আমলাতন্ত্রের চাপে বেতন কমিশন ২০২৫ । ১:৪ অনুপাত মানতে নারাজ সচিবরা, বৈষম্যযুক্ত কাঠামো নিয়ে কর্মচারীদের ক্ষোভ?
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো (পে-স্কেল) প্রণয়নের প্রক্রিয়াটি এখন আমলাতন্ত্রের প্রভাব ও ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের দাবি, সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত ১:৪ করা এবং গ্রেড সংখ্যা ২০ থেকে কমিয়ে ১২টিতে নামিয়ে আনার প্রস্তাবটি সচিব ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। মূলত আর্থিক ক্ষমতা ও কর্মচারীদের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতেই তারা বেতন কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে রাজি নন।
সচিবদের আপত্তি: ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশল
বেতন কমিশনের অভ্যন্তরীণ সূত্র এবং সংশ্লিষ্টদের আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিদ্যমান ১:১০ অনুপাত ধরে রাখতে বা সামান্য কমিয়ে ১:৮ এ রাখতে আগ্রহী। কর্মচারীদের প্রত্যাশিত ১:৪ অনুপাত বাস্তবায়িত হলে গ্রেড-১ এর কর্মকর্তার সঙ্গে গ্রেড-২০ এর কর্মচারীর বেতনের ব্যবধান অনেক কমে যাবে।
- ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব: সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা মনে করেন, বেতনের এই বিপুল ব্যবধানই তাদের পেশাগত মর্যাদা ও কর্তৃত্বের মূল ভিত্তি। অনুপাত কমে গেলে প্রশাসনের উচ্চ স্তরের প্রতিপত্তি খর্ব হবে।
- আর্থিক সুবিধা: ১:১০ অনুপাত বহাল থাকলে সর্বোচ্চ গ্রেডের বেতন সবচেয়ে বেশি হারে বাড়বে, যা কর্মকর্তাদের আর্থিক সুবিধা অনেক বাড়িয়ে দেবে।
- বিদেশি নজির: তারা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ১:৮ থেকে ১:১০ অনুপাতের নজির দেখিয়ে যুক্তি দিচ্ছেন, যা কর্মচারীদের দাবির গ্রহণযোগ্যতা কমিয়ে দিচ্ছে।
কর্মচারীদের অভিযোগ: এটি কি আমলাদের জন্য ‘উপহার’?
সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠন তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছে, সরকার জনগণের অর্থ ব্যয় করে কর্মচারীদের জন্য একটি ন্যায্য কাঠামো তৈরির পরিবর্তে সচিব ও আমলাদের স্বার্থ রক্ষায় বেশি মনোযোগী।
কর্মচারী নেতাদের অভিযোগ, পে-স্কেলের মাধ্যমে সরকার মূলত আমলাদের সন্তুষ্ট করে কর্তৃত্ববাদী প্রশাসনের ভিত্তি মজবুত করতে চাইছে। তাদের মতে, কমিশনের অনলাইন জরিপে কর্মচারীরা ১:৪ বা ১:৫ অনুপাতের পক্ষে বিপুল ভোট দিলেও, সেই মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে যদি বৈষম্যযুক্ত ১:৮ বা ১:১০ অনুপাতের কাঠামো বাস্তবায়ন করা হয়, তবে এটি কর্মচারীদের জন্য চরম হতাশা ও বঞ্চনার কারণ হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ধরনের বৈষম্যমূলক কাঠামো সমাজে আর্থিক বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দেবে এবং প্রশাসনের নিম্ন ও মধ্য স্তরের কর্মচারীদের মধ্যে কর্মস্পৃহা কমিয়ে দিতে পারে।
এমতাবস্থায়, নতুন বেতন কাঠামো চূড়ান্তকরণের সময় সরকার কর্মচারীদের ন্যায়সঙ্গত দাবিকে গুরুত্ব দেয়, নাকি আমলাতন্ত্রের চাপকে প্রাধান্য দেয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
সরকারি কর্মচারীদের দাবি ও বাজারের বাস্তবতার ভিত্তিতে, ১:৫ অনুপাতকে প্রাধান্য দিয়ে একটি প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো নিচে দেওয়া হলো, যা বিদ্যমান ২০টি গ্রেড এবং কর্মচারীদের প্রত্যাশিত সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনকে সমন্বয় করে সাজানো হয়েছে। এই কাঠামোটি মূলত কর্মচারীদের প্রত্যাশিত ১:৫ অনুপাত (সর্বনিম্ন বেতন ২৫,০০০ টাকা হলে সর্বোচ্চ বেতন ১,২৫,০০০ টাকা) এবং বাজার পরিস্থিতিকে গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো (১:৫ অনুপাত)
এই কাঠামোর মূল বৈশিষ্ট্য:
১. সর্বনিম্ন বেতন ২৫,০০০ টাকা: ২০তম গ্রেডের কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে প্রারম্ভিক মূল বেতন ২৫,০০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
২. ১:৫ অনুপাত অনুসরণ: ২০তম গ্রেডের ২৫,০০০ টাকা মূল বেতনের বিপরীতে সর্বোচ্চ গ্রেড (গ্রেড-১) এর প্রারম্ভিক মূল বেতন ১,২৫,০০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা কর্মচারীদের প্রত্যাশিত অনুপাত ১:৫ বজায় রেখেছে।
৩. নিম্ন গ্রেড একীভূতকরণ: বিদ্যমান ১৩ থেকে ২০ গ্রেডগুলোকে একটি একক গ্রেডে (ধরা যাক ‘সর্বনিম্ন গ্রেড’) একীভূত করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এর ফলে নিম্ন স্তরের গ্রেডগুলোতে পদোন্নতির সুযোগ বাড়বে এবং বৈষম্য কমবে।
৪. মধ্যবর্তী গ্রেডে বেতন বৃদ্ধি: মধ্যম স্তরের গ্রেডগুলোতে (যেমন ৯ থেকে ১২) বর্তমান বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেতন কিছুটা বেশি হারে বৃদ্ধি করা হয়েছে, যাতে দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ভালো বেতন পাওয়া যায়।
৫. ভাতা সংস্কারের সুযোগ: এই মূল বেতনের বাইরে বাড়ি ভাড়া ভাতা, চিকিৎসা ভাতা এবং শিক্ষা ভাতা বাজারের বর্তমান মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাড়ানোর সুযোগ থাকছে।
এই কাঠামোটি প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য হলো, একদিকে সরকারের আর্থিক সক্ষমতা বজায় রাখা এবং অন্যদিকে ন্যূনতম বেতনের বৈষম্য কমিয়ে সাধারণ কর্মচারীদের জন্য একটি ন্যায্য জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করা। এটি ১:৮ বা ১:১০ অনুপাতের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম বৈষম্যপূর্ণ, যা সরকারি কর্মচারীদের ক্ষোভ প্রশমনে সহায়ক হতে পারে।



