সর্বশেষ প্রকাশিত পোস্টসমূহ

প্রস্তাবিত পে-স্কেলে তীব্র অসন্তোষ ২০২৫ । প্রথম ও সর্বনিম্ন গ্রেডে বেতনের বিশাল ফারাক, নূন্যতম বেতন ২৫,০০০ টাকার দাবি

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো (পে-স্কেল) নির্ধারণের কাজ চললেও, প্রস্তাবিত কাঠামো নিয়ে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও হতাশা দেখা দিয়েছে। বিশেষত সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গ্রেডের মধ্যে বেতনের বিশাল ব্যবধান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, যা উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে সাধারণ জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে।

বিভিন্ন সূত্র ও কর্মচারী সংগঠনের পক্ষ থেকে উত্থাপিত প্রস্তাবনা অনুযায়ী, ১ম শ্রেণির চাকরিজীবীর সর্বোচ্চ বেতন ১,৫০,০০০/- টাকা এবং ২য় শ্রেণির চাকরিজীবীর বেতন ৩০,৮৯১/- টাকার মতো হতে পারে বলে জানা যাচ্ছে। এছাড়াও, পুরো ২০টি গ্রেডের মধ্যে ১-৯ গ্রেড পর্যন্ত ৭০ শতাংশ বেতন বরাদ্দ রেখে ১০-২০ গ্রেডের জন্য মাত্র ৩০ শতাংশ বরাদ্দ রাখার যে আলোচনা চলছে, তা বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

১৫,০০০/- টাকা দিয়ে সংসার চালানো অসম্ভব, দাবি ২৫,০০০/- টাকা

বেতন কাঠামো নিয়ে আলোচনায় সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে সর্বনিম্ন গ্রেডের বেতন নিয়ে। বর্তমানে সর্বনিম্ন গ্রেডের (২০তম) প্রস্তাবিত/আলোচিত বেতন মাত্র ১৫,০০০/- টাকা। সরকারি কর্মচারীদের দাবি, জীবনযাত্রার ব্যয় আকাশচুম্বী হওয়ায় এই সামান্য বেতনে সংসার চালানো কার্যত অসম্ভব।

নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীরা জোরালোভাবে দাবি জানিয়েছেন, জীবনধারণের নূন্যতম ব্যয় নির্বাহের জন্য সর্বনিম্ন বেতন ২৫,০০০/- টাকা নির্ধারণ করা অপরিহার্য। তারা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বেতন নির্ধারণ না হলে পরিবার নিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়তে হবে। তাদের মতে, বেতনের এই বৈষম্য দূর করে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন স্কেলের অনুপাত একটি যৌক্তিক সীমায় আনা প্রয়োজন।

ন্যায়সঙ্গত ও বৈষম্যমুক্ত পে-স্কেলের প্রত্যাশা

সরকারি কর্মচারী কল্যাণ ফেডারেশনসহ একাধিক সংগঠন পে কমিশনের কাছে তাদের প্রস্তাবনা জমা দিয়েছে, যেখানে বেতন বৈষম্য নিরসন এবং মূল্যস্ফীতি বিবেচনা করে একটি ‘কর্মচারীবান্ধব’ পে-স্কেল প্রণয়নের দাবি জানানো হয়েছে। তারা নূন্যতম বেতনের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি, চিকিৎসা ও শিক্ষা ভাতার যৌক্তিক বৃদ্ধিরও দাবি করেছে।

পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, পে কমিশনকে অবশ্যই এই বিশাল বৈষম্য এবং জীবনযাত্রার বাস্তবতাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। অন্যথায়, নতুন পে-স্কেল প্রণয়ন হলেও নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের অসন্তোষ সরকারের সার্বিক কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সরকারি কর্মচারীরা এখন অপেক্ষা করছেন, পে কমিশন তাদের চূড়ান্ত সুপারিশে জনগণের দাবি ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা কতটুকু প্রতিফলিত করে।

১৫৯২৮ টাকা সর্বনিম্ন বেতন কাঠামো কেন কর্মচারীদের জন্য উপযুক্ত নয়?

সরকারি কর্মচারীদের জন্য ১৫,৯২৮/- টাকার মতো সর্বনিম্ন বেতন কাঠামো (যে কোনো একটি প্রস্তাবনা/আলোচনা অনুযায়ী) বর্তমান প্রেক্ষাপটে উপযুক্ত নয় বলে মনে করার পেছনে প্রধানত যে কারণগুলো রয়েছে, তা নিম্নরূপ:

১. জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় (উচ্চ মূল্যস্ফীতি)

বর্তমানে বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের দাম গত কয়েক বছরে অনেক বেড়েছে।

