এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নবম পে কমিশনের প্রস্তাবনা ২০২৫ । ১৪ গ্রেডে বেতন স্কেল ও আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির দাবি করেছে?
এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোটের পক্ষ থেকে নবম পে কমিশনের জন্য একটি বিস্তারিত বেতন স্কেল প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছে। এই প্রস্তাবে ১৪টি গ্রেডে শিক্ষকদের জন্য বেতন কাঠামো এবং অন্যান্য আর্থিক ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দাবি জানানো হয়েছে। প্রস্তাবিত নতুন কাঠামোতে বর্তমানের বৈষম্য নিরসন করে সরকারি কর্মচারীদের সমতুল্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
💰 মূল বেতনের প্রস্তাবনা (গ্রেডভিত্তিক)
জোটের প্রস্তাবে ১৪টি গ্রেড এ মূল বেতনের ভিন্ন ভিন্ন স্কেল নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বনিম্ন গ্রেড (গ্রেড-১৪) এর জন্য প্রস্তাবিত মূল বেতন ৫৫,০০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ গ্রেড (গ্রেড-১) এর জন্য ১,২৫,০০০ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
| প্রস্তাবিত গ্রেড | প্রস্তাবিত মূল বেতন (টাকা) | বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট (শতকরা) |
| গ্রেড-১ | ১,২৫,০০০ | ২.৫% |
| গ্রেড-২ | ৯৫,০০০ | ২.৫% |
| গ্রেড-৩ | ৮৫,০০০ | ২.৫% |
| গ্রেড-৪ | ৭২,০০০ | ২.৫% |
| গ্রেড-৫ | ৬২,০০০ | ২.৫% |
| গ্রেড-৬ | ৫৯,০০০ | ২.৫% |
| গ্রেড-৭ | ৫৫,০০০ | ২.৫% |
| গ্রেড-৮ | ৫০,০০০ | ২.৫% |
| গ্রেড-৯ | ৪৫,০০০ | ২.৫% |
| গ্রেড-১০ | ৪০,০০০ | ২.৫% |
| গ্রেড-১১ | ৩৫,০০০ | ২.৫% |
| গ্রেড-১২ | ৩০,০০০ | ২.৫% |
| গ্রেড-১৩ | ২৫,০০০ | ২.৫% |
| গ্রেড-১৪ | ২২,০০০ | ২.৫% |
দ্রষ্টব্য: ছবিতে প্রস্তাবিত গ্রেডসমূহ গ্রেড-১ থেকে গ্রেড-২০ পর্যন্ত উল্লেখ থাকলেও, মূল বেতনের তালিকাটি কার্যত ১৪টি গ্রেডের জন্য প্রযোজ্য।
🏥 অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক ও সুযোগ-সুবিধা
বেতন স্কেলের পাশাপাশি শিক্ষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ভাতা ও সুযোগ-সুবিধারও প্রস্তাব করা হয়েছে:
- চিকিৎসা ভাতা: সকল গ্রেডের জন্য মাসিক ৫০০০ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
- বাড়ি ভাড়া ভাতা: সকল গ্রেডের জন্য মূল বেতনের ৫০% প্রস্তাব করা হয়েছে, যা বর্তমানে প্রাপ্ত ভাতার তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি।
- শিক্ষা ভাতা (১ সন্তান): সকল গ্রেডের জন্য মাসিক ৩২০০ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
- বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট: প্রস্তাবিত সকল গ্রেডের জন্য ২.৫% হারে বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের কথা বলা হয়েছে।
✨ অন্যান্য বিশেষ সুবিধা ও দাবি
শিক্ষক-কর্মচারীদের মর্যাদা ও আর্থিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করতে প্রস্তাবনায় একাধিক বিশেষ সুবিধা ও দাবি যুক্ত করা হয়েছে:
- ১. এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রারম্ভিক বেতন প্রস্তাবিত ৯ম গ্রেডে নির্ধারণ করতে হবে।
- ২. বাড়িভাড়া ভাতা সরকারি কর্মচারীদের মতো ৫০-৭০% হারে দিতে হবে।
- ৩. উৎসব ভাতা বা বোনাস মূল বেতনের সমপরিমাণ দিতে হবে।
- ৪. বৈশাখী ভাতা মূল বেতনের সমপরিমাণ দিতে হবে।
- ৫. বিএড আইন বাতিল করতে হবে।
- ৬. কমিটি প্রথা বিলুপ্ত করতে হবে।
- ৭. অবসর ফান্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা অবসরের ৬ মাসের মধ্যে দিতে হবে।
- ৮. শিক্ষক/কর্মচারীদের জন্য চেশিয়াল সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
- ৯. গ্রামীণ বিনোদন ভাতা ও সুবিধা দিতে হবে।
- ১০. এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ করতে হবে।
এই প্রস্তাবনা এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের দাবি, অর্থাৎ সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে বিদ্যমান বেতন ও সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য দূরীকরণের প্রতিচ্ছবি। আগামী বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) জাতীয় বেতন কমিশনের সঙ্গে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী জোটের নেতাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যেখানে এসব দাবি নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।

আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কর্মচারীরা কি এবারও প্রতারণার শিকার হবেন?
নবম পে কমিশন গঠনের পর থেকেই সরকারি কর্মচারী এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের মনে একটি বড় উদ্বেগ দেখা দিয়েছে: আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের প্রভাবের কারণে তারা কি এবারও কাঙ্ক্ষিত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন? অতীতে বিভিন্ন পে স্কেল বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা এবং বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কর্মচারীদের এই উদ্বেগটি পুরোপুরি অমূলক নয়। বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠনের পক্ষ থেকে পে স্কেলে ১:৪ অনুপাতে গ্রেড নির্ধারণ (সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত) এবং গ্রেড সংখ্যা কমানোর দাবি জানানো হয়েছে। তবে সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা (সচিবরা) এই ১:৪ অনুপাত মানতে নারাজ। এই ধরনের উচ্চপর্যায়ের আপত্তি কর্মচারীদের কাঙ্ক্ষিত বৈষম্যহীন বেতন স্কেল বাস্তবায়নে প্রধান বাধা হতে পারে।
- টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড হারানোর শঙ্কা: অষ্টম পে স্কেলে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল করা হয়েছিল। নবম পে স্কেলে তা পুনর্বহালের দাবি উঠলেও, আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের কারণে তা আবার উপেক্ষিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
- দীর্ঘসূত্রিতা ও বিলম্ব: পে কমিশন গঠন একটি দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া। যদিও কমিশনকে ৬ মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে, সরকারি প্রক্রিয়া প্রায়শই ধীরগতিতে চলে। কর্মচারী সংগঠনগুলো ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বৈষম্যমুক্ত পে স্কেল বাস্তবায়নের সময়সীমা বেঁধে দিলেও, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে গেজেট প্রকাশ ও বাস্তবায়নে বিলম্বের ফলে কর্মচারীরা আর্থিক ক্ষতির শিকার হতে পারেন।
- নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের বঞ্চনা: ১১ থেকে ২০ গ্রেডের কর্মচারীদের সম্মিলিত অধিকার আদায় ফোরামের পক্ষ থেকে বরাবরই অভিযোগ করা হয়েছে যে, অতীতের পে স্কেলগুলোতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীরা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এবং তাদের পদবি ও গ্রেড উন্নীত করার মতো ন্যায্য দাবিগুলো বাস্তবায়িত হয়নি।
⚖️ প্রত্যাশা এবং বর্তমানের ইতিবাচক দিক: এই উদ্বেগের পাশাপাশি কিছু ইতিবাচক দিক ও আশার আলোও দেখা যাচ্ছে:
- শক্তিশালী জনদাবি: দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা ও নবম পে স্কেলের দাবি এবার অত্যন্ত জোরালো। একাধিক কর্মচারী সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের দাবি তুলে ধরছে।
- পে কমিশন গঠন: সরকার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নবম পে কমিশন গঠন করেছে এবং এটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে কাজ করছে।
- প্রস্তাবনা পেশের সুযোগ: এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা পে কমিশনের সঙ্গে সরাসরি বৈঠকে বসে তাদের প্রস্তাবনা পেশ করার সুযোগ পাচ্ছেন, যা দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
নবম পে স্কেলে কর্মচারীরা ‘প্রতারণার শিকার’ হবেন কিনা, তা নির্ভর করছে মূলত: ১. পে কমিশনের সুপারিশে বৈষম্য নিরসনের কতটা প্রতিফলন ঘটে, এবং ২. আমলাতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক পর্যায়ে সেই সুপারিশ কতটা দ্রুত ও অবিকৃতভাবে বাস্তবায়িত হয়। কর্মচারী সংগঠনগুলো তাদের দাবি আদায়ে সোচ্চার থাকায়, এবার অতীতের চেয়ে কম বৈষম্যমূলক কাঠামো আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের চাপের ফলে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের দাবিগুলো পুরোপুরি পূরণ হওয়া নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।


