পে-স্কেলে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত ২০২৫ । ৭:১ অনুপাতে বেতন কাঠামো, সর্বনিম্ন গ্রেডে ২০ হাজার!
সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো প্রণয়নে নিয়োজিত পে কমিশন এবার বেতন স্কেলের বৈষম্য কমাতে বড় ধরনের পরিবর্তনের কথা ভাবছে। কমিশনের অভ্যন্তরে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাতকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে ৭:১ এ নামিয়ে আনার প্রস্তাব নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। এই প্রস্তাব কার্যকর হলে, ১ম গ্রেডের মূল বেতন ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা এবং ২০তম গ্রেডের সর্বনিম্ন মূল বেতন ২০ হাজার টাকা নির্ধারণ হতে পারে।
⚖️ বৈষম্য হ্রাসই প্রধান লক্ষ্য
বর্তমানে সরকারি কর্মচারীদের ২০টি গ্রেডে বিভক্ত বেতন কাঠামোতে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত তুলনামূলকভাবে বেশি, যা বেতন বৈষম্য তৈরি করে বলে মনে করা হয়। নতুন পে-কমিশনের প্রধান উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এই বৈষম্য দূর করা এবং গ্রেড সংখ্যা হ্রাস করে কাঠামোটিকে আরও যৌক্তিক ও সুষম করা।
কমিশনের একটি সূত্র থেকে জানা যায়, যদি ৭:১ অনুপাত গ্রহণ করা হয় এবং সর্বনিম্ন গ্রেডের মূল বেতন ২০,০০০ টাকা করা হয়, তবে সর্বোচ্চ গ্রেডের মূল বেতন হবে ২০,০০০ টাকা*৭ = ১,৪০,০০০ টাকা। এটি সরকারি কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত বেতন বৃদ্ধির দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষ করে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রেক্ষিতে সর্বনিম্ন গ্রেডে ২০,০০০ টাকা মূল বেতন নির্ধারণের বিষয়টি অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
📈 অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও প্রত্যাশা
এই বিপুল বেতন বৃদ্ধি সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে নিঃসন্দেহে। তবে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, মূল্যস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির কারণে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সময়োপযোগী করা জরুরি। নতুন বেতন কাঠামোতে যদি সর্বনিম্ন গ্রেডে ২০,০০০ টাকা নির্ধারণ করা যায়, তবে নিম্ন আয়ের কর্মচারীরা কিছুটা স্বস্তি পাবেন এবং তাঁদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে।
পে কমিশন বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি ও পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময় করে তাদের প্রস্তাবনা ও দাবিগুলো যাচাই করছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কমিশন তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেবে।
✅ ৭:১ অনুপারে প্রস্তাবিত সর্বনিম্ন বেতন কাঠামো (২০ গ্রেড)
আপনার প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী (সর্বোচ্চ গ্রেড: ১,৪০,০০০ টাকা, সর্বনিম্ন গ্রেড: ২০,০০০ টাকা এবং অনুপাত ৭:১), একটি প্রস্তাবিত সর্বনিম্ন মূল বেতনের কাঠামো ২০টি গ্রেডের জন্য নিচে তুলে ধরা হলো। এখানে গ্রেডগুলোর বেতন একটি গণনাভিত্তিক সমহারে (Arithmetic Progression) অনুমান করা হয়েছে, যাতে প্রতিটি গ্রেডের মধ্যে একটি যৌক্তিক ব্যবধান বজায় থাকে।
| গ্রেড | সর্বনিম্ন মূল বেতন (টাকা) |
| ১ম গ্রেড | ১,৪০,০০০ (নির্ধারিত) |
| ২য় গ্রেড | ১,৩৩,৬৩২ |
| ৩য় গ্রেড | ১,২৭,২৭৪ |
| ৪র্থ গ্রেড | ১,২০,৯১৬ |
| ৫ম গ্রেড | ১,১৪,৫৫৭ |
| ৬ষ্ঠ গ্রেড | ১,০৮,০০০ |
| ৭ম গ্রেড | ১,০১,৪৪৩ |
| ৮ম গ্রেড | ৯৪,৮৮৫ |
| ৯ম গ্রেড | ৮৮,৩২৭ |
| ১০ম গ্রেড | ৮১,৭৭০ |
| ১১তম গ্রেড | ৭৫,২১২ |
| ১২তম গ্রেড | ৬৮,৬৫৪ |
| ১৩তম গ্রেড | ৬২,০৯৭ |
| ১৪তম গ্রেড | ৫৫,৫৩৯ |
| ১৫তম গ্রেড | ৪৯,০৮১ |
| ১৬তম গ্রেড | ৪২,৫২৩ |
| ১৭তম গ্রেড | ৩৬,৯৬৫ |
| ১৮তম গ্রেড | ২৯,৪০০ |
| ১৯তম গ্রেড | ২৩,৮৪৩ |
| ২০তম গ্রেড | ২০,০০০ |
দ্রষ্টব্য: এটি কেবল একটি অনুমানভিত্তিক কাঠামো। পে কমিশন কর্তৃক চূড়ান্তভাবে গৃহীত বেতন স্কেল বা গ্রেড সংখ্যা ভিন্ন হতে পারে।
এতে কি সরকারি কর্মচারীদের প্রত্যাশা পূরণ হবে?