  • খাদ্য খরচ: একটি চার-সদস্যের পরিবারের জন্য নূন্যতম খাদ্য খরচই বেশিরভাগ সময় মাসিক ১৫,৯২৮/- টাকার চেয়ে বেশি হয়ে যায়। ফলে শুধু খাদ্য সংস্থান করতেই পুরো বেতন শেষ হয়ে যায়।
  • বাসস্থান খরচ (বাড়ি ভাড়া): ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে বাড়ি ভাড়া যেকোনো নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীর বেতনের একটি বিশাল অংশ, যা প্রায় তার বেতনের অর্ধেকেরও বেশি। ১৫,৯২৮/- টাকা বেতনের কর্মচারী কোনোভাবেই শহরের কাছাকাছি এলাকায় সম্মানজনকভাবে থাকতে পারেন না।
  • অন্যান্য মৌলিক খরচ: শিক্ষা (সন্তানদের স্কুলের বেতন, বইপত্র), চিকিৎসা, যাতায়াত এবং পোশাকের খরচ মেটানো এই সামান্য বেতন থেকে অসম্ভব হয়ে পড়ে।

২. বেতন-ভাতার আনুপাতিক অভাব

সরকারি চাকরিজীবীরা সাধারণত মূল বেতনের পাশাপাশি কিছু ভাতা (যেমন – বাড়ি ভাড়া ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, যাতায়াত ভাতা) পেয়ে থাকেন।

  • বাস্তব চাহিদা মেটানো: যদিও ভাতা যোগ হয়, কিন্তু সামগ্রিকভাবে এই ১৫,৯২৮/-টাকার স্কেলে (যা মূল বেতন এবং আনুষঙ্গিক ভাতা যোগ করে একটি প্রস্তাবিত সাকুল্য বেতন হতে পারে) মোট প্রাপ্ত অর্থ বর্তমান বাজার মূল্যের তুলনায় খুবই কম।
  • চিকিৎসা ভাতা অপ্রতুল: বর্তমান চিকিৎসা ভাতা বাস্তব চিকিৎসা ব্যয়ের তুলনায় সামান্যই, ফলে অসুস্থ হলে এই বেতনের কর্মচারীরা আর্থিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েন।

৩. বৈষম্য ও শ্রেণিবিন্যাস

যদি সর্বোচ্চ গ্রেডের বেতন ১,৫০,০০০/- টাকা হয় এবং সর্বনিম্ন গ্রেডের প্রস্তাবিত/আলোচিত বেতন ১৫,৯২৮/- টাকা বা তার কাছাকাছি হয়, তবে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত দাঁড়ায় প্রায় ১:১০-এর কাছাকাছি

  • বেতন বৈষম্য: কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠন (যেমন ১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীরা) এই বিশাল বেতন বৈষম্যের তীব্র সমালোচনা করে আসছে। তারা সর্বনিম্ন বেতন ২৫,০০০/- থেকে ৩০,০০০/- টাকা করার দাবি জানাচ্ছে, যাতে এই অনুপাতটি ১:৪ বা ১:৬ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
  • মানবিক জীবনযাপন: এত বড় বৈষম্যের কারণে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীরা নিজেদের মানবিক মর্যাদা ও নূন্যতম জীবনযাপনের অধিকার থেকে বঞ্চিত মনে করেন।

৪. দুর্নীতি বৃদ্ধির ঝুঁকি

কম বেতন কাঠামোর কারণে যখন কোনো কর্মচারী তার মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারেন না, তখন জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি অনেক সময় অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জনের দিকে ঝুঁকতে পারেন। তাই, বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, নূন্যতম বেতন যৌক্তিক পর্যায়ে না রাখলে তা সামগ্রিকভাবে সরকারি প্রশাসনে দুর্নীতি বাড়াতে পারে। সংক্ষেপে বলা যায়, ১৫,৯২৮/- টাকা বা তার কাছাকাছি সর্বনিম্ন বেতন কাঠামোটি উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনধারণের নূন্যতম খরচ মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত নয়, এবং এটি বর্তমান বাজারে একটি পরিবারকে চরম আর্থিক কষ্টের মধ্যে ফেলে দেবে। একারণেই কর্মচারীরা জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সর্বনিম্ন বেতন ২৫,০০০ টাকা বা তারও বেশি করার জোর দাবি জানাচ্ছেন।

সরকারি কর্মচারীগণ কেমন বেতন কাঠামো চায়?

