সাইনাসের সংক্রমণ কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা
মানুষের শ্বাসযন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সাইনাস। এটি মূলত খুলি বা মুখমণ্ডলের হাড়ের মধ্যে অবস্থিত ফাঁপা স্থান যা বাতাসে পরিপূর্ণ থাকে। সাইনাস আমাদের শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, মাথার ওজন কমায়, এবং কণ্ঠস্বরের ধ্বনি ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু কোনো কারণে এই সাইনাসে সংক্রমণ হলে তা বেশ কষ্টদায়ক হয়ে ওঠে। একে চিকিৎসা পরিভাষায় বলা হয় সাইনুসাইটিস বা সাইনাস ইনফেকশন।
বাংলাদেশে অনেক মানুষ এই রোগে ভোগেন, বিশেষত আবহাওয়ার পরিবর্তন, ধুলাবালি, ঠান্ডা বা অ্যালার্জির সময়। আজ আমরা জানব সাইনাসের সংক্রমণ কী, এর কারণ, উপসর্গ এবং চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে।
সাইনাস কী এবং এর কাজ
সাইনাস হলো নাকের চারপাশে অবস্থিত চার জোড়া বায়ুভর্তি ফাঁপা গহ্বর। এগুলো হলোঃ
- গালের হাড়ের নিচে
- কপালের উপরে
- চোখের মাঝখানে
- নাকের পেছনের দিকে, মাথার গভীরে
সাইনাসের ভেতরে পাতলা এক ধরনের শ্লেষ্মা ঝিল্লি থাকে যা নাকের ভিতরে বাতাসকে আর্দ্র রাখে এবং জীবাণুর প্রবেশ প্রতিরোধ করে।
সাইনাসের সংক্রমণ কী?
যখন কোনো কারণে সাইনাসের ভেতরে থাকা শ্লেষ্মা জমে যায় এবং ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস সেখানে সংক্রমণ ঘটায় তখন সেটিকে সাইনাস ইনফেকশন বা সাইনুসাইটিস বলা হয়।
এই সংক্রমণ তীব্র বা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
- Acute Sinusitis: ২–৪ সপ্তাহ স্থায়ী হয়।
- Subacute Sinusitis: প্রায় ৪–১২ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
- Chronic Sinusitis: ১২ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে থেকে যায় বা বারবার ফিরে আসে।
সাইনাস ইনফেকশনের কারণ
সাইনাস ইনফেকশনের প্রধান কারণ হলো নাকের শ্লেষ্মা নিষ্কাশনে বাধা সৃষ্টি হওয়া। এর পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে, যেমনঃ
- ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ
সর্দি, ঠান্ডা বা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো ভাইরাস সংক্রমণ থেকে সাইনাস ইনফেকশন হতে পারে। - অ্যালার্জি
ধুলাবালি, ফুলের পরাগ, বা ধোঁয়ার প্রতি সংবেদনশীলতা থাকলে সাইনাসে প্রদাহ দেখা দেয়। - নাকের গঠনগত সমস্যা
যেমন নাকের হাড় বাঁকা থাকা বা নাকের ভেতরে পলিপ থাকা। - পরিবেশগত কারণ
ধোঁয়া, দূষণ, বা শীতল ও শুষ্ক আবহাওয়াও সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। - দাঁতের সংক্রমণ
বিশেষ করে ওপরের চোয়ালের দাঁতের সংক্রমণ সাইনাসে ছড়িয়ে যেতে পারে। - ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হওয়া
যাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল যেমন: ডায়াবেটিস, এইচআইভি, তাদের মধ্যে সাইনাস ইনফেকশনের ঝুঁকি বেশি।
সাইনাস ইনফেকশনের লক্ষণ
সাইনাসের সংক্রমণের লক্ষণ অনেক সময় সাধারণ সর্দি কাশির মতো মনে হলেও তা আসলে ভিন্ন। নিচের উপসর্গগুলো দেখা দিলে সতর্ক হওয়া জরুরিঃ
- নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া বা শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া।
