বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিকদের জীবন সংগ্রাম: বেতন, বৈষম্য ও আবাসন সংকট
ডিসেম্বরের মধ্যে বেতন কার্যক্রম সম্পন্ন ও পে-স্কেল কার্যকরের দাবি: বৈষম্য দূর করে আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিতের আবেদন- বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিকদের জীবনযাত্রা, কর্মপরিবেশ এবং আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিরলসভাবে কাজ করা এই যোদ্ধাদের একটি বড় অংশ জীবনধারণ এবং অবসরের পর মারাত্মক আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হচ্ছেন বলে জানা গেছে। বিশেষ করে বেতন স্কেল, আবাসন এবং হোম লোন সুবিধা নিয়ে তাদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও বৈষম্যের অনুভূতি তৈরি হয়েছে।
১. আর্থিক বঞ্চনা ও বেতন বৈষম্য
সৈনিকদের প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে:
ডিসেম্বরের মধ্যে সকল বাহিনীর বেতন কার্যক্রম সম্পন্নকরণ এবং ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে নতুন পে-স্কেল কার্যকর করা।
বিনা সুদে ৬০ লক্ষ টাকা জমি + হোম লোন: বর্তমানে সকল সরকারি চাকরিজীবীর জন্য হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (HBFCL) থেকে সরকার ৫% ভর্তুকি দিয়ে ৪% সুদে হোম লোন দিলেও, স্বায়ত্তশাসিত সেনাবাহিনী এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সৈনিকদের দাবি, এটি সুস্পষ্ট বৈষম্য। তাদের জন্য বিনা সুদে ৫০/৬০ লক্ষ টাকার জমি ও হোম লোন অথবা সরকার থেকে ৬৪ জেলায় ২৪ তলা ভবনে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া উচিত।
একজন সৈনিকের বক্তব্য অনুযায়ী, সামান্য ৯,০০০ টাকা বেতনের (সম্ভবত মূল স্কেলের দিকে ইঙ্গিত) উপর নির্ভর করে সংসার চালানো অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ না থাকায় (১৪-১৮ ঘণ্টা ডিউটির কারণে), তারা পরিবারকে পুষ্টিকর খাবার যেমন গরুর মাংস, ইলিশ, দুধ খাওয়াতে পারেন না এবং ধার-দেনায় চলতে বাধ্য হন।
২. কঠোর কর্মঘণ্টা ও জীবনযাত্রার মান
সৈনিকদের জীবনযাত্রার চিত্র অত্যন্ত কঠিন:
অবিরাম ডিউটি: শান্তি কালীন সময়েও তারা দিনে ১৪ থেকে ১৮ ঘণ্টা ব্যস্ত থাকেন। ঘুমের জন্য ৫-৭ ঘণ্টা সময় বরাদ্দ থাকলেও, বাকি সময়টা তাদের ‘রোবটের মতো’ অবিরাম কাজ করতে হয়।
ছুটি ও খরচ: তিন মাস পর পাওয়া ১০ দিনের ছুটিতেও রয়েছে আর্থিক চাপ। রামু থেকে পঞ্চগড় যাতায়াতের মতো দীর্ঘ পথে প্রায় ৭,০০০+ টাকা গাড়ি ভাড়া খরচ হয়। এছাড়া, আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে সামাজিক অনুষ্ঠানে তাদের ‘টাকা খরচ করে না’ এমন অপবাদ শুনতে হয়।
অবসরের পর ভয়ংকর বাস্তবতা: প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, ৮৫% অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য জমি কিনে বাড়ি করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান এবং শেষ জীবনে জীবিকার জন্য অন্যের বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড হতে বাধ্য হন।
৩. আবাসন সংকট চরমে
আবাসন সমস্যা সৈনিকদের মানসিক চাপের অন্যতম কারণ।
ভাড়া বাসার উচ্চ ব্যয়: পরিবারের সাথে বাইরে থাকলে তাদের মাসিক ১৪,০০০ থেকে ২২,০০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া দিতে হয়, যা বেতনের তুলনায় কল্পনাতীত।
সরকারি বাসায় সুযোগের অভাব: একটি ইউনিটে যেখানে ১৮০/২০০ জন সৈনিকের বাসার জন্য আবেদনকারী থাকেন, সেখানে মাত্র ৯ থেকে ১২টি বাসা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
পোস্টিং বৈষম্য: বাধ্যতামূলক পোস্টিং রোটেশন (৩ বছর পাহাড়, ৩ বছর নেয়ার স্টেশন, ৩ বছর ঢাকা) থাকা সত্ত্বেও কিছু সৈনিক লিয়াজু করে ১৫/২০ বছর বাড়ির কাছে চাকরি করেন, অন্যদিকে কিছু সৈনিককে পুরো কর্মজীবন দূরে কাটাতে হয়। এই ধরনের পোস্টিং বৈষম্য দূর করার দাবিও উঠেছে।
🔔 বিশেষজ্ঞ ও নীতি-নির্ধারকদের প্রতি আহ্বান
সৈনিকরা দেশের সবচেয়ে সুরক্ষিত এবং শৃঙ্খলাপরায়ণ বাহিনী। তাদের দীর্ঘ ও কঠিন কর্মজীবনের কথা বিবেচনা করে, তাদের জন্য আর্থিক ও আবাসন নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কেবল নৈতিক দায়িত্ব নয়, বরং বাহিনীর মনোবল ও কর্মদক্ষতা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য।
প্রদত্ত তথ্যের সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, সৈনিকদের জন্য বিনা সুদে দীর্ঘমেয়াদী হোম লোন/আবাসন ব্যবস্থা এবং যুগোপযোগী বেতন কাঠামো নিশ্চিত করা জরুরি। এছাড়া, পোস্টিং-এর ক্ষেত্রে লিয়াজু বা প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠে একটি স্বচ্ছ ও স্বয়ংক্রিয় রোটেশন পদ্ধতি চালু করা উচিত, যাতে কোনো সৈনিককেই বৈষম্যের শিকার হতে না হয়।
১৭ গ্রেডের সিভিল চাকরি হতে কি সৈনিকদের সুযোগ সুবিধা কম?
তুলনামূলকভাবে বিচার করলে, সেনাবাহিনীর সৈনিকদের সুযোগ-সুবিধা ১৭ গ্রেডের সিভিল চাকরির চেয়ে গুণগতভাবে ভিন্ন এবং ক্ষেত্রবিশেষে বেশি হলেও, আর্থিক দিক ও কর্মপরিবেশের কারণে কিছু গুরুতর অসুবিধা রয়েছে। প্রাথমিক বেতন স্কেলের দিক থেকে সৈনিক এবং সিভিল চাকরির ১৭ গ্রেডের মধ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে, কিন্তু সামগ্রিক সুবিধা ও অসুবিধাগুলো আলাদা।
📊 মূল পার্থক্য ও তুলনা
| দিক | সেনাবাহিনীর সৈনিক (শুরুতে সিপাহী) | সিভিল চাকরি (গ্রেড-১৭) |
| বেতন স্কেল (মূল) | ৯,০০০ – ২১,৮০০ টাকা (গ্রেড-১৭ এর সমতুল্য) | ৯,০০০ – ২১,৮০০ টাকা (জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী) |
| আবাসন সুবিধা | ব্যারাকে বিনামূল্যে বাসস্থান/কোয়ার্টার পাওয়ার সুযোগ (তবে চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম)। | সরকারি কোয়ার্টার পাওয়ার সুযোগ (চাহিদা বেশি)। বাইরে থাকলে বাড়ি ভাড়া ভাতা পান। |
| খাদ্য/রেশন | বিনামূল্যে রেশন সুবিধা (এটি একটি বড় আর্থিক সুবিধা)। | এই সুবিধা সিভিল চাকরিতে নেই। |
| চিকিৎসা | পরিবারসহ বিনামূল্যে চিকিৎসা ও সিএমএইচ-এ উন্নত চিকিৎসার সুবিধা। | সরকারি হাসপাতাল/স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা সুবিধা ও মাসিক চিকিৎসা ভাতা। |
| কর্মপরিবেশ | সুবিধা: সম্পূর্ণ শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন, সামরিক নিরাপত্তা ও পদোন্নতির সুনির্দিষ্ট পথ। অসুবিধা: দীর্ঘ ও কঠোর কর্মঘণ্টা (১৪-১৮ ঘণ্টা), ২৪/৭ ডিউটির বাধ্যবাধকতা, পরিবার থেকে দূরে থাকা, এবং ঝুঁকি ভাতা (ঝুঁকিপূর্ণ পদে)। | কর্মঘণ্টা তুলনামূলকভাবে কম (৮-৯ ঘণ্টা)। পারিবারিক ও সামাজিক জীবন যাপনের সুযোগ বেশি। |
| লোন/অর্থনৈতিক নিরাপত্তা | সরকারি হাউজ লোন সুবিধা (৪% সুদে ভর্তুকি) থাকে না (স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হওয়ায়)। শুধুমাত্র বাহিনীর নিজস্ব লোন সুবিধা থাকে। | সরকারি হাউজ বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশন (HBFCL) থেকে কম সুদে (৫% ভর্তুকিতে ৪%) হোম লোন পাওয়ার সুবিধা আছে। |
| বদলি/পোস্টিং | ঘন ঘন এবং বাধ্যতামূলকভাবে দুর্গম এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পোস্টিং হয়। | সাধারণত সরকারি অফিসের ধরনের উপর নির্ভর করে। তবে অপেক্ষাকৃত কম দূরবর্তী বা কম ঘন ঘন বদলি হতে পারে। |
| অবসর জীবন | সুনির্দিষ্ট পেনশন ও আনুতোষিক সুবিধা। তবে অবসরের পর আর্থিক নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থাকে (যেমনটি আপনি উল্লেখ করেছেন)। | সুনির্দিষ্ট পেনশন ও আনুতোষিক সুবিধা। |
🔑 বিশ্লেষণ
আর্থিক মূল্য ও সুবিধা: সৈনিকরা বিনামূল্যে রেশন ও বাসস্থান এবং পরিবারসহ বিনামূল্যে চিকিৎসা পান, যা টাকার অঙ্কে অনেক বড় সুবিধা এবং সিভিল ১৭ গ্রেডের কর্মচারীরা এই সুবিধাগুলো পান না। সিভিল গ্রেড-১৭ এর কর্মচারীকে বাড়ি ভাড়া ভাতা ও অন্যান্য ভাতা দিয়ে এসব খরচ বহন করতে হয়।
চাকরির প্রকৃতি: সৈনিকের চাকরি ঝুঁকিপূর্ণ ও কষ্টসাধ্য হওয়ায়, কর্মঘণ্টা ও মানসিক চাপ অনেক বেশি। আপনার পূর্বের বক্তব্যে উল্লেখিত, এই কঠোরতার বিপরীতে আবাসন ও হোম লোন বৈষম্য সৈনিকদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আবাসন ও লোন বৈষম্য: সিভিল ১৭ গ্রেডের কর্মচারীরা যেহেতু সরকারি ভর্তুকিযুক্ত গৃহঋণ পান, তাই সৈনিকদের সেই সুবিধা না পাওয়ায় অবসরের পর তাদের জমি ও বাড়ি করার স্বপ্ন পূরণে বড় ধরনের আর্থিক চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি হয়। এটিই প্রধান বৈষম্য।
মোটকথা, সৈনিকরা সরাসরি কিছু উপাদানভিত্তিক সুবিধা (রেশন, ইউনিফর্ম, বিনামূল্যে চিকিৎসা) বেশি পান, কিন্তু ১৭ গ্রেডের সিভিল কর্মচারীরা কম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, অপেক্ষাকৃত ভালো কর্মঘণ্টা এবং বিশেষ করে ভর্তুকিযুক্ত গৃহঋণের মতো বড় আর্থিক সুবিধা পাওয়ায় তাদের অবসরের পরের জীবন তুলনামূলকভাবে বেশি সুরক্ষিত হতে পারে।



