আয়কর । ভ্যাট । আবগারি শুল্ক

ই-রিটার্ন সহজ হলো: জেনে নিন রেজিস্ট্রেশন থেকে কর পরিশোধের বিস্তারিত নিয়ম!

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্তৃক প্রবর্তিত ই-রিটার্ন (e-Return) সিস্টেম করদাতাদের জন্য সহজে আয়কর রিটার্ন দাখিলের একটি সুবিধাজনক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। এই প্রশ্ন-উত্তর (FAQ) সেকশনটি ই-রিটার্ন সিস্টেমে রেজিস্ট্রেশন, সাইন-ইন, রিটার্ন পূরণ, কর পরিশোধ এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে করদাতাদের প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর সরবরাহ করে।

নিচে মূল বিষয়বস্তু এবং গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনাগুলির একটি বিশ্লেষণ দেওয়া হলো:


💻 রেজিস্ট্রেশন এবং সাইন-ইন প্রক্রিয়া

  • রেজিস্ট্রেশনের প্রয়োজনীয়তা: ই-রিটার্ন দাখিলের জন্য etaxnbr.gov.bd ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন করা আবশ্যক।

  • প্রয়োজনীয় তথ্য: রেজিস্ট্রেশনের জন্য টিআইএন, জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধিত মোবাইল ফোন নম্বর প্রয়োজন।

  • মোবাইল নম্বরের বৈধতা: টিআইএন খোলার সময় ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরটি জরুরি নয়। তবে ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরটি আপনার নামে নিবন্ধিত কিনা তা যাচাই করতে *১৬০০১# ডায়াল করতে হবে।

  • পাসওয়ার্ডের শর্তাবলী: পাসওয়ার্ডটি কমপক্ষে আট ক্যারেক্টার বিশিষ্ট হতে হবে এবং এর মধ্যে কমপক্ষে একটি করে ছোট হাতের অক্ষর, বড় হাতের অক্ষর, সংখ্যা ও বিশেষ অক্ষর থাকতে হবে।

  • পাসওয়ার্ড রিসেট: পাসওয়ার্ড ভুলে গেলে ‘Forget password’ অপশনে ক্লিক করে মোবাইলে আসা ওটিপি (OTP) ব্যবহার করে পাসওয়ার্ড রিসেট করা যাবে।


🎯 রিটার্ন দাখিল ও কর পরিশোধ

  • প্লাটফর্মের ব্যবহার: সিস্টেমে ব্যবহৃত কিছু ফিচার মোবাইল ডিভাইসে পাওয়া যায় না, তাই ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কম্পিউটার ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

  • সাপোর্টিং ডকুমেন্টস: বর্তমানে অনলাইন রিটার্ন দাখিলে কোনো ডকুমেন্টস আপলোড করতে হবে না, তবে নির্ভুলভাবে ইনপুট দেওয়ার জন্য সকল প্রমাণপত্র কাছে রাখতে হবে।

  • তাৎক্ষণিক এসেসমেন্ট: অনলাইনে রিটার্ন জমা দেওয়ার সাথে সাথেই কর নির্ধারণ (Assessment) সম্পন্ন হবে এবং Acknowledgement slip, Tax Certificate এবং রিটার্নের কপি ডাউনলোড করা যাবে।

  • রিটার্ন দাখিলের ধাপসমূহ (৭টি): রিটার্ন দাখিলের প্রক্রিয়াটি ৭টি ধাপে বিভক্ত:

    1. Assessment information (মৌলিক তথ্য)

    2. Income (খাতভিত্তিক আয়)

    3. Rebate (বিনিয়োগের তথ্য)

    4. Expenditure (বার্ষিক ব্যয়)

    5. Asset & Liabilities (সম্পদ ও দায়)

    6. Tax & Payment (কর পরিগণনা ও পরিশোধ)

    7. Return View (রিটার্ন পর্যালোচনা ও সাবমিট)

  • কর ক্রেডিট দাবী: উৎসে কর এবং অগ্রিম করের ক্রেডিট দাবি করার জন্য Tax & Payment সেকশনে গিয়ে Update Tax Payment Status বাটনে ক্লিক করে e-Return Ledger এ প্রয়োজনীয় তথ্য হালনাগাদ করতে হবে। বেতন, ব্যাংক সুদ, সঞ্চয়পত্র, ডিভিডেন্ড ইত্যাদির উৎসে করের জন্য সুনির্দিষ্ট অপশন ব্যবহার করতে হবে।

  • অনলাইন কর পরিশোধ: Pay Now বাটন ব্যবহার করে মোবাইল ব্যাংকিং (বিকাশ, রকেট, নগদ), ইন্টারনেট ব্যাংকিং এবং ডেবিট/ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কর পরিশোধ করা যায়।

  • পূর্ববর্তী বছরের তথ্য: গত বছর অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করে থাকলে, এই বছর Asset & Liabilities অংশে Autofill অপশনে ক্লিক করে পূর্ববর্তী বছরের সম্পদের তথ্য আনা সম্ভব।

  • সংশোধিত রিটার্ন: দাখিলকৃত রিটার্নে ভুল হলে ১৮০ দিনের মধ্যে একবার অনলাইনে সংশোধিত রিটার্ন দাখিল করা যাবে।


📢 গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা এবং সুবিধা

  • সাহায্যের জন্য যোগাযোগ: e-Return সংক্রান্ত যেকোন সমস্যার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কল সেন্টারে (০৯৬৪৩ ৭১৭১৭১) ছুটির দিন ব্যতীত সকাল ৯.০০টা হতে বিকাল ৫.০০টা পর্যন্ত যোগাযোগ করা যাবে।

  • তথ্য নিরাপত্তা: করদাতার তথ্য সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে এবং এনবিআর আইনগতভাবে তথ্যের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

  • আবশ্যিকতা (২০২৫-২০২৬ কর বছর): ২০২৫-২০২৬ কর বছরে সকল স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতার জন্য অনলাইন রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক, তবে ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের প্রবীণ করদাতা, শারীরিক বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন করদাতা, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী করদাতা, মৃত করদাতার আইনি প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী নাগরিকগণ এই শর্তের আওতামুক্ত থাকবেন।

  • বিশেষ ক্ষেত্রে আয় প্রদর্শন:

    • চিকিৎসক/আইনজীবী: পেশাগত আয় ব্যবসা আয় হিসেবে প্রদর্শিত হবে। উৎসে কর কর্তন করা থাকলে ‘Business Subject to Minimum Tax’ এর অধীন ‘Profession/Consultancy/Other Services’ এ পূরণ করতে হবে।

    • এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী: বেতন বেসরকারি চাকরি হিসেবে বিবেচিত হবে।

  • সম্পদের মূল্য: স্বর্ণ ও অন্যান্য সম্পদের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী বছরে প্রদর্শিত মূল্য, এবং নতুন হলে প্রকৃত ক্রয় মূল্য প্রদর্শন করতে হবে।

  • সারচার্জ: মোটরসাইকেল ও মোটর কার থাকলেও সম্পদ ৪ কোটির কম এবং ৮০০০ ব.ফু এর বাড়ি না থাকলে সারচার্জ প্রযোজ্য হবে না

এই সিস্টেমে ঘরে বসেই রিটার্ন দাখিল করা এবং তাৎক্ষণিক প্রমাণপত্র ও সার্টিফিকেট পাওয়ার সুবিধা থাকায় করদাতাদের জন্য কর পরিপালন প্রক্রিয়াটি অনেক সহজ ও সময় সাশ্রয়ী হয়েছে।

টিআইএন থাকলেই রিটার্ন দাখিল করতে হবে?

হ্যাঁ, টিআইএন (TIN) থাকলেই এখন সাধারণত আয়কর রিটার্ন দাখিল করা বাধ্যতামূলক

আপনার করযোগ্য আয় থাকুক বা না থাকুক, টিআইএন থাকার কারণে আপনাকে বার্ষিক আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে।

তবে এর কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে:

  • যাঁরা জমি বিক্রির উদ্দেশ্যে ১২-ডিজিটের টিআইএন গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু বর্তমানে করযোগ্য আয় নেই

  • যাঁরা ক্রেডিট কার্ড গ্রহণের জন্য ১২-ডিজিটের টিআইএন নিয়েছিলেন, কিন্তু বর্তমানে করযোগ্য আয় নেই

  • বাংলাদেশে কোনো স্থায়ী ভিত্তি (Fixed Base) নেই এমন অনাবাসী ব্যক্তি।

যদি আপনি উপরের ব্যতিক্রমগুলোর আওতায় না পড়েন, তবে আইন অনুযায়ী আপনার জন্য রিটার্ন দাখিল করা আবশ্যক। নির্দিষ্ট কিছু সরকারি সেবা (যেমন: ব্যাংক থেকে ঋণ, বিদ্যুৎ সংযোগ, ইত্যাদি) পাওয়ার জন্যও এখন টিআইএন-এর পাশাপাশি রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র (Acknowledgement Slip) জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক।

আপনার টিআইএন থাকলে, রিটার্ন দাখিল না করলে জরিমানা বা অন্যান্য জটিলতা হতে পারে।

আপনি যদি রিটার্ন দাখিল সংক্রান্ত কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে নিশ্চিত হতে চান, তাহলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (NBR) নির্দেশনা বা একজন আয়কর আইনজীবীর পরামর্শ নিতে পারেন।

ই রিটার্ন জমা না দিলে কি হবে?

যদি আপনার টিআইএন থাকে এবং আপনার জন্য ই-রিটার্ন (বা সাধারণ রিটার্ন) দাখিল করা বাধ্যতামূলক হয়, কিন্তু আপনি তা সময়মতো দাখিল না করেন, তবে আপনাকে নিম্নলিখিত পরিণতিগুলোর সম্মুখীন হতে হতে পারে:

১. জরিমানা ও সুদ আরোপ

  • বিলম্ব সুদ (Interest for Delay): রিটার্ন দাখিলের নির্ধারিত সময়সীমা (সাধারণত ৩০ নভেম্বর, যা প্রয়োজনে বাড়ানো হয়) পার হওয়ার পর আপনি যদি রিটার্ন দাখিল করেন, তবে আপনাকে বিলম্ব সুদ দিতে হবে। এই সুদ আপনার সর্বশেষ পরিশোধিত করের (Assessed Tax) উপর বার্ষিক ৪% হারে ধার্য হতে পারে।

  • জরিমানা (Penalty): উপ-কর কমিশনার আপনার উপর জরিমানা আরোপ করতে পারেন। এই জরিমানা হতে পারে:

    • ১,০০০ টাকা অথবা

    • যে পরিমাণ কর অপরিশোধিত রয়েছে তার ৫% এবং পরবর্তী প্রতি দিনের জন্য ৫০ টাকা (যতদিন পর্যন্ত রিটার্ন দাখিল না হয়), যেটি বেশি।

২. সরকারি সেবা প্রাপ্তিতে বাধা

বর্তমানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বাণিজ্যিক সেবা গ্রহণের জন্য টিআইএন-এর পাশাপাশি রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র বা প্রাপ্তি স্বীকারপত্র (Acknowledgement Slip) দেখানো বাধ্যতামূলক। রিটার্ন দাখিল না করলে আপনি নিম্নলিখিত সেবাগুলো পেতে সমস্যায় পড়তে পারেন:

  • ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ।

  • ১০ লাখ টাকার বেশি মূল্যের জমি বা ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রি।

  • গাড়ির মালিকানা পরিবর্তন বা ফিটনেস নবায়ন।

  • ঠিকাদারী বা পণ্য সরবরাহের টেন্ডারে অংশগ্রহণ।

  • আমদানি-রপ্তানির লাইসেন্স (IRC/ERC) নবায়ন।

  • কোম্পানি গঠন বা ব্যবসায়িক লাইসেন্স (Trade License) নবায়ন।

৩. কর কর্মকর্তার ক্ষমতা বৃদ্ধি

যদি আপনি রিটার্ন দাখিল না করেন, তবে উপ-কর কমিশনার (DCAT) আপনার আয় অনুমান করে (Best Judgment Assessment) কর নির্ধারণ করতে পারেন। এর ফলে আপনার উপর অপ্রত্যাশিতভাবে অতিরিক্ত করের বোঝা আসতে পারে।

৪. মামলা ও আইনি জটিলতা

আয়কর আইন অনুযায়ী, নির্ধারিত সময়ে রিটার্ন দাখিল না করা একটি আইনি লঙ্ঘন। বারবার তাগিদ সত্ত্বেও যদি আপনি রিটার্ন দাখিল না করেন, তবে আপনার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা বা মামলা দায়ের হতে পারে।

করণীয়:

যদি আপনার টিআইএন থাকে, তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আপনার জন্য ই-রিটার্ন সিস্টেমে রিটার্ন দাখিল করা বাঞ্ছনীয়। ই-রিটার্ন সিস্টেম ব্যবহার করে সহজেই এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়।

আপনার পরিস্থিতি অনুযায়ী রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা বা সম্ভাব্য জরিমানা সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হতে, আপনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কল সেন্টারে যোগাযোগ করতে পারেন।

আয়কর নির্দেশিকা ২০২৪-২০২৫ পড়ে নিন

Alamin Mia

আমি একজন সরকারী চাকরিজীবি। দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ চাকুরির সুবাদে সরকারি চাকরি বিধি বিধান নিয়ে পড়াশুনা করছি। বিএসআর ব্লগে সরকারি আদেশ, গেজেট, প্রজ্ঞাপন ও পরিপত্র পোস্ট করা হয়। এ ব্লগের কোন পোস্ট নিয়ে প্রশ্ন থাকলে বা ব্যাখ্যা জানতে পোস্টের নিচে কমেন্ট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *