শিক্ষক সমাজের দীর্ঘশ্বাস ২০২৫ । ‘তাচ্ছিল্যের একটা সীমা থাকা চাই’ – বেতনের অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা
দেশের অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর জীবনধারণের প্রধান অবলম্বন তাঁদের মাসিক বেতন। অথচ, বছরের পর বছর ধরে এই বেতন-ভাতা প্রাপ্তি এক চরম অনিশ্চয়তা ও মানসিক পীড়নের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাসের পর মাস ধরে বেতনের জন্য অপেক্ষা, অনির্দিষ্ট সময় ধরে ঢাকঢোল পিটিয়ে বেতনের খবর প্রকাশ—সব মিলিয়ে শিক্ষক সমাজ যেন এক ধরনের ‘তাচ্ছিল্যের’ শিকার।
😔 অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও দেনার জীবন
শিক্ষকদের একটি বিরাট অংশ (প্রায় ৯০ শতাংশ) পুরোপুরি এই বেতনের ওপর নির্ভরশীল। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, মাসের মাঝামাঝি সময়েই তাঁদের উপার্জিত অর্থ ফুরিয়ে যায়। এরপর সংসার চালাতে এবং দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে তাঁদের বাধ্য হয়ে দেনা করতে হয়, যা চাকরির শেষ দিন পর্যন্তও টেনে নিয়ে যেতে হয়।
এক শিক্ষক ক্ষোভের সঙ্গে মন্তব্য করেন, “রাষ্ট্র কি কখনও খোঁজ রাখে যে শিক্ষকদের সংসার কিভাবে চলে? সামান্য এই বেতনের ওপর নির্ভর করেই আমাদের চলতে হয়। মাসের অর্ধেক না পেরোতেই আমাদের সব অর্থ শেষ হয়ে যায়। এরপর হয় দেনা, না হয় অর্থ ও ইজ্জত—দুটোই খোয়াতে হয় সমাজের কাছে।”
💔 বেতনের অনিশ্চয়তা: ‘তাচ্ছিল্যের’ সীমা
শিক্ষকদের সবচেয়ে বড় ক্ষোভের কারণ হলো, বেতন পাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট তারিখ না থাকা। বিগত ৫৪ বছর ধরে এই একই অনিয়ম চলে আসছে। প্রতি মাসেই বেতনের অর্থ কখন ছাড় হবে, সেই খবর শুনতে হয় বারবার। শিক্ষক নেতৃবৃন্দ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি এই সমাজের স্পষ্ট দাবি, বেতন মাসের ২০ তারিখ দেওয়া হোক, তবুও তা যেন নির্দিষ্ট হয়।
শিক্ষক সমাজের পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, বেতনের খবরের জন্য মাসের পর মাস ধরে অপেক্ষা, ঘন ঘন ‘শিগগিরই বেতন হবে’ এমন আশ্বাস প্রদান—এই রীতি অবিলম্বে বন্ধ করা হোক। এটা শিক্ষকদের প্রতি এক ধরনের সামাজিক তাচ্ছিল্য।
🛠️ শিক্ষক নেতৃবৃন্দের প্রতি জরুরি আহ্বান
শিক্ষকদের এই বঞ্চনা ও অনিয়মের বিষয়ে তাঁদের নেতৃস্থানীয় সংগঠনগুলোর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। সমাজের মূল চালিকাশক্তি হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষকদের ন্যূনতম অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে, শিক্ষকরা তাঁদের নেতৃবৃন্দকে জরুরি ভিত্তিতে বিষয়টি আমলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
তাঁদের দাবি:
বেতনের তারিখ নির্দিষ্টকরণ: মাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে (যেমন: মাসের ২০ তারিখ) বেতন-ভাতা প্রদানের স্থায়ী ব্যবস্থা করতে হবে।
অপেক্ষা ও অনিশ্চয়তা দূরীকরণ: বেতনের খবর নিয়ে ঢাকঢোল পেটানো বা দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে একটি স্বয়ংক্রিয় ও নিশ্চিত প্রক্রিয়া চালু করতে হবে।
মর্যাদা নিশ্চিতকরণ: শিক্ষকদের অর্থ ও সামাজিক ইজ্জত নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
শিক্ষকরা আশা করছেন, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই সংবেদনশীল বিষয়টি অনুধাবন করে তাঁদের প্রতি সুবিচার করবেন এবং অবিলম্বে একটি নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো ও তারিখ ঘোষণা করে তাঁদের দীর্ঘদিনের এই দুরবস্থা লাঘব করবেন।
এমপিওভূক্ত সহকারী শিক্ষকগণ প্রতি মাসে কত টাকা বেতন পান?
