July Sanad Gazette Bangladesh 2025 । জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি, একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট?
রাষ্ট্রপতির সইয়ের পর গেজেট প্রকাশ; ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে হবে উভয় নির্বাচন- ঢাকা, নভেম্বর ১৪, ২০২৫ (সংবাদদাতা)- বহু প্রতীক্ষিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ জারি করেছে সরকার। গত বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর, ২০২৫) রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের স্বাক্ষরের পর আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ থেকে এর গেজেট প্রকাশ করা হয়। এই আদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবগুলো গণভোটের মাধ্যমে জনগণের অনুমোদনের জন্য প্রস্তুত হলো।
একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট: প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ঘোষণা করেছেন যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবগুলোর ওপর গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে। তিনি জানান, জাতীয় নির্বাচনের মতো গণভোটও ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে, যা নির্বাচনকে উৎসবমুখর ও সাশ্রয়ী করবে।
এক প্রশ্নে ৪ বিষয়ে মতামত: গণভোটের ব্যালটে একটি মাত্র প্রশ্নে জনগণের মতামত চাওয়া হবে। প্রশ্নটি হলো: “আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার–সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?”। এই প্রশ্নের মাধ্যমে মূলত চারটি মূল বিষয়ে জনগণের সম্মতি চাওয়া হচ্ছে: ১. নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ায় গঠন। ২. সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট, যেখানে জাতীয় নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে ১০০ জন সদস্যের উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন লাগবে। ৩. প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদে সীমাবদ্ধতা আনা, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকারসহ জুলাই সনদে ঐকমত্য হওয়া ৩০টি প্রস্তাব। ৪. জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।
সংস্কার পরিষদ ও চূড়ান্ত ক্ষমতা: আদেশে গণভোটের ইতিবাচক ফলাফলের ভিত্তিতে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। এই পরিষদে নব-নির্বাচিত জাতীয় সংসদের সকল সদস্য এবং উচ্চকক্ষের সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। এই পরিষদ কর্তৃক গৃহীত সংবিধান সংস্কার চূড়ান্ত হবে এবং এর জন্য অন্য কোনো অনুমোদন বা সম্মতির প্রয়োজন হবে না।
গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পরিবর্তন: এই আদেশের মাধ্যমে সংবিধানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ, ৭ক এবং ৭খ (সংবিধান বিষয়ক অপরাধ ও সংবিধান সংশোধনের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কিত), বিলুপ্ত করা হবে। এছাড়াও অনুচ্ছেদ ১৫০(২) বিলুপ্ত করে এ সংশ্লিষ্ট ৫ম, ৬ষ্ঠ এবং ৭ম তফসিল সংবিধানে না রাখার বিধান করা হয়েছে।
প্রেক্ষাপট ও কার্যকরিতা: ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার সফল গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রকাশের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই আদেশ জারি করেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ প্রণয়ন করেছিল। আদেশের ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ১৩ ও ১৬ অনুচ্ছেদ গেজেট প্রকাশের তারিখ (১৩ নভেম্বর, ২০২৫) থেকে অবিলম্বে কার্যকর হয়েছে। তবে অনুচ্ছেদ ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৪ ও ১৫ গণভোটের ইতিবাচক ফল সরকারি গেজেটে প্রকাশের তারিখে কার্যকর হবে।

জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫
জুলাই জাতীয় সনদটি (২০২৫) মূলত ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে সুশাসন, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের মধ্যে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়।
জুলাই সনদের মূল সারসংক্ষেপ:
১. সংবিধান বিলুপ্তি ও স্থগিতকরণের অপরাধ বিলুপ্তি: সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ক এবং ৭খ (যা সংবিধান বিষয়ক অপরাধ এবং সংবিধান সংশোধনের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কিত) বিলুপ্ত করা হবে।
২. দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা (সংসদ): * জাতীয় সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। * উচ্চকক্ষ (Upper House): ১০০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে (PR) উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। * সংবিধান সংশোধন: সংবিধান সংশোধনের জন্য নিম্নকক্ষের পাশাপাশি উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন প্রয়োজন হবে।
৩. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও ক্ষমতা বৃদ্ধি: * রাষ্ট্রপতি আইনসভার উভয় কক্ষের (নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ) সদস্যদের গোপন ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হবেন। * রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। রাষ্ট্রপতি নিজস্ব এখতিয়ারে নির্দিষ্ট পদে নিয়োগ দিতে পারবেন (যেমন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়াই)।
৪. জরুরি অবস্থা ঘোষণায় পরিবর্তন: * জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষরের পরিবর্তে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের বিধান যুক্ত করা হবে। * জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা বৈঠকে বিরোধীদলীয় নেতা বা উপনেতার উপস্থিতি অন্তর্ভুক্ত করা হবে। * জরুরি অবস্থাকালীন সময়েও নাগরিকের জীবনের অধিকার (Right to life) এবং বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে মৌলিক অধিকারসমূহ (অনুচ্ছেদ ৩৫) অলঙ্ঘনীয় থাকবে।
৫. মৌলিক অধিকার ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি: * সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহের তালিকা সম্প্রসারণ করা হবে। * রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’ উল্লেখ থাকবে। * সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে যে, “বাংলাদেশ একটি বহু-জাতি, বহু-ধর্মী, বহু-ভাষী ও বহু-সংস্কৃতির দেশ যেখানে সকল সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করা হইবে।”
৬. অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার: * সংসদ নির্বাচনে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন। * নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে সংস্কার আনা। * বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সংস্কার। * সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০(২) বিলুপ্ত করে এ সংশ্লিষ্ট ৫ম, ৬ষ্ঠ এবং ৭ম তফসিল সংবিধানে না রাখার বিধান করা।
বাস্তবায়ন আদেশের প্রধান দিক (জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫): জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের জন্য এই আদেশ জারি করা হয়েছে:
১. গণভোটের মাধ্যমে জনগণের অনুমোদন: সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের উদ্দেশ্যে গণভোটে উপস্থাপন করা হবে।
২. একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত গণভোট একই দিনে (ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে) অনুষ্ঠিত হবে।
৩. সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন: গণভোটের ইতিবাচক ফল এলে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে। নব-নির্বাচিত জাতীয় সংসদের সদস্য এবং উচ্চকক্ষের সদস্যরা এই পরিষদের সদস্য হবেন।
৪. চূড়ান্ত সংস্কার ক্ষমতা: এই পরিষদ কর্তৃক গৃহীত সংবিধান সংস্কার চূড়ান্ত হবে এবং এর জন্য অন্য কোনো অনুমোদন বা সম্মতির প্রয়োজন হবে না।



