জাতীয় বেতন কমিশন, ২০২৫ । প্রশাসন ক্যাডারের প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো নিয়ে তীব্র বিতর্ক কেন?
প্রশাসন ক্যাডার কর্তৃক সর্বোচ্চ ২ লাখ, সর্বনিম্ন ২৫,৮০০ টাকার বেতন স্কেল প্রস্তাব: অন্যান্য গ্রেডে চরম বৈষম্যের অভিযোগ- ঢাকা: সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন জাতীয় বেতন কাঠামো (জাতীয় বেতন কমিশন, ২০২৫) প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক প্রস্তাবিত বেতন ও ভাতাদি নিয়ে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের মধ্যে অস্বাভাবিক পার্থক্য এবং গ্রেড সংখ্যা না কমানোর চাতুর্যপূর্ণ কৌশলের মাধ্যমে এই বৈষম্য জিইয়ে রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন অন্যান্য কর্মচারী সংগঠন ও বিশেষজ্ঞরা।
প্রশাসন ক্যাডারের মূল প্রস্তাবনা
জাতীয় বেতন কমিশন, ২০২৫-এর কাছে জমা দেওয়া বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের খসড়া প্রস্তাবনায় যে আর্থিক সুবিধাগুলো সুপারিশ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- সর্বোচ্চ বেতন: ২,০০,০০০ (দুই লাখ) টাকা।
- সর্বনিম্ন বেতন: ২৫,৮০০ (পঁচিশ হাজার আটশো) টাকা (২০তম গ্রেডের জন্য প্রস্তাবিত শুরু)।
- রেশন সুবিধা: ১১ থেকে ২০ গ্রেডের কর্মচারীদের জন্য রেশনের সুপারিশ রাখা হয়েছে।
- ভাতা বৃদ্ধি:
- যাতায়াত ভাতা (পরিবহন ভাতা): ১,৫০০ টাকা।
- শিক্ষা ভাতা: ৫,০০০ টাকা (প্রতি সন্তানের জন্য, তবে প্রস্তাবে ‘একজন’ উল্লেখ রয়েছে)।
- মোবাইল ফোন ভাতা: সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা সহ একাধিক সুপারিশ।
- বাধ্যতামূলক ছুটি: প্রতি বছর ১০ দিন বাধ্যতামূলক ছুটি ও এর বিপরীতে এক বেসিকের সমপরিমাণ অর্থ প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে।
বৈষম্য নিয়ে তীব্র সমালোচনা
প্রশাসন ক্যাডারের এই প্রস্তাবনার পর থেকেই অন্যান্য কর্মচারী ও জনপ্রশাসন বিশ্লেষকদের মধ্যে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। তাদের মতে, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের প্রস্তাবিত অনুপাত (প্রায় ১:৭.৭৫) অত্যন্ত অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজন তৈরি করবে।
সমালোচকদের মূল আপত্তির বিষয়গুলো হলো:
- বিশাল বেতন বৈষম্য: উচ্চতর গ্রেডসমূহে ২ লাখ টাকা বেতন প্রস্তাবের বিপরীতে সর্বনিম্ন গ্রেডে মাত্র ২৫,৮০০ টাকা নির্ধারণের মাধ্যমে বৈষম্যকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হচ্ছে।
- গ্রেড কমানোর ‘চাতুরতা’: জাতীয় বেতন কমিশন ২০২৫ গঠিত হওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে গ্রেড সংখ্যা ২০ থেকে কমিয়ে ১০ থেকে ১২টির মধ্যে রাখার দাবি উঠেছে, যাতে বেতন বৈষম্য হ্রাস পায়। কিন্তু প্রস্তাবিত কাঠামোতে গ্রেড সংখ্যা কমানোর কোনো উদ্যোগ না নিয়ে শুধু উচ্চতর বেতন স্কেলের সুপারিশ করা হয়েছে। সমালোচকদের বক্তব্য অনুযায়ী, গ্রেড সংখ্যা না কমানোর এই উদ্যোগ “বৈষম্য জিইয়ে রাখার চাতুরতা” ছাড়া আর কিছু নয়।
- ‘টিম ওয়ার্ক’ উপেক্ষা: প্রস্তাবনার সমালোচনায় প্রশ্ন তোলা হয়েছে—”দাপ্তরিক কর্মকান্ডে একাই তাঁরা কী ১০ জনের কাজ করতে পারে? তবে কেন এতো বৈষম্য?” দাপ্তরিক কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে দলগত কাজের (টিম ওয়ার্ক) গুরুত্ব অপরিসীম। তাই একক ক্যাডারভিত্তিক সুবিধা না দিয়ে গ্রেড সংখ্যা কমিয়ে সবার জন্য ন্যায্য ও সমতাভিত্তিক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা উচিত বলে দাবি উঠেছে।
- ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে মুক্তির আহ্বান: সমালোচকরা এই ধরনের অতি-সুবিধাভোগী মানসিকতাকে “ব্রিটিশের দুঃশাসন ও দাসত্বের মনোভাব” থেকে বের হয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন, যা জনপ্রশাসনে ঔপনিবেশিক আমলের মানসিকতার প্রতিফলন।
উল্লেখ্য, অন্যান্য কর্মচারী সংগঠন সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত ১:৪ (যেমন, সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার ও সর্বোচ্চ ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা) অথবা ১৩টি গ্রেডে বেতন কাঠামো প্রণয়নের প্রস্তাব করেছে। কমিশন সব পক্ষের প্রস্তাবনা বিবেচনা করে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে বলে জানা গেছে।

প্রশাসন ক্যাডার ২০ গ্রেড রাখার পক্ষে কেন?
প্রশাসন ক্যাডার আনুষ্ঠানিকভাবে ২০টি গ্রেড বহাল রাখার পক্ষে যে যুক্তিগুলো দেয়, তার মূল উদ্দেশ্য হলো পদসোপান (Hierarchy) এবং ক্যারিয়ার কাঠামোকে অপরিবর্তিত রাখা। অন্যান্য কর্মচারী সংগঠন যেখানে গ্রেড সংখ্যা কমিয়ে বৈষম্য কমানোর দাবি জানাচ্ছে, সেখানে প্রশাসন ক্যাডারের ২০ গ্রেড বহাল রাখার আগ্রহের পেছনে প্রধানত নিম্নলিখিত কারণগুলো কাজ করে:
১. পদসোপান এবং প্রশাসনিক কাঠামোর স্থিতিশীলতা (Maintaining Hierarchy)
প্রশাসন ক্যাডার মূলত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে চলে আসা একটি সুপ্রতিষ্ঠিত প্রশাসনিক কাঠামো অনুসরণ করে। এই কাঠামোতে ২০টি গ্রেড (বা পূর্বের গ্রেডগুলো) বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে একটি স্পষ্ট পদসোপান (Hierarchy) বজায় রাখে।
- কার্যভারের পার্থক্য: তারা মনে করে যে উচ্চতম গ্রেড থেকে সর্বনিম্ন গ্রেড পর্যন্ত প্রত্যেকের কাজের প্রকৃতি, দায়িত্ব, ঝুঁকি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ভিন্ন। এই পার্থক্যকে ২০টি ভিন্ন স্তরের মাধ্যমে যথাযথভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
- পদোন্নতি ও প্রণোদনা: ২০টি গ্রেড বহাল থাকলে নিম্ন স্তর থেকে উচ্চ স্তরে ওঠার জন্য পদোন্নতির সিঁড়ি (Career Ladder) বেশি থাকে। কম গ্রেড থাকলে কিছু স্তরের পদোন্নতির সুযোগ কমে যেতে পারে বা পদোন্নতি প্রক্রিয়া জটিল হতে পারে।
২. বেতন বৃদ্ধির সুবিধা ধরে রাখা (Preserving Higher Financial Benefit)
বেতন কাঠামোতে গ্রেড সংখ্যা বেশি থাকলে তা প্রশাসন ক্যাডারের শীর্ষ পদে থাকা কর্মকর্তাদের জন্য উচ্চতর বেতন স্কেল এবং বিশেষ সুবিধা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়।
- সর্বোচ্চ স্কেল নির্ধারণ: ২০ গ্রেড থাকলে গ্রেড-১ বা সর্বোচ্চ গ্রেডের জন্য ২ লাখ টাকার মতো উচ্চতর স্কেল প্রস্তাব করা সহজ হয়। যদি গ্রেড কমিয়ে ১২টি করা হয়, তবে সেই ১২টি গ্রেডের মধ্যে বেতন-ভাতার পার্থক্য কমিয়ে আনতে হয়, যা সর্বোচ্চ গ্রেডের জন্য প্রস্তাবিত উচ্চ বেতন স্কেলকে সীমিত করতে পারে।
৩. বৈষম্য নিরসনের বিকল্প কৌশল (Alternative Strategy for Inequality)
প্রশাসন ক্যাডার গ্রেড সংখ্যা কমানোর মাধ্যমে সৃষ্ট কাঠামোগত বৈষম্য নিরসনের বদলে অন্য উপায়ে বৈষম্য দূর করতে আগ্রহী। তারা মূলত নিচের গ্রেডের কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে (যেমন: রেশনের সুপারিশ, মোবাইল ভাতা বৃদ্ধি) গ্রেড সংখ্যা অপরিবর্তিত রাখার কৌশল নেয়।
- গ্রেড না কমানোর চাতুর্য: সমালোচকরা এই কৌশলকে “গ্রেড না কমানোর চাতুরতা” হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, গ্রেড কমালে সবার জন্য সমান সুবিধা সৃষ্টি হতে পারে, যা প্রশাসন ক্যাডারের বিশেষ সুবিধা (Elite Status) বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হতে পারে। তাই তারা ২০ গ্রেড রেখে কেবল সর্বনিম্ন গ্রেডের আর্থিক সুবিধা বাড়িয়ে সাময়িকভাবে অসন্তোষ কমানোর চেষ্টা করে।
সংক্ষেপে, প্রশাসন ক্যাডারের ২০ গ্রেড ধরে রাখার মূল কারণ হলো ঐতিহ্যগত ক্ষমতা, প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা, পদসোপান বজায় রাখা এবং উচ্চতর বেতন স্কেলের সুবিধা নিশ্চিত করা, যদিও অন্যান্য কর্মচারী সংগঠন এই প্রবণতাকে বৈষম্যমূলক মনে করে গ্রেড সংখ্যা কমানোর জোর দাবি জানাচ্ছে।