এমপিওভুক্ত সহকারী শিক্ষকগণ যে পরিমাণ মাসিক বেতন পান, তা নির্ভর করে তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, পদের ধরন (যেমন: প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বা প্রশিক্ষণবিহীন), এবং উচ্চতর গ্রেড বা স্কেল প্রাপ্তির ওপর।
জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫ অনুসারে, মাধ্যমিক পর্যায়ের এমপিওভুক্ত সহকারী শিক্ষকদের বেতনের মূল কাঠামোটি সাধারণত নিম্নরূপ:
১. মূল বেতন (Basic Pay)
প্রশিক্ষণবিহীন সহকারী শিক্ষক: সাধারণত ১৬,০০০ টাকা (জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫ এর গ্রেড-১০)।
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক: সাধারণত ১২,৫০০ টাকা (জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫ এর গ্রেড-১১) থেকে শুরু হয়। তবে, বিএড (B.Ed.) স্কেল বা উচ্চতর স্কেল প্রাপ্তির পর তাঁদের মূল বেতন ২২,০০০ টাকা (গ্রেড-৯) বা তারও বেশি হতে পারে।
কৃষিশিক্ষা, শারীরিক শিক্ষা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (ICT) সহকারী শিক্ষক: চাকরির শুরুতে মূল বেতন ১৬,০০০ টাকা (গ্রেড-১০)।
২. অন্যান্য ভাতা (Allowances)
মূল বেতনের পাশাপাশি শিক্ষকগণ নিম্নলিখিত ভাতাগুলো পান:
| ভাতার নাম | বর্তমান নিয়ম (আনুমানিক) |
| বাড়ি ভাড়া ভাতা | মূল বেতনের ৫% (তবে সর্বনিম্ন ২,০০০ টাকা নির্ধারিত)। অধিকাংশ শিক্ষকের ক্ষেত্রে এই ২,০০০ টাকা প্রযোজ্য। |
| চিকিৎসা ভাতা | ১,০০০ টাকা (নির্দিষ্ট)। |
| বিশেষ সুবিধা (Incentive) | মূল বেতনের ১০% থেকে ১৫% হারে প্রতি বছর জুলাই মাসে এই সুবিধা প্রাপ্য হন। |
💰 মোট মাসিক বেতন (স্থূল বা গ্রস বেতন)
একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক (গ্রেড-৯ এর শুরু) যিনি বিএড স্কেল পেয়েছেন, তাঁর মাসিক মোট বেতন মোটামুটি এই রকম হতে পারে:
মূল বেতন (গ্রেড-৯): ২২,০০০ টাকা (শুরুতে)
বাড়ি ভাড়া ভাতা (ন্যূনতম): ২,০০০ টাকা
চিকিৎসা ভাতা: ১,০০০ টাকা
মোট গ্রস বেতন (আনুমানিক): ২৫,০০০ টাকা থেকে শুরু
তবে, মূল বেতন, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট এবং উচ্চতর গ্রেডের কারণে শিক্ষকদের মোট বেতনের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।
দ্রষ্টব্য: সরকারি বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট তারিখ বা সময়ের মধ্যে বেতন ছাড় না হওয়ার যে সমস্যাটি পূর্বের মন্তব্যে উল্লেখ করা হয়েছে, তা এখনো একটি বড় সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান।



