বৈষম্য । দাবীর খতিয়ান । পুন:বিবেচনা

নতুন পে স্কেলে আসছে ‘বৈপ্লবিক’ পরিবর্তন ২০২৫ । বেতন দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা, তবে বৈষম্য নিরসন নিয়ে সংশয়

সরকারি কর্মচারীদের জন্য অপেক্ষমাণ নতুন বেতন কাঠামো বা পে স্কেলে এক ‘বৈপ্লবিক পরিবর্তন’ আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যা অনেকের ধারণার বাইরে বলে মনে করা হচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি কর্মচারী সংগঠনের নেতাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী, আসন্ন এই পে স্কেলে বেতন-ভাতায় একটি বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটতে পারে। তবে, বৈষম্য নিরসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিকটিতে প্রত্যাশা অনুযায়ী পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এবং সংগঠনগুলোর দাবির বিশ্লেষণে জানা যাচ্ছে।

🔥 বেতন বৃদ্ধিতে ‘বিগ-ব্যাং’

পে কমিশনের সূত্র ও বিভিন্ন সংগঠনের প্রস্তাব অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারীদের মূল বেতন ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির সুপারিশ করা হতে পারে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও সর্বশেষ ২০১৫ সালে পে স্কেল বাস্তবায়নের পর দীর্ঘ বিরতিকে (নিয়মিত ৫ বছর পর পর হওয়ার কথা থাকলেও ২০২০ ও ২০২৫ সালে হয়নি) বিবেচনায় নিয়ে এই ‘দ্বিগুণ’ বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।

  • সর্বনিম্ন বেতন: বর্তমানে সর্বনিম্ন বেতন ৮,২৫০ টাকা, যা বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

  • সর্বোচ্চ বেতন: বিভিন্ন প্রস্তাবে সর্বোচ্চ বেতন ১,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে।

  • কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা: অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের বক্তব্য অনুযায়ী, নতুন বেতন কাঠামো ২০২৬ সালের জানুয়ারি/মার্চ/এপ্রিলের মধ্যে গ্যাজেটের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হতে পারে।

এছাড়াও, শুধু মূল বেতন নয়, চিকিৎসা, শিক্ষা, ও অবসরোত্তর ভাতা-সহ অন্যান্য আর্থিক ও অনার্থিক সুবিধাতেও ‘যুগান্তকারী’ পরিবর্তন আসার কথা শোনা যাচ্ছে। কিছু বিদ্যমান সুবিধা বাতিল করে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মতো ‘সাকুল্য বেতন’ বা ‘পারিশ্রমিক’ নামে বিকল্প কাঠামো প্রবর্তনের চিন্তা-ভাবনাও চলছে।

⚖️ বৈষম্য নিরসন: প্রত্যাশা বনাম বাস্তবতা

বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বেতন বৃদ্ধির পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গ্রেডভিত্তিক বৈষম্য নিরসনের ওপর সর্বাধিক জোর দিয়েছেন।

  • সংগঠনগুলোর প্রত্যাশা: বর্তমানে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত প্রায় ১:১০। ১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীদের সংগঠনগুলো এই অনুপাত কমিয়ে ১:৪ করার জোর দাবি জানিয়েছে।

  • কমিশনের পর্যালোচনা: কমিশন সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের এই অনুপাত কমানোর বিষয়টি পর্যালোচনা করলেও, প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিদ্যমান অনুপাতকে মাথায় রেখে তা ৮:১ থেকে ১০:১-এর মধ্যে রাখার সুপারিশ করতে পারে।

  • গ্রেড কমানো: বিদ্যমান ২০টি গ্রেড ভেঙে গ্রেডের সংখ্যা কমিয়ে আনার চিন্তা চলছে, যা বেতন কাঠামোতে কিছুটা সামঞ্জস্য আনতে পারে। তবে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের দাবি, পদবি পরিবর্তন ও গ্রেড উন্নীতকরণের মাধ্যমে বৈষম্য দূর করতে হবে।

বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠন বৈষম্যহীন পে স্কেল বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে মানববন্ধন অব্যাহত রেখেছে। তারা ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বৈষম্য নিরসন করে পূর্ণাঙ্গ পে স্কেল বাস্তবায়নের আলটিমেটামও দিয়েছে।

সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এক দশক পর আসা নতুন পে স্কেলে সরকারি কর্মচারীদের আর্থিক সুবিধা এক লাফে অনেকখানি বৃদ্ধি পেতে পারে, যা সত্যিই এক ‘বৈপ্লবিক’ পরিবর্তন। তবে বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠনের পক্ষ থেকে বৈষম্য নিরসনে জোরালো দাবি থাকা সত্ত্বেও, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত খুব বেশি কমানো না হলে, বৈষম্য নিরসনের প্রত্যাশা অপূর্ণই থেকে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সরকারি কর্মচারীরা নতুন পে স্কেলে মূলত তিনটি প্রধান দিককে কেন্দ্র করে তাদের দাবি ও প্রত্যাশা তুলে ধরেছেন: (১) বিপুল পরিমাণ বেতন বৃদ্ধি, (২) গ্রেডভিত্তিক বৈষম্য নিরসন, এবং (৩) অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার যৌক্তিকীকরণ ও বৃদ্ধি।

বিভিন্ন সংগঠন ও কর্মচারীদের দাবির বিশ্লেষণ নিচে দেওয়া হলো:

💰 আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি (মূল ফোকাস)

দাবির বিষয়বর্তমান অবস্থা (২০১৫ পে স্কেল)কর্মচারীদের প্রত্যাশাকারণ/যৌক্তিকতা
সর্বনিম্ন মূল বেতন৮,২৫০ টাকা২৫,০০০ টাকা থেকে ৩৫,০০০ টাকা পর্যন্তদ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং দীর্ঘ ৮ বছরের মূল্যস্ফীতি সমন্বয়।
পে স্কেলের অনুপাত১:১০ (সর্বনিম্ন:সর্বোচ্চ)১:৪ থেকে ১:৫-এর মধ্যেসর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের মধ্যেকার ব্যবধান কমানো এবং গ্রেডভিত্তিক বৈষম্য নিরসন।
বেতন বৃদ্ধির হারগড়ে ১৫-২০% (সচরাচর ৫ বছর পর)ন্যূনতম ৯০% থেকে ১০০% বৃদ্ধিদীর্ঘ ১০ বছর পর নতুন স্কেল হওয়ায় এই বড় ধরনের উল্লম্ফন দাবি করা হচ্ছে।

⚖️ বৈষম্য নিরসন ও গ্রেড কাঠামো

  • গ্রেড কমানো: বিদ্যমান ২০টি গ্রেডকে কমিয়ে ১৬টি বা ১৪টি গ্রেডে নামিয়ে আনা।

  • পদবি ও গ্রেড উন্নীতকরণ: নিম্ন গ্রেডের (১১-২০) কর্মচারীদের পদবি পরিবর্তন করে মর্যাদা বৃদ্ধি করা এবং তাদের গ্রেড উন্নীত করা। তারা মনে করেন, একই যোগ্যতার কাজে নিয়োজিত থেকেও পদবির কারণে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।

  • টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনঃপ্রবর্তন: পে স্কেল বাস্তবায়নের আগে পদোন্নতি না হলে উচ্চতর গ্রেডে যাওয়ার জন্য টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পদ্ধতি পুনরায় চালু করার দাবি।

🩺 ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধি

  • চিকিৎসা ভাতা: বর্তমানের নামমাত্র চিকিৎসা ভাতা (সাধারণত ১,৫০০ টাকা) বহুগুণ বাড়িয়ে মাসিক কমপক্ষে ৫,০০০ টাকা করার দাবি।

  • বাড়ি ভাড়া ভাতা: বাসা ভাড়ার বাজার মূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এলাকাভেদে বাড়ি ভাড়া ভাতার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা। বিশেষ করে ঢাকা শহরের জন্য বেশি হারে এই ভাতা দাবি করা হয়েছে।

  • শিক্ষা সহায়ক ভাতা: সন্তানের সংখ্যা অনুযায়ী শিক্ষা সহায়ক ভাতা বাড়ানো এবং বর্তমানের ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২,০০০ থেকে ৩,০০০ টাকা করা।

  • নববর্ষ ভাতা: মূল বেতনের পরিবর্তে এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ করার দাবি।

  • অবসর সুবিধা: অবসর গ্রহণের পর এককালীন লাম্প গ্রান্ট এবং মাসিক পেনশনের হার বৃদ্ধি করা।

সংক্ষেপে, সরকারি কর্মচারীদের মূল চাওয়া হলো: মূল্যস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বেতন দ্বিগুণ করা এবং দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের প্রতি বৈষম্য দূর করে একটি মর্যাদাশীল ও আর্থিকভাবে সচ্ছল জীবন নিশ্চিত করা।

Alamin Mia

আমি একজন সরকারী চাকরিজীবি। দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ চাকুরির সুবাদে সরকারি চাকরি বিধি বিধান নিয়ে পড়াশুনা করছি। বিএসআর ব্লগে সরকারি আদেশ, গেজেট, প্রজ্ঞাপন ও পরিপত্র পোস্ট করা হয়। এ ব্লগের কোন পোস্ট নিয়ে প্রশ্ন থাকলে বা ব্যাখ্যা জানতে পোস্টের নিচে কমেন্ট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *