির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। তবে, সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন ফোরাম থেকে ১২টি গ্রেডের কাঠামোতে সর্বনিম্ন ৩৫,০০০ টাকা বেতনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
- ১:৪ অনুপাত: সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠন সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত ১:৪ করার দাবি জানিয়েছে। এর অর্থ হলো, সর্বনিম্ন গ্রেডের বেতন যদি এক টাকা হয়, তবে সর্বোচ্চ গ্রেডের বেতন হবে চার টাকা। এই অনুপাতটি বৈষম্য কমাতে সহায়ক হবে।
- সর্বনিম্ন বেতন: সংযুক্ত ছবিতে যদিও সরাসরি ৩৫,০০০ টাকা দেখা যাচ্ছে না, তবে বিভিন্ন সূত্র এবং কর্মচারী সংগঠনের দাবি অনুযায়ী, নতুন পে স্কেলে সর্বনিম্ন মূল বেতন ৩৫,০০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
- গ্রেড সংখ্যা হ্রাস: সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান ২০টি গ্রেড ভেঙে ১২টি গ্রেড করার প্রস্তাবনা রয়েছে। এটি মূলত কর্মচারীদের মধ্যে স্তরগত বৈষম্য কমাতে এবং পদোন্নতির প্রক্রিয়াকে সরল করতে ভূমিকা রাখবে।
- পে-কোড ও বেতনের অঙ্ক: ছবিতে বিভিন্ন গ্রেডের বিপরীতে যে বেতনের অঙ্কগুলো দেখানো হয়েছে (যেমন: গ্রেড ০১-এ ১,১৭,০০০ টাকা, গ্রেড ২০-এ ২৫,২৫০ টাকা), তা সংশ্লিষ্ট কর্মচারী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত একটি কাঠামো হতে পারে। এই প্রস্তাবিত বেতনগুলো বর্তমান বাজারদর এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে দাবি করা হচ্ছে।
প্রস্তাবের প্রেক্ষাপট
দীর্ঘদিন ধরে সরকারি কর্মচারীরা নতুন পে স্কেল বাস্তবায়ন এবং বিদ্যমান বেতন বৈষম্য দূরীকরণের দাবি জানিয়ে আসছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বিশেষ করে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের জন্য সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, নবম পে কমিশন গঠন এবং গ্রেড সংখ্যা কমিয়ে ১:৪ অনুপাতে সর্বনিম্ন ৩৫,০০০ টাকা বেতনের প্রস্তাব, সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। এটি কার্যকর হলে কর্মচারীদের আর্থিক সচ্ছলতা বাড়বে এবং কাজের প্রতি আরও মনোযোগ দিতে উৎসাহিত হবেন বলে মনে করা হচ্ছে। তবে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সরকারের পক্ষ থেকে গেজেট প্রকাশের পরই জানা যাবে।
সরকারি কর্মচারীদের পক্ষ থেকে জোরালোভাবে উত্থাপিত ১২ গ্রেডের কাঠামো এবং ১:৪ অনুপাত-এ সর্বনিম্ন ৩৫,০০০ টাকা বেতনের প্রস্তাবটি নিম্নরূপ একটি কাঠামো দাঁড় করাতে পারে। তবে, এটি একটি প্রস্তাবিত কাঠামো, যা সরকারিভাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত পরিবর্তন হতে পারে। এই কাঠামোটি মূলত কর্মচারীদের পক্ষ থেকে করা দাবি ও অনুপাতের হিসাবের ভিত্তিতে তৈরি করা হলো:
প্রস্তাবিত নতুন পে স্কেল ২০২৫ (কর্মচারীদের দাবির ভিত্তিতে)
| প্রস্তাবিত গ্রেড (১২টি) | প্রস্তাবিত মূল বেতন (টাকা) | সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত |
| গ্রেড ১২ (সর্বনিম্ন) | ৩৫,০০০/- | ১ |
| গ্রেড ১১ | ৩৮,০০০/- | – |
| গ্রেড ১০ | ৪২,০০০/- | – |
| গ্রেড ০৯ | ৪৬,০০০/- | – |
| গ্রেড ০৮ | ৫২,০০০/- | – |
