সর্বশেষ প্রকাশিত পোস্টসমূহ

মন্ত্রণালয়-দপ্তরে পদবি ও বেতন বৈষম্য প্রকট ২০২৫ । নিরসনের লক্ষ্যে কাল পর্যালোচনা সভা বসবে?

মন্ত্রণালয় ও এর অধীন বিভিন্ন অধিদপ্তর/সংস্থার কর্মচারীদের মধ্যে পদবি এবং বেতন স্কেলের দীর্ঘদিনের বৈষম্য নিরসনের দাবিতে তীব্র ক্ষোভের মুখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আগামীকাল সোমবার (দিনের নাম পরিবর্তন করে সোমবার ধরে নেওয়া হয়েছে) একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যালোচনা সভা ডেকেছে। দপ্তর, অধিদপ্তর ও সংস্থার কর্মচারীরা তাদের প্রধান সহকারী/সহকারী, উচ্চমান সহকারী পদবিগুলোকে সচিবালয়ের মতো প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং স্টেনোগ্রাফার পদবিকে ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-তে উন্নীত করে দাপ্তরিক পদবি ও বেতন বৈষম্য দূর করার দাবি জানিয়েছেন।

বৈষম্যের সূত্রপাত

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৫ সালের আগে সচিবালয়সহ দেশের সব অধিদপ্তর ও এর আওতাধীন দপ্তরসমূহের প্রধান সহকারী/সহকারী, উচ্চমান সহকারী, শাখা সহকারী, বাজেট পরীক্ষক ও স্টেনোগ্রাফার পদবিগুলোর নিয়োগবিধি, কর্মপরিধি, এবং বেতন স্কেল একই ছিল। কিন্তু ১৯৯৫ সালে শুধু সচিবালয়ের উল্লিখিত পদবিগুলোকে একীভূত করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং স্টেনোগ্রাফার পদবিকে ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে পরিবর্তন করা হয়।

  • ১৯৯৭ সালের ২৮ এপ্রিল: সচিবালয়ের এই দুটি পদবির বেতন গ্রেড ১৪ ও ১৩ থেকে ১১তম গ্রেডে উন্নীত করা হয়।
  • ১৯৯৯ সালে: পদবিগুলোকে দশম গ্রেডে উন্নীত করে দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড মর্যাদা দেওয়া হয়।

পরবর্তীকালে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি), বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), গণভবন, বঙ্গভবন, এবং বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের (হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ) পদবিও পরিবর্তন করে প্রশাসনিক কর্মকর্তাকরণসহ বেতন দশম গ্রেডে উন্নীত করা হয়।

আন্দোলন ও আইনি বিজয়

এদিকে, সরকার ব্লক সুপারভাইজার, ডিপ্লোমা প্রকৌশলী, নার্স, পুলিশের এসআই-এর মতো সমপদ বা নিম্ন গ্রেডের অনেক পদবিকে দশম গ্রেডসহ দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদায় উন্নীত করায় সংস্থাগুলোর কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ে এবং আন্দোলন শুরু হয়।

সাম্প্রতিক আইনি রায় এই আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে:

  • প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক: ১৬ ও ১৭ গ্রেডে থাকা ৪৬ জন প্রধান শিক্ষকের করা মামলায় সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ রায় তাদের পক্ষে দিলে দেশের ৬৫ হাজারেরও অধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বেতন দশম গ্রেডে উন্নীত করা হয়।
  • পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের স্টেনোগ্রাফার: ২৯ জন স্টেনোগ্রাফারের করা মামলায় প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল তাদের পক্ষে রায় দেয়। সরকার আপিল করলেও সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ অতিসম্প্রতি ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রাখেন এবং ১৯৯৭ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে আবেদনকারীদের সব বকেয়া পরিশোধের নির্দেশনা দেন।

কর্মচারীরা এখন এই রায়কে অনুসরণ করে ডাক অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ অন্যান্য অধিদপ্তর ও এর আওতাধীন দপ্তরসমূহের প্রধান সহকারী/সহকারী, উচ্চমান সহকারী পদবিকে সচিবালয়ের মতো প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং স্টেনোগ্রাফার পদবিকে ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকরণসহ বেতন দশম গ্রেডে উন্নীত করে ৩০ বছরের দাপ্তরিক পদবি ও বেতন বৈষম্য নিরসনের জোরালো দাবি জানিয়েছেন।

এই প্রেক্ষাপটে আগামীকাল সকালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা আশা করছেন, এই সভার মাধ্যমে তাদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার অবসান ঘটবে।

মন্ত্রণালয় কেন এতদিন বৈষম্য জিইয়ে রাখছে?

১. 🛡️ আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর প্রভাব ও আধিপত্য (Generalist vs. Specialist)

  • সচিবালয়কেন্দ্রিক সুবিধা: সরকারি নীতি নির্ধারণী কাজে নিয়োজিত প্রশাসন ক্যাডারের (জেনারেলিস্ট) কর্মকর্তারা সাধারণত সচিবালয়ে কাজ করেন। তাদের প্রভাব ও ক্ষমতা অন্যান্য অধিদপ্তরের (স্পেশালিস্ট) তুলনায় বেশি থাকে। ১৯৯৫, ১৯৯৭ এবং ১৯৯৯ সালে শুধু সচিবালয়ের কর্মচারীদের পদবি ও বেতন গ্রেড উন্নীত করার সিদ্ধান্ত এই আমলাতান্ত্রিক অগ্রাধিকারের ফল হিসেবে দেখা যেতে পারে।
  • ক্ষমতার ভারসাম্য: বিভিন্ন দপ্তর/অধিদপ্তরের কর্মচারীরা অভিযোগ করেন যে, প্রভাবশালী সচিব বা আমলারা নিজেদের এখতিয়ার ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য অন্যান্য দপ্তরের কর্মচারীদের পদোন্নতি বা পদবি পরিবর্তনের দাবি পূরণে কালক্ষেপণ করেন।

২. ⏳ দীর্ঘসূত্রিতা ও নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়া

  • বিশাল সংখ্যক কর্মচারী: বৈষম্য নিরসন মানে কয়েক হাজার কর্মচারীর পদবি ও বেতন গ্রেডের পরিবর্তন, যা সরকারের ওপর আর্থিক ও প্রশাসনিক চাপ তৈরি করে। এত বড় আকারের কাঠামোগত পরিবর্তন আনার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই সময়সাপেক্ষ ও ধীরগতি সম্পন্ন হয়।
  • নথিপত্র চালাচালি ও কমিটি: বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, এই বৈষম্য নিরসনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশনা, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশ এবং বহুবার কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এরপরও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের স্তরে এসে নথিপত্র চালাচালির মাধ্যমে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

৩. ⚖️ আইনি জটিলতা ও দাপ্তরিক সীমাবদ্ধতা

  • মামলা-মোকদ্দমা: কিছু ক্ষেত্রে কর্মচারীরা যখন আইনি পথে যান (যেমন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বা পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের স্টেনোগ্রাফার), তখন আদালতের রায় তাদের পক্ষে এলেও, সেই রায় সমস্ত দপ্তরের জন্য একযোগে বাস্তবায়ন করতে দাপ্তরিক ও আইনি ব্যাখ্যায় জটিলতা দেখা দেয়। সরকার আপিল করে বা অন্যভাবে সময় নিয়ে নেয়।
  • অর্থনৈতিক প্রভাব: পদোন্নতি বা গ্রেড উন্নীতকরণের অর্থ হলো সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ দেওয়া। সরকারের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং জাতীয় বেতন কাঠামোর সার্বিক ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টিও এখানে বিবেচ্য হয়।

৪. 📢 ঐক্যবদ্ধ দাবির অভাব (প্রাথমিক পর্যায়ে)

যদিও বর্তমানে ‘বাংলাদেশ প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাস্তবায়ন ঐক্য পরিষদ’-এর ব্যানারে জোরালো আন্দোলন চলছে, তবুও বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার কর্মচারীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে সম্মিলিত ও সুসংগঠিত আন্দোলনের অভাব ছিল। অন্যদিকে, সচিবালয়ের কর্মচারীরা ঐক্যবদ্ধভাবে সুবিধা আদায়ে সফল হয়েছেন।

সংক্ষেপে, এই বৈষম্য এতদিন ধরে জিইয়ে থাকার পেছনে আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতা ও প্রভাব, ব্যাপক পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে সরকারের দীর্ঘসূত্রিতা, এবং আইনি ও অর্থনৈতিক জটিলতা প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করেছে।

Alamin Mia

আমি একজন সরকারী চাকরিজীবি। দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ চাকুরির সুবাদে সরকারি চাকরি বিধি বিধান নিয়ে পড়াশুনা করছি। বিএসআর ব্লগে সরকারি আদেশ, গেজেট, প্রজ্ঞাপন ও পরিপত্র পোস্ট করা হয়। এ ব্লগের কোন পোস্ট নিয়ে প্রশ্ন থাকলে বা ব্যাখ্যা জানতে পোস্টের নিচে কমেন্ট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *