বেতন বৈষম্য দূরীকরণ ও ন্যায্য বেতন কাঠামো দাবি ২০২৫ । ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রজ্ঞাপন না এলে রাজপথে নামার হুঁশিয়ারি?
দীর্ঘদিনের বেতন বৈষম্য দূরীকরণ এবং ন্যায্য ও মানবিক বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের দাবিতে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন সরকারি কর্মচারীরা। বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠনের পক্ষ থেকে পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি, বেতন স্কেলের অনুপাত ১:৪ নির্ধারণ, সর্বনিম্ন বেতন ৩৫,০০০/- টাকা এবং গ্রেড সংখ্যা সর্বোচ্চ ১২টি করার জোরালো দাবি জানানো হয়েছে। এই দাবিগুলো আগামী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের জন্য সরকারে প্রতি আল্টিমেটাম দিয়েছেন আন্দোলনরত কর্মচারীরা।
সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, ১:১০ অনুপাতে কোনো বেতন কাঠামোই মেনে নেওয়া হবে না। তাদের দাবি, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে এই পরিবর্তনগুলো অপরিহার্য। কর্মচারীদের মূল দাবিগুলো হলো:
- সকল ব্লক পোস্টে পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি: প্রতিটি পদে পদোন্নতির সুযোগ নিশ্চিত করা।
- বেতন অনুপাত ১:৪ চাই: সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের পার্থক্য ১:৪ অনুপাতে নির্ধারণ করা।
- সর্বনিম্ন বেতন স্কেল ৩৫,০০০/- টাকা: সর্বনিম্ন বেসিক বেতন ৩৫,০০০/- টাকা নির্ধারণ করা।
- গ্রেড সংখ্যা সর্বোচ্চ ১২টি: বর্তমানে প্রচলিত ২০টি গ্রেড ভেঙে সর্বোচ্চ ১২টি গ্রেডে নামিয়ে আনা।
- ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রজ্ঞাপন চাই: আগামী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে দাবিগুলো মেনে নিয়ে নতুন বেতন কাঠামোর প্রজ্ঞাপন জারি করা।
কর্মচারী নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিভিন্ন অনলাইন সার্ভে এবং এতগুলো সংগঠনের সাথে আলোচনা করার পরও যদি বৈষম্যমূলক ও অন্যায্য বেতন কাঠামো ঘোষণা করা হয়, তবে তা হবে কর্মচারীদের সাথে চরম প্রতারণা। তারা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “যদি ১:৪ বেতন কাঠামো বাস্তবায়নে সরকার কোনো গড়িমশি করে, তাহলে সরকারি কর্মচারীদের রাস্তায় নামা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।” তাদের এই আল্টিমেটাম সরকারি বেতন কমিশন ও সংশ্লিষ্ট মহলে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
বিভিন্ন সংগঠন ও সমিতি নবম পে স্কেল প্রণয়নের জন্য জাতীয় বেতন কমিশনের কাছে একাধিক প্রস্তাব জমা দিয়েছে। এই প্রস্তাবগুলোর মূল লক্ষ্য হলো বর্তমান বেতন কাঠামোর বৈষম্য দূর করা এবং মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক প্রস্তাবিত প্রধান দাবি ও কাঠামোগুলো নিচে তুলে ধরা হলো:
| সংগঠনের নাম | মূল দাবি/প্রস্তাব | বেতন স্কেল অনুপাত | গ্রেড সংখ্যা |
| ১১-২০ গ্রেড সরকারি চাকরিজীবী ফোরাম | সর্বনিম্ন বেতন ৩২,০০০/- টাকা এবং সর্বোচ্চ ১,২৮,০০০/- টাকা নির্ধারণ। | ১:৪ (সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের মধ্যে) | ১২ থেকে ১৫টি গ্রেড |
| বাংলাদেশ আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী ফেডারেশন | ছয় সদস্যের একটি পরিবারের জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন বেতন কাঠামো। | ১:৪ | ১২টি গ্রেড |
| বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক সমিতি | সরকারি ও বেসরকারি উভয় প্রতিষ্ঠানের জন্য সমন্বিত বেতন কাঠামো প্রণয়ন। সর্বনিম্ন মূল বেতন ৪০,০০০/- টাকা এবং সর্বোচ্চ ১,৬০,০০০/- টাকা নির্ধারণ। এছাড়াও ৮০% বাড়িভাতা প্রদান। | নির্দিষ্ট অনুপাত উল্লেখ নেই (তবে ৪০,০০০:১,৬০,০০০ হিসেবে ১:৪) | বিদ্যমান ২০টি গ্রেডেই এই স্কেল কার্যকর করার প্রস্তাব |
| অর্থ বিভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতি | বেতন বৃদ্ধির হার যেন সমানুপাতিক হয় (অর্থাৎ ছোট-বড় সবার বেতন যেন সমান হারে বাড়ে)। চিকিৎসা, টিফিন ও যাতায়াত ভাতা বাড়ানো। | ১:৬ | প্রতি চার বছর অন্তর একটি গ্রেড প্রদান (বর্তমানে ১০ বছর ও ১৬ বছর পর দুটি উচ্চতর গ্রেড দেওয়া হয়)। |
| পে কমিশনের সাধারণ প্রবণতা | কমিশনের একাধিক সদস্যের মতে, অধিকাংশ প্রস্তাবেই গ্রেড সংখ্যা কমিয়ে আনা। | বৈষম্য দূরীকরণ | ১০ থেকে ১২টির মধ্যে সীমাবদ্ধ করার দাবি উঠেছে। |
উপসংহারে, প্রায় সব সংগঠনের প্রস্তাবেই বর্তমান ২০টি গ্রেড কমিয়ে ১০ থেকে ১৫টি গ্রেডের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার এবং সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের পার্থক্য অর্থাৎ বেতন অনুপাত ১:৪ করার দাবিটি প্রধান্য পেয়েছে। সর্বনিম্ন বেতনও বর্তমান স্কেলের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে ৩২,০০০/- টাকা থেকে ৪০,০০০/- টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

উচ্চতর গ্রেড এবং পদোন্নতির সুযোগ থাকবে কি?
পে কমিশনের কাছে দেওয়া প্রস্তাব এবং কর্মচারীদের মূল অসন্তোষ দূর করার লক্ষ্যে যে বিধানগুলো অন্তর্ভুক্ত হতে পারে:
| বিধান | প্রস্তাবিত পরিবর্তন | যুক্তির ভিত্তি |
| উচ্চতর গ্রেড (টাইম স্কেল) | প্রতি ৪ বছর অন্তর স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি উচ্চতর গ্রেড প্রদান। | বর্তমানে ১০ ও ১৬ বছর পর দুটি উচ্চতর গ্রেড দেওয়া হয়, যা কর্মচারীদের আর্থিক ক্ষতি ও অসন্তোষ সৃষ্টি করে। |
| ব্লক পোস্টে পদোন্নতি | সকল পদে পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি করা। | যে সকল পদে পদোন্নতির সুযোগ নেই, সেসব পদে চাকরির নির্দিষ্ট মেয়াদের পর (যেমন ৮ বছর বা ১০ বছর) গ্রেড পরিবর্তন করে উচ্চতর পদে নিয়ে যাওয়া। |
| গ্রেড সমন্বয় | জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ কর্মচারীদের মধ্যে বেতন স্কেলের বৈষম্য দূর করতে বেতন সমতাকরণ নীতি চালু করা। | সিলেকশন গ্রেড বা উচ্চতর গ্রেড জনিত কারণে সৃষ্ট জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠ বেতন বৈষম্য নিরসন। |
বাড়ি ভাড়ায় পরিবর্তন আসতে পারে কি?
চিকিৎসা ভাতা, টিফিন ভাতা, ও যাতায়াত ভাতা: দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এই ভাতাগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করার প্রস্তাব। বাড়ি ভাড়া ভাতা: অনেক সংগঠন ৮০% বাড়িভাতা দেওয়ার দাবি জানিয়েছে, যা বিবেচনা করা হতে পারে। এই সম্ভাব্য কাঠামোটি মূলত কর্মচারী সংগঠনগুলোর দাবি ও পে কমিশনের বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যের প্রতিফলন। প্রজ্ঞাপন জারি হলে চূড়ান্ত কাঠামো সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠনের দাবি এবং পে কমিশনের বৈষম্য দূর করার উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে, নতুন বেতন কাঠামোতে নিম্নলিখিত মৌলিক পরিবর্তনগুলো আসতে পারে:
কাঠামোগত পরিবর্তন (গ্রেড ও অনুপাত)
| বিষয় | বর্তমান পরিস্থিতি (জাতীয় বেতনস্কেল, ২০১৫) | প্রস্তাবিত পরিবর্তন (কর্মচারী দাবি/কমিশন প্রবণতা) |
| মোট গ্রেড সংখ্যা | ২০টি | সর্বোচ্চ ১২টি (১০ থেকে ১৫টির মধ্যে রাখার প্রবণতা) |
| সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত | ১:৪৬.৬ (গ্রেড ১:গ্রেড ২০ এর পূর্ণ স্কেলে) | ১:৪ থেকে ১:৬ এর মধ্যে (কর্মচারীদের দাবি ১:৪) |
| নতুন সর্বনিম্ন গ্রেড | গ্রেড ২০ | গ্রেড ১২ |
| নতুন সর্বোচ্চ গ্রেড | গ্রেড ১ | গ্রেড ১ |
কমিশনের প্রবণতা কি?
জাতীয় বেতন কমিশন গঠিত হয়েছে মূলত বেতন বৈষম্য কমানোর লক্ষ্য নিয়ে। কমিশনের একাধিক সদস্যের তথ্যানুযায়ী, তারা গ্রেড সংখ্যা ২০টি থেকে কমিয়ে ১০ থেকে ১২টির মধ্যে সীমাবদ্ধ করার বিষয়ে একমত, যা বৈষম্য নিরসনের একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। অতীতে জাতীয় বেতনস্কেলগুলোতে (যেমন জাতীয় বেতনস্কেল, ২০১৫) সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত সাধারণত বেশি ছিল (২০১৫ সালের স্কেলে গ্রেড ১ ও গ্রেড ২০ এর মূল বেতনের অনুপাত ছিল ১:৪৬.৬ এর কাছাকাছি, যদিও গ্রেড ১ ও গ্রেড ২০ এর শুরুর স্কেলের অনুপাত এর চেয়ে কম ছিল, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ স্কেল বিবেচনা করলে পার্থক্য অনেক বেশি)। তাই, যদি কমিশন বড় ধরনের পরিবর্তন না আনে, তবে স্বাভাবিকভাবেই অনুপাতটি ১:৪ এর চেয়ে অনেক বেশি (যেমন ১:৮ বা ১:১০ এর কাছাকাছি) হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তবে, বিভিন্ন সংগঠনের প্রবল দাবির মুখে সরকার বা পে কমিশন বৈষম্য কমানোর দিকেই মনোযোগ দেবে বলে প্রতীয়মান হয়।