- মুখ বা গালের হাড়ে ব্যথা ও চাপ অনুভব করা।
- ঘন শ্লেষ্মাযুক্ত হলুদ বা সবুজ সর্দি পড়া।
- নাক বন্ধের কারণে ঘ্রাণশক্তি কমে যাওয়া।
- মাথাব্যথা বিশেষত কপাল বা চোখের আশেপাশে।
- গলা ব্যথা বা কাশি বিশেষত রাতে।
- মুখে দুর্গন্ধ বা দাঁতের ব্যথা।
- জ্বর বা শরীর ক্লান্ত লাগা।
যদি উপসর্গগুলো দুই সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয় বা বারবার ফিরে আসে তাহলে অবশ্যই একজন নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ঢাকা এর পরামর্শ নেওয়া উচিত।
সাইনাস ইনফেকশন নির্ণয়
সাইনাস ইনফেকশন নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসক সাধারণত নিচের পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করেন:
- শারীরিক পরীক্ষা
নাক, গলা এবং কান পরীক্ষা করে প্রদাহ বা সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়। - নাসাল এন্ডোস্কপি
একটি ছোট ক্যামেরা যুক্ত টিউবের মাধ্যমে নাকের ভেতরের অবস্থা দেখা হয়। - ইমেজিং টেস্ট
সাইনাসে পুঁজ, প্রদাহ বা পলিপ আছে কিনা তা বোঝা যায়। - অ্যালার্জি টেস্ট বা কালচার টেস্ট
সংক্রমণ ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকজনিত কিনা তা নির্ধারণের জন্য।
সাইনাস ইনফেকশনের চিকিৎসা
সাইনাস ইনফেকশনের চিকিৎসা রোগের ধরন ও তীব্রতার ওপর নির্ভর করে। সাধারণত নিচের চিকিৎসাগুলো কার্যকরঃ
১. নাসাল স্যালাইন ওয়াশ
গরম পানি ও লবণের দ্রবণ দিয়ে নাক পরিষ্কার রাখলে সাইনাসের মিউকাস বেরিয়ে যায় এবং প্রদাহ কমে।
২. বাষ্প গ্রহণ
প্রতিদিন কয়েকবার গরম পানির বাষ্প নেওয়া শ্বাসনালী খুলে দেয় এবং আরাম দেয়।
৩. বিশ্রাম ও পর্যাপ্ত পানি পান
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও পানি পান অত্যন্ত জরুরি।
৪. সার্জারি
যদি দীর্ঘস্থায়ী সাইনাস ইনফেকশন হয় এবং ওষুধে আরাম না মেলে, তখন সার্জারি করা হয়। সাধারণত Functional Endoscopic Sinus Surgery এর মাধ্যমে সংক্রমিত টিস্যু বা পলিপ অপসারণ করা হয়।
প্রতিরোধের উপায়
- ঠান্ডা ও ধুলাবালি থেকে নিজেকে রক্ষা করুন।
- নিয়মিত হাত মুখ ধুয়ে পরিষ্কার রাখুন।
- ঘরের বাতাস আর্দ্র রাখতে হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করুন।
- ধূমপান ও ধোঁয়াযুক্ত জায়গা এড়িয়ে চলুন।
- অ্যালার্জি থাকলে দ্রুত চিকিৎসা নিন।
- সর্দি হলে নিজে নিজে ওষুধ না খেয়ে নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এর পরামর্শ নিন।
উপসংহার
সাইনাস ইনফেকশন সাধারণত জীবনহানিকর নয়, তবে সময়মতো চিকিৎসা না করলে এটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হয়ে উঠতে পারে। পুনরাবৃত্তি এড়াতে নিজের অভ্যাসে কিছু পরিবর্তন আনুন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকুন, ঠান্ডা ও ধুলাবালি থেকে দূরে থাকুন, এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সচেষ্ট থাকুন।
যদি সাইনাসের লক্ষণগুলো দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়, তাহলে দেরি না করে একজন নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এর সঙ্গে যোগাযোগ করুন। সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে দ্রুত আরোগ্য লাভ সম্ভব এবং জীবনের মানও উন্নত হবে।