| গ্রেড ০৭ | ৫৮,০০০/- | – |
| গ্রেড ০৬ | ৬৫,০০০/- | – |
| গ্রেড ০৫ | ৭৪,০০০/- | – |
| গ্রেড ০৪ | ৮৪,০০০/- | – |
| গ্রেড ০৩ | ৯৫,০০০/- | – |
| গ্রেড ০২ | ১,১০,০০০/- | – |
| গ্রেড ০১ (সর্বোচ্চ) | ১,৪০,০০০/- | ৪ |
| সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন অনুপাত: | ১:৪ (প্রায়) |
কাঠামো বিশ্লেষণের মূল বিষয়সমূহ:
১. ১:৪ অনুপাত বজায় রাখা:
- প্রস্তাবিত সর্বনিম্ন মূল বেতন $\text{৩৫,০০০}$ টাকা ধরা হয়েছে।
- ১:৪ অনুপাত অনুযায়ী, সর্বোচ্চ মূল বেতন হবে $\text{৩৫,০০০} \times 4 = \text{১,৪০,০০০}$ টাকা।
- এই কাঠামোতে গ্রেড-০১ এর বেতন $\text{১,৪০,০০০}$ টাকা রেখে অনুপাতটি প্রায় ১:৪ বজায় রাখা হয়েছে।
২. গ্রেড সংখ্যা হ্রাস:
- বর্তমানে প্রচলিত ২০টি গ্রেড থেকে কমিয়ে মোট ১২টি গ্রেড করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো বিদ্যমান বেতন বৈষম্য দূর করা এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে জটিলতা কমানো।
৩. সর্বনিম্ন বেতন:
- বর্তমান বাজারমূল্য এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনা করে সর্বনিম্ন গ্রেডের (প্রস্তাবিত গ্রেড-১২) মূল বেতন $\text{৩৫,০০০}$ টাকা নির্ধারণের দাবি উঠেছে।
গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্য: এটি সরকারি কর্মচারীদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত একটি দাবি ও প্রস্তাবের কাঠামো মাত্র। জাতীয় বেতন কমিশন কর্তৃক সুপারিশ জমা দেওয়া এবং সরকারের চূড়ান্ত গেজেট প্রকাশের পরই প্রকৃত বেতন কাঠামো এবং গ্রেড সংখ্যা জানা যাবে।
সরকার কেন সর্বনিম্ন ৩৫০০০ টাকা বেতন দিতে চাইছে না?
সরকারি কর্মচারীদের পক্ষ থেকে সর্বনিম্ন ৩৫,০০০ টাকা (মূল বেতন) করার দাবি জোরালো হলেও, সরকার বা বেতন কমিশন কেন এই উচ্চ দাবি সরাসরি গ্রহণ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হতে পারে, তার পেছনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণ রয়েছে। যদিও সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এর বিরোধিতা করে কোনো বিবৃতি দেয়নি, তবে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো চ্যালেঞ্জ হিসেবে কাজ করে:
১. বিশাল আর্থিক চাপ ও বাজেট ঘাটতি (Fiscal Burden)
- বেতন ও ভাতার মোট ব্যয় বৃদ্ধি: প্রায় ২১ লক্ষ সামরিক-বেসামরিক সরকারি কর্মচারী, বিপুল সংখ্যক পেনশনার এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের জন্য সর্বনিম্ন বেতন ৩৫,০০০ টাকা নির্ধারণ করলে সরকারের মোট বেতন-ভাতা খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ অতিরিক্ত বরাদ্দ করতে হবে। এই বিশাল অঙ্কের বাড়তি ব্যয় দেশের বার্ষিক বাজেটে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে এবং সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অর্থের যোগান কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
- পেনশনের বোঝা: মূল বেতন বাড়লে অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের পেনশন এবং গ্র্যাচুইটির পরিমাণও আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাবে, যা দীর্ঘ মেয়াদে সরকারের ওপর বিশাল আর্থিক বোঝা সৃষ্টি করবে।
২. মূল্যস্ফীতি ও অর্থনীতির ওপর প্রভাব (Inflationary Effect)
- মুদ্রাস্ফীতি উসকে দেওয়া: সরকারি কর্মচারীদের বেতন বিপুল পরিমাণে বাড়লে বাজারে টাকার প্রবাহ হঠাৎ করে অনেক বেড়ে যায়। এর ফলে সামগ্রিকভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিতে পারে। এর প্রভাব বেসরকারি চাকরিজীবী এবং সাধারণ মানুষের ওপরও পড়ে, যা সমাজে নতুন করে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে।
- বেসরকারি খাতে প্রভাব: সরকারি বেতন বাড়লে বেসরকারি খাতকেও তাদের কর্মচারীদের বেতন বাড়াতে এক ধরনের চাপে পড়তে হয়। এটি যদি সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে না হয়, তবে পুরো অর্থনীতিতে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
৩. সর্বোচ্চ-সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত (Pay Ratio Dilemma)
- ১:৪ অনুপাত বনাম প্রচলিত অনুপাত: সরকারি কর্মচারীদের দাবি ১:৪ অনুপাত, অর্থাৎ সর্বনিম্ন ৩৫,০০০ টাকা হলে সর্বোচ্চ বেতন হবে ১,৪০,০০০ টাকা। কিন্তু বর্তমানে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত প্রায় ১:১০ বা ১:৮ এর কাছাকাছি। অনেক সময় পে কমিশন পার্শ্ববর্তী দেশ (যেমন ভারত বা পাকিস্তান)-এর অনুপাত (যা সাধারণত ১:৮ থেকে ১:১০ এর মধ্যে থাকে) পর্যালোচনা করে। কমিশন যদি ১:৮ বা ১:১০ অনুপাত বহাল রাখতে চায়, তবে সর্বনিম্ন বেতন ৩৫,০০০ টাকা হলে সর্বোচ্চ বেতন গিয়ে দাঁড়াবে ২,৮০,০০০ থেকে ৩,৫০,০০০ টাকা, যা সরকারের জন্য আরও কঠিন একটি সিদ্ধান্ত।
- বেতন বৈষম্য: সর্বনিম্ন বেতন ৩৫,০০০ টাকা করলে মধ্যম ও উচ্চ গ্রেডের কর্মকর্তারাও তাদের বেতনের আনুপাতিক বৃদ্ধি চাইবেন, যা বাস্তবায়ন করা প্রশাসনের জন্য জটিল ও ব্যয়বহুল।
৪. বর্তমান পে স্কেলের ‘দ্বিগুণ’ করার প্রবণতা
- জাতীয় বেতন কমিশনের অনেক সদস্য বা বিশেষজ্ঞ আলোচনায় ইঙ্গিত দিয়েছেন যে মূল্যস্ফীতি বিবেচনা করে বর্তমান মূল বেতনকে প্রায় দ্বিগুণ করার সুপারিশ আসতে পারে।
- যদি এই নীতি অনুসরণ করা হয়, তবে বিদ্যমান ২০তম গ্রেডের সর্বনিম্ন ৮,২৫০ টাকা মূল বেতন দ্বিগুণ হয়ে প্রায় ১৬,৫০০ টাকা হতে পারে। এই অঙ্কটি কর্মচারীদের দাবি করা ৩৫,০০০ টাকার চেয়ে অনেক কম। অর্থাৎ, সরকার সম্ভবত বর্তমান বেতনের দ্বিগুণের কাছাকাছি কোনো অঙ্ককে গ্রহণযোগ্য মনে করছে, ৩৫,০০০ টাকা নয়।
৫. রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা
- অনেক সময় সরকার হুট করে বিশাল অংকের বেতন বৃদ্ধি না করে, অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে মহার্ঘ ভাতা (Dearness Allowance) বা বিশেষ ভাতা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে চায়। এর কারণ হলো, পূর্ণাঙ্গ পে স্কেল বাস্তবায়ন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী, তাই সরকার সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে পারে।
সংক্ষেপে, সর্বনিম্ন ৩৫,০০০ টাকা বেতন প্রদানের দাবিটি বাস্তবসম্মত হলেও এর প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও বিশাল বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করা, যা অন্যান্য উন্নয়ন খাত থেকে অর্থ সরিয়ে নিতে পারে এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়াতে পারে।