সংক্ষেপে বলতে গেলে, এই প্রস্তাবটি নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক হলেও, সব স্তরের কর্মচারীদের পূর্ণ প্রত্যাশা পূরণ নাও করতে পারে। বিশেষ করে বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে অন্যান্য ভাতা ও গ্রেড বৈষম্য দূরীকরণের বিষয়গুলো এখানে মূল বিবেচ্য।
১. যে কারণে প্রত্যাশা পূরণ হতে পারে (ইতিবাচক দিক)
- 📈 সর্বনিম্ন গ্রেডে বড় লাফ: ২০তম গ্রেডের মূল বেতন বর্তমানের প্রায় ৮,২৫০ টাকা থেকে সরাসরি ২০,০০০ টাকা করার প্রস্তাব নিম্ন গ্রেডের (১১-২০) কর্মচারীদের জন্য বিশাল স্বস্তির কারণ হবে। জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এত বড় অঙ্কের বৃদ্ধি তাঁদের বহুদিনের দাবি পূরণের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
- ⚖️ বৈষম্য হ্রাস: ৭:১ অনুপাত গ্রহণ করা হলে, বর্তমান ১০:১ বা এর কাছাকাছি থাকা অনুপাত থেকে এটি যথেষ্ট নিচে নেমে আসবে। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গ্রেডের মধ্যে ব্যবধান কমানোর এই উদ্যোগ বেতন বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতি সম্মান দেখাবে।
- 💸 ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি: সর্বনিম্ন বেতন ২০,০০০ টাকা হওয়ায় নিম্ন আয়ের কর্মচারীদের ক্রয়ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে, যা তাঁদের দৈনন্দিন জীবনধারণের চাপ কমাতে সাহায্য করবে।
২. যে কারণে অসন্তোষ থাকতে পারে (বিবেচ্য বিষয়)
যদিও মূল বেতন বৃদ্ধি একটি ইতিবাচক দিক, কিন্তু শুধু মূল বেতন দিয়েই কর্মচারীদের সব প্রত্যাশা পূরণ হবে না। অসন্তোষের প্রধান ক্ষেত্রগুলো হলো:
| অসন্তোষের ক্ষেত্র | কর্মচারীদের মূল দাবি | ৭:১ প্রস্তাবের প্রভাব |
| ১. সর্বনিম্ন বেতন | ১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীদের সংগঠনগুলো ন্যূনতম ৩২,০০০ টাকা থেকে ৩৫,০০০ টাকা পর্যন্ত মূল বেতনের দাবি জানিয়েছে। | প্রস্তাবিত ২০,০০০ টাকা তাঁদের দাবিকৃত অঙ্কের চেয়ে বেশ কম। ফলে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীরা পূর্ণ সন্তুষ্ট নাও হতে পারেন। |
| ২. গ্রেড সংখ্যা | সরকারি কর্মচারী ফোরামগুলো ২০টি গ্রেড ভেঙে গ্রেড সংখ্যা কমিয়ে ১০ থেকে ১৩টি করার প্রস্তাব দিয়েছে, যা বৈষম্য কমাতে আরও কার্যকর হবে। | ৭:১ অনুপাত গ্রহণ করলেও, যদি ২০টি গ্রেডই বহাল রাখা হয়, তবে গ্রেডগুলোর মধ্যে বেতন পার্থক্য খুব কম হবে এবং পদোন্নতি জটিলতা (টাইম স্কেল/সিলেকশন গ্রেড বাতিল হওয়ায়) নিয়ে অসন্তোষ বজায় থাকতে পারে। |
| ৩. বিভিন্ন ভাতা | চিকিৎসা ভাতা (বর্তমানে মাত্র ১,৫০০ টাকা), শিক্ষা ভাতা, বাড়িভাড়া এবং টিফিন ভাতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির দাবি উঠেছে। কেউ কেউ চিকিৎসা ভাতা ৫,০০০ টাকা পর্যন্ত করার দাবি জানিয়েছেন। | মূল বেতনের বাইরে এসব ভাতা যদি বাজারদর অনুযায়ী উল্লেখযোগ্য হারে না বাড়ে, তবে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে কর্মচারীরা অসন্তুষ্ট হবেন, বিশেষ করে উচ্চ গ্রেডের কর্মকর্তারা যাঁদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি। |
| ৪. টাইম স্কেল/সিলেকশন গ্রেড | বাতিল হওয়া টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহালের দাবি রয়েছে, কারণ এগুলো পদোন্নতি না হওয়া কর্মচারীদের জন্য উচ্চতর গ্রেডে যাওয়ার একমাত্র পথ ছিল। | যদি নতুন পে-স্কেলে এই সুবিধাগুলো পুনর্বহাল না করা হয়, তবে পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ থাকবেই। |
প্রস্তাবিত ১,৪০,০০০ টাকা এবং ২০,০০০ টাকা মূল বেতনের ৭:১ অনুপাতের কাঠামোটি নীতিগতভাবে বৈষম্য দূরীকরণের একটি শক্তিশালী বার্তা দেয় এবং নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের জন্য এটি একটি বড় আর্থিক স্বস্তি।
তবে, কর্মচারীদের পূর্ণ প্রত্যাশা পূরণের জন্য পে কমিশনকে শুধু মূল বেতনের অনুপাত নয়, একই সঙ্গে সর্বনিম্ন গ্রেডে দাবিকৃত বেতনের কাছাকাছি একটি অঙ্ক (যেমন ২৫,০০০+ টাকা) নির্ধারণ করা, গ্রেড সংখ্যা কমানো এবং বিশেষ করে চিকিৎসা ও শিক্ষা ভাতার মতো অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাগুলো বর্তমান মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করার সুপারিশ করতে হবে। অন্যথায়, কর্মচারীদের কিছু অংশ সন্তুষ্ট হলেও সামগ্রিক অসন্তোষ দূর করা কঠিন হবে।