সরকারি কর্মচারীরা একটি নতুন ও যৌক্তিক বেতন কাঠামো (পে-স্কেল) চান যা বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠন ও ব্যক্তি পর্যায়ে পে কমিশনের কাছে যেসব দাবি ও প্রস্তাবনা উত্থাপন করেছে, সেগুলোর মূল বিষয়বস্তু নিচে তুলে ধরা হলো:

১. সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের সুনির্দিষ্ট দাবি

বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠন সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছে। প্রধান দাবিগুলো হলো:

বিষয়দাবিকৃত সর্বনিম্ন বেতনদাবিকৃত সর্বোচ্চ বেতনবেতনের অনুপাত (সর্বোচ্চ:সর্বনিম্ন)
সাধারণ দাবি৳ ২৫,০০০/- থেকে ৳ ৩০,০০০/-৳ ১,৫০,০০০/- পর্যন্ত১:৬ বা কাছাকাছি
১১-২০ গ্রেডের চাকরিজীবীদের দাবি৳ ৩২,০০০/-৳ ১,২৮,০০০/-১:৪ বা কাছাকাছি
আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী ফেডারেশন৳ ৩৫,০০০/-৳ ১,৪০,০০০/-১:৪ বা কাছাকাছি
ঢাবি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রস্তাব৳ ৪০,০০০/-৳ ২,২০,০০০/-১:৫.৫ বা কাছাকাছি

মূল বিষয়: সর্বনিম্ন বেতন এমন হতে হবে যাতে ২০তম গ্রেডের একজন কর্মচারী সম্মানজনকভাবে পরিবারের মৌলিক চাহিদা (খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা) পূরণ করতে পারে।

২. বেতন বৈষম্য হ্রাস ও যৌক্তিক গ্রেড বিন্যাস

কর্মচারীরা সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গ্রেডের মধ্যে বেতনের বিশাল ফারাক কমাতে চান।

  • অনুপাত হ্রাস: তারা চান যেন সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গ্রেডের বেতনের অনুপাত $১:৪$ থেকে $১:৬$ এর মধ্যে থাকে, যা বর্তমানে প্রচলিত $১:১০$ অনুপাতের চেয়ে অনেক কম।
  • গ্রেড কমানো: বিদ্যমান ২০টি গ্রেডকে কমিয়ে ১৩টি, ১২টি বা ১৫টিতে নিয়ে আসার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যাতে শ্রেণিবিন্যাস সহজ হয় এবং বৈষম্য কমে।
  • বন্টন: ১-২০ গ্রেডের মধ্যে উচ্চ গ্রেডগুলোর (১-৯) জন্য ৭০ শতাংশ এবং নিম্ন গ্রেডগুলোর (১০-২০) জন্য মাত্র ৩০ শতাংশ বেতন বরাদ্দ রাখার যে আলোচনা রয়েছে, তার বিরুদ্ধে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের তীব্র আপত্তি আছে। তারা চান বেতনের সুষম বন্টন।

৩. বিভিন্ন ভাতা বৃদ্ধি ও পুনর্বহাল

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে কর্মচারীরা নিম্নলিখিত ভাতাগুলো বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন:

  • চিকিৎসা ভাতা: বর্তমান চিকিৎসা ভাতা (যা খুবই কম) উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করতে হবে।
  • শিক্ষা ভাতা: সন্তানের লেখাপড়ার ব্যয় নির্বাহের জন্য শিক্ষা ভাতার পরিমাণ বাড়াতে হবে।
  • যাতায়াত ভাতা ও টিফিন ভাতা: ক্রমবর্ধমান যাতায়াত খরচ ও খাদ্যমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই ভাতাগুলো বৃদ্ধি করতে হবে।
  • টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড: ২০১৫ সালের বেতন স্কেলে বাতিল হওয়া টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল করার দাবি জানিয়েছে কর্মচারীদের একাংশ। অন্য একটি পক্ষ পদোন্নতির প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান চেয়েছে।

৪. বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা

  • বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি: মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বার্ষিক ১০ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধির (ইনক্রিমেন্ট) দাবি উঠেছে।
  • রেশন ব্যবস্থা চালু: বিশেষত নিম্ন ও মধ্যম গ্রেডের কর্মচারীদের জন্য রেশন ব্যবস্থা বা ন্যায্য মূল্যে খাদ্যপণ্য সরবরাহের পদ্ধতি চালু করার দাবি উঠেছে।
  • উচ্চতর গ্রেড: কেউ কেউ প্রতি চার বছর অন্তর একটি করে উচ্চতর গ্রেড প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছেন।

মোটকথা, সরকারি কর্মচারীগণ এমন একটি বেতন কাঠামো চান যা বৈষম্যমুক্ত, জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং যা কর্মচারীদের মানবিক ও সম্মানজনক জীবনযাপন নিশ্চিত করবে।

Alamin Mia

আমি একজন সরকারী চাকরিজীবি। দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ চাকুরির সুবাদে সরকারি চাকরি বিধি বিধান নিয়ে পড়াশুনা করছি। বিএসআর ব্লগে সরকারি আদেশ, গেজেট, প্রজ্ঞাপন ও পরিপত্র পোস্ট করা হয়। এ ব্লগের কোন পোস্ট নিয়ে প্রশ্ন থাকলে বা ব্যাখ্যা জানতে পোস্টের নিচে কমেন্ট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *