বেতন-সুবিধা ও ঝুঁকির মানদণ্ডে বৈষম্য ২০২৫ । ‘শিক্ষক-সৈনিক’ বিতর্ক এবং আত্মত্যাগের প্রশ্ন তোলেছেন একজন সৈনিক?
সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি চাকুরীজীবীদের মধ্যে বেতন-ভাতা, ছুটি এবং কাজের ধরনের ভিত্তিতে সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য নিয়ে এক গভীর বিতর্ক দানা বেঁধেছে। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন প্রাথমিক স্তরের শিক্ষক এবং দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য—যেমন সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসার ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, যারা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশকে রক্ষা করেন, তাদের জীবন ও জীবিকার মান কতটা সুরক্ষিত? একজন সৈনিকের মন থেকে উঠে আসা এই বেদনাদায়ক চিত্র দেশের নীতিনির্ধারকদের সামনে এক কঠিন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে।
পর্যালোচনা: বৈষম্যের চিত্র
প্রেরিত বক্তব্যে দুই শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের জীবনযাত্রার যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা বৈষম্যের এক স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।
১. সুবিধাভোগী সরকারি কর্মচারী (শিক্ষক শ্রেণির উদাহরণ):
- বেতন ও ভাতা: মূল বেতন তুলনামূলকভাবে বেশি (১২,০০০ টাকা), সব মিলিয়ে শুরুতেই ২৩,০০০ টাকার বেশি বেতন।
- কাজের পরিবেশ ও ছুটি: নিজ বাড়িতে থেকে চাকরি, সরকারি সব ছুটি ভোগ, বছরে প্রায় ৩ মাস স্কুল ছুটি, সাপ্তাহিক ছুটি।
- অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ: গরু, মুরগি, ছাগল, হাঁস পালন, নিজের জমিতে চাষাবাদ, আলাদা ব্যবসা এবং নিজের ইচ্ছেমতো ছুটি নেওয়ার সুযোগ।
- কর্মঘণ্টা: স্বাভাবিক (৮ ঘণ্টা) বা তার চেয়ে কম।
২. দেশরক্ষার সৈনিক ও নিরাপত্তা কর্মী (সামরিক, পুলিশ, বিজিবি ইত্যাদি):
- বেতন ও ভাতা: ১৭তম গ্রেডে মূল বেতন মাত্র ৯,০০০ টাকা, সব ভাতা মিলিয়ে মোটে ১৫,০০০ টাকার মতো।
- কাজের পরিবেশ ও ছুটি: বাড়ি থেকে অনেক দূরে থেকে চাকরি, বাসা ভাড়া করে থাকতে হয়। সরকারি বা সাপ্তাহিক ছুটি বলতে গেলে নেই।
- কাজের চাপ ও ঝুঁকি: ডিউটি ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত চলে। অতিরিক্ত ডিউটির কোনো ওভারটাইম ভাতা বা সরকারি ছুটির দিনে ডিউটির জন্য অতিরিক্ত সম্মানী নেই।
- জীবনের ঝুঁকি: “যে কোনো সময় একটি বুলেট বা বোমা কেড়ে নিতে পারে তাদের প্রাণ।” এটিই তাদের পেশার সবচেয়ে বড় বাস্তবতা।
- কাজের প্রকৃতি: সাধারণ চাকরিজীবীরা ৮ ঘণ্টা সার্ভিস দিলেও, সৈনিকরা কার্যত ২৪ ঘণ্টাই সেবার জন্য নিয়োজিত থাকেন।
বেতন কাঠামো ও যুক্তির নিরিখে বিশ্লেষণ:
প্রেরিত বক্তব্যে যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, একজন সাধারণ চাকরিজীবী ৮ ঘণ্টা সার্ভিস দিয়ে যে বেতন পান, সে হিসেবে একজন ২৪ ঘণ্টা সার্ভিস দেওয়া সৈনিকের বেতন তার তিন গুণ (৩ $\times$ ৮ = ২৪,০০০ টাকা) হওয়া উচিত। নূন্যতম দ্বিগুণ (২ $\times$ ৮ = ১৬,০০০ টাকা) হওয়াও প্রয়োজন। ১৭তম গ্রেডের মূল বেতন ৯,০০০ টাকা এবং সব ভাতা মিলিয়ে ১৫,০০০ টাকা, যেখানে একজন শিক্ষকের মোট বেতন ২৩,০০০+ টাকা—এই ব্যবধান দেশের প্রতিরক্ষা ও আইনশৃঙ্খলার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ পেশাজীবীদের জন্য চরম হতাশার কারণ।
সরকারি বেতন স্কেলে সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের জন্য ভিন্ন গ্রেড ও ভাতা কাঠামো বিদ্যমান। তবে জীবনের ঝুঁকি, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা এবং কর্মঘণ্টার বিবেচনায় সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের জন্য বেতন ও সুযোগ-সুবিধা পুনর্বিন্যাস করার দাবিটি জোরালোভাবে উঠে আসা স্বাভাবিক। দেশ রক্ষার শপথের কারণে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে না পারার যে অপারগতা সৈনিকদের রয়েছে, তা তাদের আত্মত্যাগের একটি দিক হলেও, রাষ্ট্রের উচিত স্বপ্রণোদিত হয়ে তাদের জন্য ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা।
মূল কথা:
শিক্ষকরা নিঃসন্দেহে জাতি গড়ার কারিগর, তাদের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি কাম্য। কিন্তু একই সঙ্গে ভুলে গেলে চলবে না যে, জাতি গঠনের কাজটি নির্বিঘ্নে তখনই সম্ভব, যখন দেশের সীমানা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সুরক্ষিত থাকে। আর এই নিরাপত্তার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। তাদের দাবি, “যদি শিক্ষক জাতি গড়ার কারিগর হন, তবে আমরা দেশ ও জাতি রক্ষার অকুতোভয় রক্ষক!”
দেশের সাধারণ জনমানুষের কাছে এবং নীতিনির্ধারকদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া জরুরি যে, যে পেশায় জীবনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি, পারিবারিক জীবনের সুখ-সুবিধা সবচেয়ে কম এবং কর্মঘণ্টা অনির্দিষ্ট ও দীর্ঘ—সেখানে বেতন ও ভাতার ক্ষেত্রে উদারতা দেখানো অপরিহার্য। বেতন কাঠামো নির্ধারণে কেবল শিক্ষাগত যোগ্যতা বা গ্রেড নয়, বরং পেশাগত ঝুঁকি, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা এবং পারিবারিক ত্যাগ-তিতিক্ষার মতো বিষয়গুলোকেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা তাদের শপথের প্রতি অবিচল থেকে নিজ অধিকারের জন্য আন্দোলন না করলেও, রাষ্ট্র হিসেবে তাদের মনের কথা শোনা এবং বৈষম্য দূর করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। এই বৈষম্য দূর না হলে, দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হতে পারে, কেননা সৈনিকদের মনে হতাশা তৈরি হওয়া কাম্য নয়।
এমপিও (Monthly Pay Order) ভুক্ত শিক্ষকদের বেতন কাঠামোতে মূল বেতন সরকার দিলেও, তারা সরকারি শিক্ষকদের মতো পূর্ণাঙ্গ বাড়িভাড়া এবং চিকিৎসা ভাতা পান না। এটিই এই দুই শ্রেণির কর্মচারীর বেতনের মূল পার্থক্য।
এমপিও সহকারী শিক্ষক বনাম সাধারণ সৈনিক: বেতন ও সুযোগ-সুবিধার তুলনামূলক বিশ্লেষণ
| তুলনার ক্ষেত্র | এমপিওভুক্ত সহকারী শিক্ষক | সাধারণ সৈনিক (সেনাবাহিনী/অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী) |
| সাধারণ গ্রেড | ১০ম গ্রেড (বিএড সহ) বা ১১তম গ্রেড (বিএড ছাড়া) | ১৭তম গ্রেড বা তার নিম্ন গ্রেড |
| শুরুর মূল বেতন (প্রায়) | ১৬,০০০ টাকা (১০ম গ্রেড) বা ১২,৫০০ টাকা (১১তম গ্রেড) | ৯,০০০ টাকা (প্রেরিত বক্তব্যে ১৭তম গ্রেড অনুযায়ী) |
| মোট মাসিক ভাতা | বাড়িভাড়া: মূল বেতনের ৫% (সর্বনিম্ন ২,০০০ টাকা) এবং চিকিৎসা ভাতা: ৫০০ টাকা (স্থির)। | বাড়িভাড়া: মূল বেতনের ২০% (অবিবাহিত) বা ৪৫% (বিবাহিত), চিকিৎসা ভাতা: ১৫০০ টাকা, প্রতিরক্ষা ভাতা, যাতায়াত ভাতা ইত্যাদি। |
| মোট বেতন (ভাতা সহ, প্রায়) | ১৬,০০০ (মূল বেতন) + ২০০০ (বাড়িভাড়া) + ৫০০ (চিকিৎসা) = ১৮,৫০০ টাকা (১০ম গ্রেড অনুযায়ী, তবে পেনশন ও কল্যাণের জন্য মূল বেতনের ১০% কর্তন হয়)। | ১৫,০০০ টাকার কাছাকাছি (প্রেরিত বক্তব্যে উল্লিখিত, ভাতার পরিমাণ বেশি হলেও মূল বেতন কম)। |
| উৎসব ভাতা | মূল বেতনের ৫০% (বছরে ২ বার)। | মূল বেতনের ১০০% (বছরে ২ বার)। |
| কাজের প্রকৃতি | জ্ঞান ও দক্ষতাভিত্তিক, শারীরিক ঝুঁকি কম। | চরম শারীরিক ঝুঁকি ও মানসিক চাপযুক্ত। দেশের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষা। |
| নিয়মিত কর্মঘণ্টা | ৮ ঘণ্টা (নির্দিষ্ট)। | ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত (অনির্দিষ্ট এবং প্রয়োজনসাপেক্ষ)। |
| অতিরিক্ত ডিউটি/ওভারটাইম | প্রযোজ্য নয়। | অতিরিক্ত ডিউটির জন্য কোনো ওভারটাইম ভাতা নেই। |
| ছুটি ভোগ | সরকারি সব ছুটি ভোগ, সাপ্তাহিক ছুটি (শুক্র-শনি) এবং স্কুল ছুটি। | সরকারি বা সাপ্তাহিক ছুটি নেই, বরং ছুটির দিনেও ডিউটি করতে হয়। |
| অবস্থানের বাধ্যবাধকতা | নিজ বাড়িতে থেকে চাকরির সুযোগ থাকে। | বাড়ি থেকে অনেক দূরে (পোস্টিং স্থানে) অবস্থান, ব্যারাকে/কোয়ার্টারে থাকা বাধ্যতামূলক। |
| জীবনের ঝুঁকি | খুবই কম। | যে কোনো সময় প্রাণ হারানোর চরম ঝুঁকি (বুলেট, বোমা, সংঘর্ষ)। |
বিশ্লেষণ:
এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা সরকারি শিক্ষকদের তুলনায় কম সুযোগ-সুবিধা পেলেও, তাদের মূল বেতন সরকারি স্কেলের সমতুল্য। তবে, সৈনিকদের তুলনায় তাদের আর্থিক সুবিধায় কিছু বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট:
- বেতন কাঠামো বনাম ঝুঁকি: একজন এমপিও শিক্ষক মূল বেতনের দিক থেকে সৈনিকের চেয়ে এগিয়ে থাকেন (১৬,০০০ বনাম ৯,০০০ টাকা), যদিও তাদের মোট বেতন ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে।
- ভাতার ক্ষেত্রে বৈষম্য: যদিও এমপিও শিক্ষকরা কম বাড়িভাড়া পান, তবুও তারা সরকারি ছুটির সুবিধা, অতিরিক্ত উপার্জনের সুযোগ ও পারিবারিক সংস্পর্শ পান—যা একজন সৈনিকের জন্য অনুপস্থিত।
- জীবনের মূল্য: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো ঝুঁকি এবং কর্মঘণ্টার। একজন এমপিও শিক্ষক নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা এবং নিরাপদ জীবনযাপন করলেও, একজন সৈনিককে “২৪ ঘণ্টার সার্ভিস” দিতে হয় এবং তার জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই।
সুতরাং, যদিও এমপিও শিক্ষকরাও পূর্ণাঙ্গ সরকারি সুবিধা পান না বলে আন্দোলন করেন, একজন সৈনিকের দাবি হলো—জীবনের ঝুঁকি, কঠোর ডিউটি আওয়ার এবং পারিবারিক ত্যাগের মতো বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে তাদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা শিক্ষকদের (সরকারি বা এমপিও উভয়) চেয়ে বেশি হওয়া উচিত।



