বেতন বৈষম্যের বেড়াজাল ২০২৫ । ১০ বছরেও পে-স্কেল পায়নি ক্ষুদ্র কর্মচারীরা, দাবি ১:৪ অনুপাতের?
দীর্ঘ দশ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও পে-স্কেলের সুবিধা থেকে বঞ্চিত দেশের ক্ষুদ্র কর্মচারীরা, ফলে আর্থিক সংকটে জর্জরিত তাঁদের জীবন। কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার আবেদন জানিয়েও সুরাহা না মেলায়, কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে। তাঁদের মূল দাবি—বেতন বৈষম্য দূর করে অন্তত ১:৪ অথবা ১:৬ অনুপাতে পে-স্কেল কার্যকর করা হোক।
সাধারণ কর্মচারীদের বক্তব্য, বর্তমানে যে বেতন কাঠামো রয়েছে, তাতে জীবনধারণ কঠিন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা ন্যূনতম বেতন হওয়া জরুরি। এর নিচে ২০ হাজার টাকা কোনোভাবেই কাম্য নয়, তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০ হাজার টাকার নিচে বেতন হবে না বলে তাঁরা মোটামুটি নিশ্চিত।
কেন এই বৈষম্য?
ক্ষুদ্র কর্মচারীদের অভিযোগ, বেতন বৈষম্যের কারণেই তাঁদের পে-স্কেল পেতে এত দীর্ঘ সময় লেগেছে। তাঁরা মনে করেন, যদি বৈষম্য না থাকতো, তবে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা আগেই বেতন বৃদ্ধির দাবি জানাতেন এবং এর ফলে সাধারণ কর্মচারীরা আরও অন্তত দুটি পে-স্কেল পেয়ে যেতেন। বর্তমান কাঠামোয় কর্মকর্তাদের জীবনযাত্রায় কোনো অসুবিধা না হওয়ায়, তাঁরা বেতন স্কেল নিয়ে ভাবেন না। কিন্তু ছোট কর্মচারীদের সংসার চালানো এখন রীতিমতো চ্যালেঞ্জ।
কর্মচারী ইউনিয়নের একজন নেতা বলেন, “আমাদের দুঃখ-দুর্দশা কর্মকর্তারা বোঝেন না, কারণ তাঁদের চলতে কোনো কষ্ট হয় না। বৈষম্যের কারণে আমরা বছরের পর বছর বঞ্চিত হচ্ছি। আমরা চাই ১:৪ অনুপাত, অন্ততপক্ষে ১:৬ অনুপাতের বেশি যেন না হয়। এই বৈষম্য দূর না হলে, আমাদের আর্থিক কষ্ট বাড়তেই থাকবে।”
ন্যায্য দাবির প্রতিধ্বনি
ক্ষুদ্র কর্মচারীদের এই ন্যায্য দাবি এখন সময়ের অপেক্ষা। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও আর্থিক টানাপোড়েন দূর করতে সরকার ও কর্তৃপক্ষের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করছেন তাঁরা। তাঁদের আশা, সর্বনিম্ন ২০ হাজার টাকার নিশ্চয়তা সহ একটি সম্মানজনক পে-স্কেল দ্রুত কার্যকর করা হবে, যা তাঁদের জীবনযাত্রায় কিছুটা স্বস্তি ফিরিয়ে আনবে।
দীর্ঘদিনের বেতন বৈষম্য দূরীকরণ এবং জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে দেশের ক্ষুদ্র কর্মচারীরা তাঁদের নতুন পে-স্কেলে সুনির্দিষ্ট ও বর্ধিত ভাতার দাবি পেশ করেছেন। পূর্বের দাবির ধারাবাহিকতায় তাঁরা সুস্পষ্টভাবে ৯৮,৫০০/- (আটানব্বই হাজার পাঁচশত) টাকা মোট বেতন কাঠামো ঘোষণা করেছেন। এটি এখন কর্মচারী ইউনিয়নের অন্যতম প্রধান এজেন্ডা হিসেবে সরকারের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে।
কর্মচারী নেতৃবৃন্দ মনে করেন, বর্তমান বাজারদর ও জীবনযাত্রার মান বিবেচনায় এই বেতন কাঠামো যৌক্তিক এবং অপরিহার্য। তাঁদের দাবিগুলো হলো:
কেন এই বর্ধিত দাবি?
ক্ষুদ্র কর্মচারীরা যুক্তি দিচ্ছেন, শুধু মূল বেতন বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়। বাসাভাড়া, চিকিৎসা এবং টিফিন ভাতার মতো মৌলিক প্রয়োজনগুলোর ব্যয় বহুগুণ বেড়েছে। বিশেষ করে রাজধানী ও অন্যান্য বড় শহরে ২৮,০০০/- টাকা বাসাভাড়া না হলে মানসম্মত বাসস্থান পাওয়া অসম্ভব। একই সঙ্গে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে টাকা টিফিন ভাতা এবং চিকিৎসা খাতে টাকা বরাদ্দ না থাকলে কর্মচারীদের আর্থিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। কর্মচারী ইউনিয়নের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, “এই দাবিগুলো শুধুমাত্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়, বরং বর্তমান কঠিন পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার দাবি। আমরা আশা করি, সরকার আমাদের জীবনধারণের এই বাস্তব সমস্যাটি অনুধাবন করে দ্রুত এই নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নে উদ্যোগী হবে।”
দাবিগুলোর বিষয়ে সরকারের সরাসরি প্রতিক্রিয়া কেমন, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট ঘোষণা আসেনি। তবে সরকার বর্তমানে যে পদক্ষেপগুলো নিচ্ছে, তার মধ্যে এই ধরনের কর্মচারীদের আর্থিক উন্নতির বিষয়টি উঠে এসেছে।
ক্ষুদ্র কর্মচারীদের টাকার দাবির বিপরীতে সরকারের পদক্ষেপ ও চিন্তা ভাবনা: পে কমিশন ও আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির উদ্যোগ
ক্ষুদ্র কর্মচারীরা যখন মূল বেতন টাকা সহ মোট টাকা বেতনের দাবি জানাচ্ছেন, তখন সরকারও বেতন কাঠামো নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করেছে। যদিও টাকার এই সুনির্দিষ্ট দাবি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো মন্তব্য করা হয়নি, কিন্তু পে-স্কেল সংশোধন ও বৈষম্য নিরসনের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ দৃশ্যমান।
১. পে কমিশন গঠন ও বেতন বৃদ্ধির ইঙ্গিত
সরকার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ‘জাতীয় বেতন কমিশন, ২০২৫’ গঠন করেছে। এই কমিশন আগামী ছয় মাসের মধ্যে নতুন বেতন স্কেলের সুপারিশ জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।
- বেতন দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা: কমিশন সদস্যদের ইঙ্গিতে জানা গেছে, মূল্যস্ফীতি বিবেচনা করে বর্তমান স্কেলের মূল বেতন নতুন স্কেলে দ্বিগুণ হতে পারে। যদি তা হয়, তবে সর্বনিম্ন (২০তম গ্রেড) মূল বেতন বর্তমানের টাকা থেকে বেড়ে টাকা হতে পারে। এটি আপনার দাবি করা টাকার মূল বেতনের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে কম, তবে বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি।
- কার্যকরের সময়: অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, এই নতুন বেতন কাঠামো ২০২৬ সালের শুরু (জানুয়ারি/মার্চ/এপ্রিল) থেকেই কার্যকর হতে পারে।
২. বেতন বৈষম্য নিরসনের আলোচনা
কর্মচারীদের দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ১:৪ বা ১:৬ অনুপাতের দাবির বিষয়টি সরকারের নজরে রয়েছে।
- গ্রেড কমানোর চিন্তা: কমিশন বর্তমানে থাকা ২০টি গ্রেড ভেঙে গ্রেড সংখ্যা কমানোর চিন্তা করছে। এর উদ্দেশ্য হলো, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গ্রেডের বেতনের অনুপাত (যা বর্তমানে প্রায় ) থেকে -এর মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা। এটি বাস্তবায়িত হলে গ্রেডের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বেতন বৈষম্য কিছুটা কমতে পারে।
- জনগণের মতামত গ্রহণ: কমিশন একটি অনলাইন জরিপ শুরু করেছে, যেখানে সাধারণ নাগরিক, সরকারি চাকরিজীবী এবং বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশন বেতন, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ও শিক্ষা ভাতা কত হওয়া উচিত, সে বিষয়ে মতামত দিতে পারবে।
৩. ভাতা বৃদ্ধির প্রাথমিক সিদ্ধান্ত
আপনার দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কমিশন চিকিৎসা ও শিক্ষা ভাতা বাড়ানোর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
- বর্তমানে একজন কর্মচারী মাসে টাকা চিকিৎসা ভাতা পান। কমিশন এটি বাড়ানোর পাশাপাশি অবসরোত্তর সময়ের জন্যও সুবিধা রাখার পরিকল্পনা করছে।
- আপনার দাবিতে চিকিৎসা ভাতা টাকা এবং শিক্ষা ভাতা টাকা চাওয়া হয়েছে।
৪. বিশেষ আর্থিক সুবিধা প্রদান
নতুন পে-স্কেল আসার আগেই সরকার বিশেষ আর্থিক সুবিধা (প্রণোদনা) দিয়ে রেখেছে, যা এখনও চালু আছে।
- আগামী বাজেটে ১০ম থেকে ২০তম গ্রেডভুক্ত কর্মচারীদের জন্য থেকে পর্যন্ত বিশেষ সুবিধা বা মহার্ঘ্য ভাতা দেওয়ার আলোচনা রয়েছে। এর ফলে আপাতত কর্মচারীদের হাতে কিছুটা নগদ অর্থ আসবে, যদিও এটি আপনার পূর্ণাঙ্গ দাবির বিকল্প নয়।
সংক্ষেপে: সরকার একটি নতুন বেতন কাঠামোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে, যেখানে বেতন দ্বিগুণ হওয়া, গ্রেড সংখ্যা কমানো এবং ভাতা বৃদ্ধির মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে আপনার সুনির্দিষ্টভাবে চাওয়া টাকার কাঠামোটি সরকারের পক্ষে কতটা গ্রহণ করা হবে, তা জানতে পে কমিশনের চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।