পে-স্কেল নিয়ে সরকারি কর্মচারীদের উদ্বেগ ২০২৫ । কর্মচারীদের একাংশ বলছে সরকারকে ‘আমাদের ধোকা দিবেন না’
অর্থ উপদেষ্টার পক্ষ থেকে নতুন পে-স্কেল আগামী সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়নের ইঙ্গিত দেওয়ায় সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বৈষম্যমুক্ত ‘জাতীয় পে-স্কেল’-এর দাবিতে অপেক্ষমাণ কর্মচারীরা বলছেন, তাদের প্রত্যাশা নিয়ে যেন ছিনিমিনি খেলা না হয়। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে বঞ্চনার পর বর্তমান সরকার তাদের আশা দেখালেও এখন এসে ‘বিরূপ আচরণ’ করলে প্রশাসনে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
কর্মচারীদের আকুল আবেদন: ‘চুরাবালিতে ফেলবেন না’
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি গণমাধ্যমকে জানান যে, নতুন পে কমিশনের সুপারিশ ও তা বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আগামী নির্বাচিত সরকার নেবে। তবে তিনি এ-ও জানান যে, পে-স্কেলের জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত অর্থ চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে রাখা হবে এবং সব ঠিক থাকলে ২০২৬ সালের শুরুতেই তা কার্যকর হতে পারে।
এদিকে, সরকারের এই দ্বিমুখী বক্তব্যে কর্মচারীরা চরম হতাশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মচারী একযোগে তাদের ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন: “সরকারি কর্মচারীদের ধোকা দিবেন না প্লিজ। আমরা অনেক আশা নিয়ে আছি যে একটি বৈষম্যমুক্ত পে-স্কেল হবে। আমাদের চুরাবালিতে ফেলবেন না।”
তারা আরও অভিযোগ করেন, বৈষম্য দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও এখন যদি নতুন করে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়, তবে আগের সরকারের সঙ্গে বর্তমান সরকারের কোনো পার্থক্য থাকবে না। কর্মচারীদের দাবি, তাদের কান্না যেন সরকারের কর্ণকুঠিরে পৌঁছায়।
কর্মচারীদের মূল উদ্বেগ: “আমাদের মতো মুজলুম কর্মচারীদের সাথে গাদ্দারী করলে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠবে। অভিশাপ দিতে হয়না এমনিই চলে আসে কিন্তু আপনারা আমাদের আশা দেখিয়েছেন। এখন এসে বিরূপ আচরণ করলে প্রশাসনে অস্থির অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে এবং দেশের জনগণ কাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত হতে পারে।”
⚖️ ন্যায্য দাবী: বৈষম্যহীন জাতীয় পে-স্কেল
কর্মচারীরা জানিয়েছেন, তারা শান্তিতে থাকতে চান এবং আর রাস্তায় নামতে চান না। তাদের মূল দাবি হলো একটি ন্যায্য, বৈষম্যহীন জাতীয় পে-স্কেল।
- দীর্ঘ প্রতীক্ষা: তারা বলছেন, বিগত সরকার ১০ বছর ধরে তাদের বঞ্চিত করেছে। বর্তমান সরকার আশার আলো দেখালেও এখন তা ম্লান হওয়ার পথে।
- বৈষম্য দূর করার অঙ্গীকার: কর্মচারীদের মনে করিয়ে দেন যে, সরকার পক্ষ থেকেই বলা হয়েছিল নতুন পে-স্কেলে কোনো বৈষম্য থাকবে না। এখন যদি নতুন বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়, তবে তা হবে প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ।
কর্মচারীদের সংগঠনগুলো পে কমিশনের কাছে সর্বনিম্ন বেতন ৩৫ হাজার টাকা করার এবং বর্তমান ২০টি গ্রেড কমিয়ে ১২টিতে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের যুক্তি, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কারণে বর্তমানে জীবনযাত্রা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
📢 প্রশাসনের প্রতি বিনীত অনুরোধ
কর্মচারীগণ সরকার বাহাদুরকে উদ্দেশ্য করে বিনীত অনুরোধ জানিয়েছেন: “আমরা আপনার প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। আমাদের হতাশায় ফেলবেন না! অবিলম্বে আমাদের পে-কমিশন ও পে-স্কেল বাস্তবায়ন করার জন্য বিনীত অনুরোধ করছি।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রায় ১৫ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতার বিষয়টি দেশের অর্থনীতি ও প্রশাসনিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পে-স্কেল নিয়ে দীর্ঘসূত্রিতা ও অসঙ্গতি সৃষ্টি হলে তা জনসেবায় নিয়োজিত কর্মচারীদের মনোবল ভাঙতে পারে এবং এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে জনগণের কাঙ্ক্ষিত সেবাপ্রাপ্তির ওপর।
পরবর্তী পদক্ষেপ?
অর্থ উপদেষ্টা সংশোধিত বাজেটে অর্থ বরাদ্দের আশ্বাস দিলেও কর্মচারীদের মূল দাবি হলো অবিলম্বে পে-কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী গেজেট প্রকাশ ও বৈষম্যমুক্ত পে-স্কেল বাস্তবায়ন। এ বিষয়ে সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তই পারে প্রশাসনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে।
পে কমিশন ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের সুপারিশ জমা দিতে পারে। সুপারিশ জমা হওয়ার পর সরকার দ্রুত তা কার্যকর করার কোনো সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করবে কি না, সেদিকেই এখন সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ।
পে স্কেল নিয়ে সরকার কর্মচারীদের চাহিদা কি?
সরকারি কর্মচারীরা নবম পে-স্কেল বাস্তবায়ন নিয়ে যে মূল দাবিগুলো তুলে ধরছেন, সেগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে বৈষম্য দূর করা এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা। কর্মচারী সংগঠনগুলো এবং বিভিন্ন গ্রেডের চাকরিজীবীরা পে কমিশনের কাছে যে সুনির্দিষ্ট চাহিদা ও দাবিগুলো পেশ করেছেন, সেগুলোর একটি সারসংক্ষেপ নিচে দেওয়া হলো:
১. নতুন বেতন কাঠামোর হার ও গ্রেড (The Pay Structure)
| ক্ষেত্র | দাবি/প্রস্তাবনা | কারণ/লক্ষ্য |
| সর্বনিম্ন মূল বেতন (২০তম গ্রেড) | ৩৫,০০০ টাকা (কোনো কোনো প্রস্তাবনায় ৩০,০০০ থেকে ৩৩,০০০ টাকা) | দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে সমন্বয় করা। |
| সর্বোচ্চ মূল বেতন (১ম গ্রেড) | ১,৪০,০০০ টাকা থেকে ১,৫০,০০০ টাকা বা তারও বেশি। | সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের মধ্যে যৌক্তিক ব্যবধান রাখা। |
| বেতনের অনুপাত | ১:৪ থেকে ১:৬ নির্ধারণ করা (অর্থাৎ, সর্বনিম্ন বেতন যদি $x$ হয়, তবে সর্বোচ্চ বেতন হবে $৪x$ বা $৬x$)। | বিদ্যমান বেতন বৈষম্য হ্রাস করে একটি ন্যায্য কাঠামো তৈরি করা। |
| গ্রেড সংখ্যা | বর্তমানে থাকা ২০টি গ্রেড কমিয়ে ১২ থেকে ১৫টি গ্রেডে নামিয়ে আনা। | গ্রেডের জটিলতা ও বৈষম্য দূর করে প্রশাসনিক কাঠামো সহজ করা। |
২. বেতন বৈষম্য দূরীকরণ (Addressing Disparity)
- বৈষম্যহীন পে-স্কেল: কর্মচারীদের সবচেয়ে জোরালো দাবি হলো একটি ন্যায্যতার ভিত্তিতে বৈষম্যমুক্ত নবম পে-স্কেল দ্রুত বাস্তবায়ন করা।
- টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল: আগের পে-স্কেলে হরণ করা টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল করার দাবি রয়েছে, যা নিম্ন ও মধ্য গ্রেডের কর্মচারীদের পদোন্নতি ও আর্থিক উন্নতির সুযোগ দিত।
- এক ও অভিন্ন নিয়োগবিধি: সকল গ্রেড ও ক্যাডারের মধ্যে সামঞ্জস্যতা আনতে এক ও অভিন্ন নিয়োগবিধি বাস্তবায়নের দাবি।
- ১১-২০ গ্রেডের বিশেষ দাবি: এই গ্রেডের কর্মচারীরা (যারা সংখ্যায় বেশি) বিশেষ করে বেতন বৈষম্য দূর করার ওপর জোর দিচ্ছেন।
৩. ভাতাদি বৃদ্ধি (Enhancement of Allowances)
দ্রব্যমূল্য ও আর্থিক চাপ বিবেচনা করে কর্মচারীরা বিভিন্ন ভাতার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন:
- চিকিৎসা ভাতা: বর্তমানের ১,৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২,৫০০ টাকা থেকে ৫,০০০ টাকা অথবা মূল বেতনের ১০ শতাংশ করার জোরালো দাবি। (অবসর-পরবর্তী সুবিধারও বৃদ্ধি চাওয়া হয়েছে)।
- শিক্ষা ভাতা: সন্তানের শিক্ষা ভাতা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো।
- টিফিন ভাতা: টিফিন ভাতাও বাড়ানোর সুপারিশ করা হচ্ছে।
- অন্যান্য ভাতা: বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে অন্যান্য ভাতাসমূহ (যেমন: বাড়িভাড়া) পুনর্নির্ধারণের দাবি রয়েছে।
৪. অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা (Other Benefits)
- শতভাগ পেনশন প্রবর্তন: অবসরের পর কর্মচারীদের জন্য শতভাগ পেনশন প্রবর্তনের দাবি রয়েছে।
- দ্রুত বাস্তবায়ন: পে-কমিশনের সুপারিশ দ্রুততম সময়ের মধ্যে, বিশেষ করে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর বা ২০২৬ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ভূতাপেক্ষ কার্যকর করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সংক্ষেপে, সরকারি কর্মচারীদের মূল চাহিদা হলো দীর্ঘদিনের বঞ্চনা দূর করে, জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং সব স্তরের কর্মচারীর জন্য ন্যায্য ও বৈষম্যমুক্ত একটি পে-স্কেল অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে।



