সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, কোটা সংস্কারের প্রয়োজন নেই। কেউ বলছেন, প্রয়োজন আছে। দেশের সব জনগণ কোটাপ্রথার বিরুদ্ধে নয়। কোটার পক্ষেও অনেক মানুষ আছে। তবে এরা অধিকাংশই তারা, যারা কোনো না কোনো কোটার আওতায় আছেন।
এজন্য কোটাপ্রথা সংস্কার না করে পুরোপুরি বাতিল করা উচিত। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ঠিকই আছে। খোঁড়া অজুহাতে কোটা প্রথার মতো একটি মেধা-পরিপন্থী প্রথা দেশ থেকে বিতাড়িত করার এখনই সময়। দেশের অধিকাংশ মানুষ কোটা বাতিলের পক্ষে। অনেকে হয়তো মুখে সংস্কারের কথা বলছেন। কিন’ অনত্মরে অনত্মরে ঠিকই চান কোটা প্রথা পুরোপুরি বাতিল হোক। সরকারি চাকরিতে সব রকম কোটা বাদ দিয়ে বেসরকারি চাকরির মতোই সরকারি চাকরিতেও পুরোপুরি যোগ্যতা এবং মেধাভিত্তিক জনবল নিয়োগ দেয়া উচিত।
প্রশ্ন হচ্ছে, কোটা সংস্কার না করে পুরোপুরি বাতিল করে দিলে যারা এখন বিভিন্ন কোটার আওতায় আছেন, তারা কি একেবারে অচল হয়ে যাবেন? ভর্তি বা চাকরিতে তাদের জন্য কোটা রাখাই কি তাদের প্রতি রাষ্ট্রের একমাত্র করণীয়? তাছাড়া অনেক কোটা সংরক্ষণের উপযোগিতাও এখন নেই বললেই চলে। বিষয়টা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
প্রথমে মহিলা কোটার কথায় আসি। বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে মহিলাদের জন্য আলাদা কোটা সংরক্ষণ করা হয়। ভিন্ন ভিন্ন চাকরিতে ভিন্ন ভিন্ন হারে। একটা সময় ছিল, যখন নারীশিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ ছিল কম। নারীশিক্ষার প্রতি দেশের মানুষকে আগ্রহী করে তুলতেই তখন বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে নারীদের জন্য কোটা চালু করা হয়। মহিলা কোটার সর্বোচ্চ ক্ষেত্র হচ্ছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে ৬০% মহিলা কোটা সংরক্ষণ করা হয়। ৬০% মহিলা কোটা সংরক্ষণের ফলে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, দেশে এখন এমন অসংখ্য প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে, যেখানে একজন পুরুষ শিক্ষকও কর্মরত নেই, শতভাগ মহিলা শিক্ষক! বিষয়টা অনেকেই জানেন। কারণ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রায় প্রতি গ্রামেই রয়েছে।
সময় বদলে গেছে। চাকরিতে মহিলা কোটা সংরক্ষণ করাসহ নারীশিক্ষার প্রতি বর্তমান সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে দেশে এখন নারীশিক্ষার হার অনেক বেড়েছে। বর্তমান সরকার নারীদের জন্য স্নাতক পর্যন- উপবৃত্তি চালু করেছে। নারীশিক্ষাকে সম্পূর্ণ অবৈতনিক করার কারণে নারীরা এখন শিক্ষার প্রতি খুবই আগ্রহী। নারীদের জন্য চাকরিতে কোটা না রাখলেও নারীরা নিজ মেধা ও যোগ্যতায় এখন চাকরি লাভ করতে পারে। তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ, ব্যাংক-বীমাসহ বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান, যেখানে মহিলা কোটা বা অন্য কোনো কোটা নেই, তবু হাজার হাজার নারী এখন বেশ দক্ষতা ও সুনামের সাথে চাকরি করছেন।
তাই সরকারি চাকরির বাজারটাও এখন সবার জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত করে দিলে নারী হোক, বা পুরুষ, কেবল মেধাবীরাই সরকারি পদগুলো অলঙ্কৃত করার সুযোগ পাবে, দেশের সামগ্রিক উন্নতি ত্বরান্বিত হবে। আরেকটা কথা হচ্ছে, নারীদের জন্য কোটা রাখলে অনিবার্যভাবে পুরুষরা কি পিছিয়ে পড়ে না? অবহেলিত হয় না? বিষয়টা নারী-পুরুষ সমানাধিকারের পরিপন্থী কিনা, তা-ও ভেবে দেখা দরকার।
শারীরিকভাবে অক্ষম দেশের নাগরিকরা, যাদেরকে প্রতিবন্ধী বলা হয়, তাদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা রাখার পক্ষে অনেকেই সোচ্চার। বলে থাকেন, তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনস্বরূপ এবং তারা যাতে নিজেদেরকে সমাজ, রাষ্ট্র বা পরিবারের বোঝা মনে না করে, সেজন্য তাদের জন্য চাকরিতে কোটা রাখা উচিত। কিন’ এটা ভাবেন না যে, কেবল চাকরিতে কোটা রাখাই তাদের প্রতি সহানুভূত প্রদর্শনের একমাত্র পথ নয়। বরং শারীরিকভাবে অক্ষম যারা পড়াশুনায় আগ্রহী, তাদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সবরকম সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা, তাদের সব শিক্ষা উপকরণ বিনামূল্যে সরবরাহ করা এবং তাদেরকে পর্যাপ্ত উপবৃত্তির ব্যবস্থা রাখলে তারা শিক্ষিত হয়ে প্রথম শ্রেণির নাগরিক হবার সুযোগ পাবে। পড়াশুনা শেষে তারা তাদের যোগ্যতা দিয়ে চাকরির চেষ্টা করবে। চাকরি পেলে তো ভালো, না পেলে তাদের জন্য চলার মতো পর্যাপ্ত ভাতার ব্যবস’া করা হলে তারা তাদের জীবনকে অভিশপ্ত মনে করবে না। তাছাড়া শারীরিক প্রতিবন্ধী সবাই তো আর পড়াশুনা করার সুযোগ পায় না। অনেক অশিক্ষিত মানুষ প্রতিবন্ধী হয় পরিণত বয়সে এসে বিভিন্ন দুর্ঘটনায়। তাদের জন্য তো চাকরিতে কোটা রাখলেও তারা উপকৃত হবার সুযোগ পাবে না। সুতরাং প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা না রেখে তাদের চলার মতো সম্মানজনক ভাতা প্রদান করাই হবে তাদের প্রতি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সহানুভূতি।
আর প্রতিবন্ধীদের মধ্যে যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা পেয়ে শিক্ষিত হবে, তাদের জন্য আর দশজনের মতো চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ তো থাকছেই। এমন তো নয় যে, প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা না রাখলে শিক্ষিত প্রতিবন্ধীরা চাকরি করার সুযোগই পাবে না!
কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর পর থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটার পরিণতি নিয়ে অনেককে বেশ সরব হতে দেখা যায়। কারও কারও বক্তব্যে মনে হয়, কোটা মানেই যেন শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছাড়া দেশে আর কোনো কোটা নেই! এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিলের ঘোষণা দেয়ার কারণে কোটাবিরোধী আন্দোলন স’গিত হবার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখার পক্ষে নতুন করে আন্দোলন হতে দেখা যায়। এসব আন্দোলন দেখে মনে হয়, মুক্তিযোদ্ধারা এবং তাদের পরিবার ও সন-ান-সন’তিরা রাষ্ট্র থেকে আর কোনো রকম সুবিধা ভোগ করছে না। চাকরিতে তাদের জন্য কোটা সংরক্ষণের দায়িত্বই শুধু রাষ্ট্র তাদের জন্য পালন করছে! বরং কোটা ছাড়াও বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রাষ্ট্রীয় অনেক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। যেমন: মুক্তিযোদ্ধাদেরকে প্রতি মাসে সম্মানজনক সম্মানী ভাতা দেয়া হচ্ছে (তাদেরকে বিজয় দিবস ভাতা প্রদানের কথাও উঠেছে সম্প্রতি), মুক্তিযোদ্ধাদের সন-ানদের জন্য চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ করা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে পৃথক মন্ত্রণালয়ও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এমনকি মাঝে মাঝে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সন-ানদের জন্য আলাদাভাবে নিয়োগের ব্যবস’াও করা হয়, যেখানে অন্যরা আবেদনও করতে পারে না।
এটা অনস্বীকার্য, মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সর্বোৎকৃষ্ট সন-ান। তারা এবং তাদের বংশধররা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিভিন্ন রকম সুযোগ পাবার দাবি রাখে। বর্তমানে সরকারি চাকরিতে কোটা ছাড়া যে সুবিধাগুলো তারা পাচ্ছে, সেগুলোর সাথে আরো কিছু যোগ করা যেতে পারে। যেমন, জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা আরো বৃদ্ধি করা যেতে পারে, মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সন-ানদের প্রত্যেকের জন্য সম্মানী ভাতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে এবং মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের বংশধরের জন্য সরকারিভাবে আবাসনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এসব করলে সরকারি চাকরিতে তাদের জন্য আলাদা কোটা না রাখলেও চলবে। বরং চাকরিতে প্রবেশের পথ সবার জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত রাখলে শুধুমাত্র মেধাবীরাই দেশের সেবা করার সুযোগ পাবে, মুক্তিযোদ্ধার সন-ান হোক বা না হোক।
দেশের আরো কিছু দুর্বল ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী আছে, তাদের জন্য চাকরিতে কোটা ছাড়াও অনেক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বর্তমান সরকারের সামর্থ এবং সাহস উভয়টা আছে। যে সরকার নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু করতে পারে, দেশের বড় বড় শহরে বিশাল বিশাল ফ্লাইওভার তৈরি করতে পারে, দেশকে ডিজিটাল দেশে রূপান্তরের জন্য অভাবনীয় সব পদক্ষেপ নিতে পারে, সে সরকার দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা ব্যতীত অনেক কিছুই করতে পারে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংরক্ষণই বিশেষ, দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করার একমাত্র পন্থা নয়।
কোটার গ্যাঁড়াকলে পড়ে দেশের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। দেশের মেধা কাজে লাগছে অন্য দেশের কাজে। এই সব মেধাবী শিক্ষার্থীদের দেশে ধরে রাখার জন্য কোটা প্রথা পুরোপুরি বাতিলের বিকল্প নেই। দেশে বেকার সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনেও কোটাপ্রথার কিছুটা হলেও দায় রয়েছে। তাই সার্বিক দিক বিবেচনায় কোটাপ্রথাকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করলে পুরো জাতি উপকৃত হবে। সবাই নিজ মেধা ও যোগ্যতাবলে চাকরিতে প্রবেশের চেষ্টা করবে, কোটার ফাঁকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল মেধাবীরা সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসার সুযোগ পাবে না।
নূর আহমদ : শিক্ষক
nurahmad786@gmail.com
শিক্ষক, রোকনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বশিকপুর, সদর লক্ষ্মীপুর।