প্রত্যাশিত ‘বিগ জাম্প’ পে-স্কেল ২০২৫ । ৫ বছর স্বস্তি ও ১০ বছর পর বড় অঙ্কের বেতনের দাবি?
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো (পে-স্কেল) প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। বর্তমান জীবনযাত্রার ব্যয় ও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির প্রেক্ষাপটে, এবার এমন একটি পে-স্কেলের দাবি উঠেছে, যা কর্মচারীদের আগামী অন্তত ৫ বছর আর্থিক স্বস্তি দেবে এবং ১০ বছর পর পে-স্কেল কার্যকর হওয়ার কারণে বেতনের অঙ্ক হতে হবে ‘বিগ জাম্প’ বা বড় আকারের।
সর্বশেষ পে-স্কেল কার্যকর হয়েছিল ২০১৫ সালে। সেই হিসেবে, ১০ বছর পর নতুন পে-স্কেল আসায়, কর্মচারীরা মনে করছেন, এবার বেতনের কাঠামো এমনভাবে নির্ধারণ করা উচিত যাতে তা বর্তমান বাজারদরের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় এবং পরবর্তী ৫ বছর মূল্যস্ফীতির চাপ সামলে চলতে পারে।
৫ বছর স্বস্তির জন্য বড় অঙ্কের দাবি
সরকারি কর্মচারী সংগঠনগুলো ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রস্তাবনা জাতীয় বেতন কমিশনের কাছে জমা দিয়েছে। এসব প্রস্তাবনায় মূলত জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং বাজারদরের কথা তুলে ধরা হয়েছে। কর্মচারীদের প্রধান দাবি হলো:
১. মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনা: বিগত ১০ বছরে মূল্যস্ফীতির কারণে টাকার মান কমেছে, তাই মূল বেতন এমনভাবে বাড়াতে হবে যাতে বর্তমান ক্রয়ক্ষমতা বজায় থাকে এবং পরবর্তী ৫ বছর সহজে জীবনযাপন করা যায়। ২. সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত: বৈষম্য কমাতে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত যৌক্তিক পর্যায়ে (যেমন ১:৪ বা ১:৬) নিয়ে আসার দাবি উঠেছে। অনেক ফোরামের পক্ষ থেকে সর্বনিম্ন বেতন ৩২ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ বেতন ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ৩. বর্ধিত ভাতা: চিকিৎসা ভাতা, শিক্ষা ভাতাসহ অন্যান্য ভাতাসমূহ বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি করার দাবি জানানো হয়েছে।
১০ বছর পর ‘বিগ জাম্প’-এর প্রত্যাশা
সরকারি বেতন কাঠামো সাধারণত প্রতি ৫ বছর অন্তর পর্যালোচিত হওয়ার নিয়ম থাকলেও, এবার তা হচ্ছে প্রায় ১০ বছর পর। এই দীর্ঘ বিরতির কারণেই কর্মচারীদের মধ্যে এবার একটি ‘বিশাল অঙ্কের’ বেতন বৃদ্ধির জোরালো দাবি তৈরি হয়েছে। তাদের মতে, দীর্ঘ অপেক্ষার ফলস্বরূপ নতুন পে-স্কেলে বেতনের অঙ্ককে অবশ্যই একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় যেতে হবে।
এ বিষয়ে বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন, “যদি সময়মতো ৫ বছর পর পে-স্কেল হতো, তবে বেতন বৃদ্ধি সামান্য হলেও মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু ১০ বছর পর যেহেতু পে-স্কেল হচ্ছে, তাই এই বেতন কাঠামোতে অবশ্যই একটি ‘বিগ জাম্প’ থাকতে হবে, যাতে কর্মচারীরা অন্তত পরবর্তী ৫-৬ বছর মূল্যস্ফীতি নিয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে পারেন।”
কমিশনের কার্যক্রম ও সরকারের মনোভাব
ইতিমধ্যে জাতীয় বেতন কমিশন, ২০২৫ গঠন করা হয়েছে এবং কমিশন বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করছে। সূত্রমতে, কমিশন প্রতিবেশী দেশগুলোর বেতন কাঠামো, বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের কাঠামোও পর্যালোচনা করছে। কমিশন আগামী বছরের শুরুতেই (জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে) নতুন বেতন কাঠামো কার্যকরের লক্ষ্যে দ্রুততার সাথে কাজ করছে।
সরকারের পক্ষ থেকেও বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি যৌক্তিক বেতন কাঠামো নির্ধারণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে, সরকারি কর্মচারীদের জীবনমানের উন্নতি ও কাজের গতিশীলতা বজায় রাখার জন্য এবারের পে-স্কেলে একটি বড় ধরনের আর্থিক সুবিধা আসার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
নতুন পে-স্কেল ঘোষণার মাধ্যমে সরকারি কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ হবে এবং অর্থনীতিতে এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
সরকারি কর্মচারীরা বর্তমান প্রেক্ষাপটে এমন একটি বেতন কাঠামো (পে-স্কেল) চান যা জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং বিদ্যমান বেতন বৈষম্য দূর করে একটি ন্যায্য ও মানবিক কাঠামো নিশ্চিত করে। তাদের প্রধান দাবি এবং প্রত্যাশাগুলো নিম্নরূপ:
১. ন্যায্য ও বৈষম্যমুক্ত বেতন কাঠামো
- ১:৪ বা ১:৬ অনুপাত: সরকারি কর্মচারীরা (বিশেষ করে ১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীরা) সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত বর্তমানে বিদ্যমান ১:১০ অনুপাত থেকে কমিয়ে ১:৪ অথবা অন্তত ১:৬ করার দাবি জানিয়েছেন। তাদের মতে, এটি বেতন বৈষম্য কমাতে সাহায্য করবে।
- সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতন: কর্মচারী ফোরামগুলো সুনির্দিষ্টভাবে সর্বনিম্ন মূল বেতন ৩২,০০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ মূল বেতন ১,২৮,০০০ টাকা করার প্রস্তাব করেছে।
- গ্রেড সংখ্যা হ্রাস: বর্তমানে থাকা ২০টি গ্রেড ভেঙে ১২ থেকে ১৫টি গ্রেড করার দাবি উঠেছে, যাতে পদোন্নতি এবং বেতন কাঠামোতে জটিলতা কমে।
২. বর্ধিত বেতন-ভাতা ও আর্থিক সুবিধা
- বেতন বৃদ্ধি: দীর্ঘ ১০ বছর পর নতুন পে-স্কেল আসায়, মূল্যস্ফীতি ও বাজারদরের ঊর্ধ্বগতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে মূল বেতন উল্লেখযোগ্য হারে (সম্ভব হলে দ্বিগুণ) বৃদ্ধি করার দাবি রয়েছে।
- ভাতা পুনর্নির্ধারণ: বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে চিকিৎসা ভাতা, শিক্ষা ভাতা, যাতায়াত ভাতাসহ অন্যান্য ভাতাসমূহ যৌক্তিক হারে বাড়াতে হবে।
- শতভাগ পেনশন প্রবর্তন: বিদ্যমান ৯০ শতাংশ পেনশনের পরিবর্তে শতভাগ পেনশন সুবিধা চালু করার দাবি রয়েছে।
- আনুতোষিক (গ্র্যাচুইটি) বৃদ্ধি: আনুতোষিকের হার প্রতি ১ টাকার বিপরীতে ২৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করার দাবি জানানো হয়েছে।
৩. প্রশাসনিক ও অন্যান্য সুবিধা
- টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল: ২০১৫ সালের পে-স্কেলে বাতিল হওয়া টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার দাবি উঠেছে।
- এক ও অভিন্ন নিয়োগবিধি: সরকারি চাকরিতে এক ও অভিন্ন নিয়োগবিধি বাস্তবায়ন করে বিভিন্ন দপ্তর ও অধিদপ্তরের কর্মচারীদের পদবি ও বেতন বৈষম্য দূর করার দাবি রয়েছে।
- রেশন ব্যবস্থা: ১১-২০ গ্রেডের সরকারি কর্মচারীদের জন্য রেশন ব্যবস্থার প্রবর্তন করার দাবি জানানো হয়েছে।
সংক্ষেপে, সরকারি কর্মচারীরা এমন একটি পে-স্কেল চান যা শুধু ১০ বছরের মূল্যস্ফীতিকেই সামাল দেবে না, বরং একটি বৈষম্যমুক্ত, মানবিক এবং দীর্ঘমেয়াদে (পরবর্তী ৫-৬ বছর) স্বস্তি দেবে এমন আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
সরকারি কর্মচারীদের নতুন বেতন কাঠামো নিয়ে সরকার বা জাতীয় বেতন কমিশন কী ধরনের কাঠামো দিতে ইচ্ছুক, তা চূড়ান্তভাবে ঘোষণা না হলেও কমিশনের প্রাথমিক আলোচনা ও অর্থ বিভাগের মনোভাব থেকে কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়:
১. নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়নের দৃঢ়তা
- অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে বাস্তবায়ন: অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, নতুন বেতন কাঠামো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদেই গেজেটের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। এর জন্য পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের জন্য অপেক্ষা করা হবে না।
- কার্যকরের সময়: সবকিছু ঠিক থাকলে, ২০২৬ সালের শুরুতেই (জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে) নতুন পে-স্কেল কার্যকর হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এর জন্য চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে প্রয়োজনীয় তহবিল বরাদ্দ রাখা হবে।
২. বেতনের অনুপাত ও কাঠামোগত পরিবর্তন
- বেতন বৃদ্ধির হার: কমিশনের পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো সংখ্যা বলা না হলেও, মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় বেতন উল্লেখযোগ্যভাবে (সম্ভাব্য দ্বিগুণ পর্যন্ত) বাড়ানোর ইঙ্গিত রয়েছে।
- অনুforপাত বজায় রাখা: কর্মচারীরা সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত ১:৪ করার দাবি জানালেও, কমিশন প্রতিবেশী দেশগুলোর কাঠামো (ভারত, পাকিস্তান) পর্যালোচনার ভিত্তিতে বর্তমানে থাকা প্রায় ১:১০ অনুপাতটি ৮:১ থেকে ১০:১ এর মধ্যে রাখার দিকেই বেশি আগ্রহী। অর্থাৎ, সর্বোচ্চ গ্রেডের কর্মকর্তার বেতন নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীর বেতনের ৮ থেকে ১০ গুণ হতে পারে।
- গ্রেড হ্রাস: বিদ্যমান ২০টি গ্রেড থেকে গ্রেডের সংখ্যা কমিয়ে ১২ থেকে ১৫টি করার প্রাথমিক আলোচনা চলছে।
৩. ভাতা ও বিশেষ সুবিধা বৃদ্ধিতে আগ্রহ
সরকার এবং কমিশন বেশ কিছু ভাতার ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আনতে আগ্রহী:
- চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি: বর্তমানে মাসিক ১,৫০০ টাকার চিকিৎসা ভাতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানোর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। পাশাপাশি, অবসরোত্তর সময়েও কর্মচারীদের জন্য স্বাস্থ্য সুবিধার বিশেষ ব্যবস্থা রাখার পরিকল্পনা রয়েছে।
- স্বাস্থ্য বীমা (Health Insurance): প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারি কর্মচারীদের জন্য স্বাস্থ্য বীমা (Health Insurance) চালুর বিষয়ে জোর দিয়েছেন, যাতে অসুস্থতার কারণে কর্মচারীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন।
- শিক্ষা ভাতা ও অন্যান্য: সন্তানদের শিক্ষা ভাতা বাড়ানোর সুপারিশ থাকবে। এছাড়াও বিশেষায়িত চাকরি (যেমন: চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) জন্য বিশেষ প্রণোদনা ভাতার প্রস্তাব থাকতে পারে, যাতে মেধাবীরা এসব পেশায় আকৃষ্ট হন।
মোটকথা, সরকার একটি ‘যৌক্তিক ও সময়োপযোগী’ বেতন কাঠামো দিতে ইচ্ছুক, যা মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলায় সহায়তা করবে। তবে কর্মচারীদের প্রত্যাশিত ১:৪ অনুপাতের চেয়ে কমিশন ১:৮ থেকে ১:১০ অনুপাত বজায় রেখে মূল বেতন বাড়ানো এবং ভাতা ও অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা দেওয়ার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।
সরকারি ইঙ্গিত, পে কমিশনের আলোচনা এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে একটি সম্ভাব্য বেতন কাঠামো নিচে তুলে ধরা হলো। এটি কমিশনের চূড়ান্ত সুপারিশ নয়, বরং বর্তমান আলোচনার ভিত্তিতে একটি ধারণা মাত্র।
নবম জাতীয় বেতন স্কেল (সম্ভাব্য) কাঠামো
নতুন বেতন কাঠামোতে যে মূল বিষয়গুলো প্রাধান্য পেতে পারে: