একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট ২০২৫ । রঙিন ব্যালটে প্রবাসীদেরও ভোট, ডিসেম্বরের ৫ তারিখের মধ্যে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা?
গণভোট (Referendum) হলো গণতন্ত্রে এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রস্তাব, আইন বা রাজনৈতিক বিষয়ের ওপর দেশের সব ভোটার সরাসরি ভোট দিয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করে। সহজ কথায়, এটি এমন একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে জনগণের হাতে সরাসরি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়। গণভোটের মূল বিষয়গুলো নিচে তুলে ধরা হলো:
১. সংজ্ঞা ও প্রকৃতি
সরাসরি ভোট: গণভোটের মাধ্যমে জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের (সংসদ সদস্য) মাধ্যমে নয়, বরং নিজেরাই সরাসরি একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
নির্দিষ্ট প্রস্তাব: এটি সাধারণত জাতীয় গুরুত্বের কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে আয়োজন করা হয়, যেমন—সংবিধান সংশোধন, নতুন আইন প্রণয়ন, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তন বা কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তির অনুমোদন ইত্যাদি।
‘হ্যাঁ’ বা ‘না’: ভোটারদের কাছে সাধারণত একটি প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় এবং তাদের কাছে সেই প্রস্তাবের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ অথবা বিপক্ষে ‘না’ ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকে।
২. ফলাফল
গণভোটের ফলাফল দুই ধরনের হতে পারে:
আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক (Binding): এই ধরনের গণভোটের ফলাফল মানতে সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আইনত বাধ্য থাকে।
পরামর্শমূলক (Consultative): কিছু ক্ষেত্রে গণভোটের ফলাফল শুধুমাত্র জনগণের মতামত জানার জন্য নেওয়া হয়, যা সরকারকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে, তবে সরকার তা মানতে আইনত বাধ্য নাও হতে পারে।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে গণভোটটি হতে যাচ্ছে, তা হলো ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে জনগণের সম্মতি যাচাই করা।
উপদেষ্টা পরিষদের সভায় ‘গণভোট অধ্যাদেশ, ২০২৫’ চূড়ান্ত অনুমোদনের পর আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রস্তুতি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এই যুগান্তকারী প্রক্রিয়ায় ব্যালট পেপার ভিন্ন রঙের হবে এবং প্রবাসীরাও গণভোটে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন।
মঙ্গলবার বিকালে রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ব্রিফিংকালে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব আখতার আহমেদ। তিনি জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হলেও ভোটগ্রহণে বিভ্রান্তি এড়াতে গণভোটের ব্যালট পেপার হবে রঙিন।
ভোটগ্রহণে ভিন্নতা ও প্রস্তুতি: ইসি সচিবের ঘোষণা অনুযায়ী, দুই ধরনের নির্বাচনের ব্যালট পেপারে সুস্পষ্ট পার্থক্য রাখা হবে:
জাতীয় নির্বাচনের ব্যালট: সাদা কাগজে কালো প্রতীক ব্যবহার করা হবে।
গণভোটের ব্যালট: রঙিন কাগজে দৃশ্যমান যেকোনো কালি ব্যবহার করা হবে।
তিনি আরও জানান, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট—উভয় ক্ষেত্রেই পোস্টাল ব্যালটের ব্যবস্থা থাকবে। বিশেষত, এবার প্রবাসীরাও এই গণভোটে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
ইসি সচিব বলেন, “আগামী ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। ভোটার তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পরই নির্বাচন ও গণভোট—দুয়ের প্রস্তুতি একসঙ্গে এগিয়ে যাবে।” বর্তমানে ব্যালট পেপার প্রিন্টিংয়ের বিষয়টি নিয়ে সরকারি প্রেসের সঙ্গে আলোচনা চলছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
গণভোটের মূল বিষয়: জুলাই সনদের সংস্কার প্রস্তাব
এই গণভোট মূলত ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ এর মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত কতিপয় প্রস্তাবের বিষয়ে জনগণের সম্মতি রয়েছে কি না, তা যাচাইয়ের জন্য অনুষ্ঠিত হবে।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গণভোটে চারটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাবের ওপর একটিমাত্র প্রশ্নে ভোটারদের ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ ভোট দিতে হবে। এই চারটি প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে:
জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ায় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গঠন।
আগামী জাতীয় সংসদকে দুই কক্ষবিশিষ্ট করা এবং সংবিধান সংশোধনের জন্য উচ্চকক্ষের অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা।
নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ ৩০টি ঐকমত্যপূর্ণ সংস্কার বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর বাধ্যবাধকতা।
গণভোটের জন্য ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্ধারিত একই ভোটকেন্দ্র, একই ভোটার তালিকা এবং একই নির্বাচন কর্মকর্তাদের ব্যবহার করা হবে, যাতে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সহজ হয় এবং জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়।

গণভোট অধ্যাদেশ ২০২৫ ডাউনলোড লিংক
ইতোপূর্বে কি বাংলাদেশে গণভোট হয়েছে?
জি, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আসন্ন গণভোটটি (জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত) অনুষ্ঠিত হলে এটি হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের চতুর্থ গণভোট।
বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত পূর্ববর্তী তিনটি গণভোট হলো:
| ক্রম | বছর | রাষ্ট্রপতির নাম | গণভোটের ধরন | উদ্দেশ্য | ফলাফল |
| ১ | ১৯৭৭ (৩০ মে) | রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান | প্রশাসনিক (আস্থা ভোট) | সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়া জিয়াউর রহমানের নীতি ও কার্যক্রমের প্রতি জনগণের আস্থা আছে কি না, তা যাচাই করা। | সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, ৯৮.৯% ‘হ্যাঁ’ ভোট পেয়েছিল। |
| ২ | ১৯৮৫ (২১ মার্চ) | রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ | সামরিক শাসনের গণভোট | রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এরশাদের নীতি ও কর্মসূচির প্রতি এবং নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালনের ওপর জনগণের আস্থা আছে কি না, তা যাচাই করা। | সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, ৯৪.৫% ‘হ্যাঁ’ ভোট পেয়েছিল। |
| ৩ | ১৯৯১ (১৫ সেপ্টেম্বর) | তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ | সাংবিধানিক | সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী বিলের প্রতি জনগণের সম্মতি যাচাই করা। এই সংশোধনী দ্বারা দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হয়। | ৮৩.৬% ‘হ্যাঁ’ ভোট পেয়েছিল। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। |



