আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রস্তুতি ২০২৫ । ২০২৫-২০২৬ করবর্ষের জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্রের তালিকা
২০২৫-২০২৬ করবর্ষের (আয়কাল: ০১/০৭/২০২৪ – ৩০/০৬/২০২৫) জন্য ব্যক্তিগত আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে প্রয়োজনীয় নথিপত্র এখন থেকেই গুছিয়ে রাখা জরুরি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্তৃক বর্তমানে সকল ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের জন্য (নির্দিষ্ট কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাই, করদাতাদের সুবিধার জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস বা কাগজপত্রের একটি তালিকা নিচে দেওয়া হলো, যা রিটার্ন প্রস্তুতের সময় হাতের কাছে রাখা আবশ্যক:
✅ প্রয়োজনীয় নথিপত্রের বিস্তারিত তালিকা
১. 🪪 ব্যক্তিগত ও মৌলিক তথ্য:
- ই-টিআইএন (e-TIN) সার্টিফিকেটের ফটোকপি।
- জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) এর ফটোকপি।
- ট্যাক্স পেমেন্টের প্রমাণ, যেমন চালানের কপি।
২. 💼 চাকুরিরত করদাতাদের জন্য (বেতনভোগী):
- নির্দিষ্ট অর্থবছরের বেতন সনদ (০১/০৭/২০২৪ – ৩০/০৬/২০২৫)।
- সংশ্লিষ্ট সময়ের ব্যাংক স্টেটমেন্ট (বেতন ও সুদের বিবরণীর জন্য)।
- উৎসে কর কর্তনের (TDS) সার্টিফিকেট (যেখানে আপনার বেতন থেকে কাটা করের বিবরণ থাকে)।
- প্রভিডেন্ট ফান্ড বা ভবিষ্য তহবিল সনদ (যদি থাকে)।
৩. 🏠 গৃহ সম্পত্তি হতে আয় থাকলে:
- ভাড়ার রশিদ বা ব্যাংক স্টেটমেন্টে ভাড়া গ্রহণের প্রমাণ।
- বাড়িভাড়ার চুক্তিপত্রের কপি।
- হোল্ডিং ট্যাক্স, ভূমি কর/খাজনা পরিশোধের রশিদের কপি।
- গৃহ সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ইত্যাদির ব্যয়ের বিস্তারিত তথ্য।
৪. 📈 ব্যবসায়িক করদাতাদের জন্য:
- ট্রেড লাইসেন্স-এর কপি।
- নির্দিষ্ট সময়ের (০১/০৭/২০২৪ – ৩০/০৬/২০২৫) বার্ষিক আয়, ক্রয় ও বিক্রয় বিবরণী।
- সম্পদ ও দায় (Asset & Liability) বিবরণী-এর হিসাব।
- নির্দিষ্ট সময়ের ব্যাংক বিবরণী (০১/০৭/২০২৪ – ৩০/০৬/২০২৫)।
৫. 💰 বিনিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য (কর রেয়াত পেতে):
- ডিপিএস (DPS) জমার স্লিপ বা বিবরণী।
- ইন্সুরেন্স সার্টিফিকেট বা জীবন বীমার প্রিমিয়াম পরিশোধের রশিদ।
- শেয়ার মার্কেট বিনিয়োগের বিবরণ (বিও অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্ট)।
- সঞ্চয়পত্রের কপি বা ক্রয়ের রসিদ।
- অন্যান্য কর রেয়াতযোগ্য খাতে বিনিয়োগের প্রমাণপত্র।
৬. 📊 সম্পদ ও দায় বিবরণী (Wealth Statement):
- ফ্ল্যাট, জমি, গাড়ি, আসবাবপত্র, ইলেকট্রনিকস প্রভৃতি (নিজ নামে) এর মূল্য নির্ধারণের তথ্য।
- ব্যাংক ঋণ/পার্সোনাল লোনের বিবরণ বা স্টেটমেন্ট (নিজ নামে)।
- অন্যান্য দায় বা ঋণ (নিজ নামে) এর বিবরণ।
৭. 📜 পূর্ববর্তী রিটার্ন:
- যারা নিয়মিত রিটার্ন দাখিল করে থাকেন, তাদের গত বছরের রিটার্ন কপির ফটোকপি সংযুক্ত করতে হবে।
💡 গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সম্প্রতি ঘোষণা করেছে যে, ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের প্রবীণ করদাতা, শারীরিকভাবে অসমর্থ করদাতা, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী করদাতা এবং মৃত করদাতার আইনগত প্রতিনিধি ব্যতীত সকল ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাকে অনলাইনে ই-রিটার্ন (e-Return) দাখিল করতে হবে। যদিও অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের সময় সরাসরি কোনো নথি আপলোড করার প্রয়োজন নেই, তবুও ভবিষ্যতে যাচাই-বাছাই বা অডিটের জন্য উল্লিখিত সকল কাগজপত্র নির্ভুলভাবে এন্ট্রি দেওয়ার জন্য এবং তা সংরক্ষণ করার জন্য হাতের কাছে রাখা আবশ্যক।
করদাতারা যেন নিজের রিটার্ন নিজেই নির্ভুলভাবে প্রস্তুত করতে পারেন, তার জন্য এনবিআর-এর ওয়েবসাইট বা ই-ট্যাক্স পোর্টালে প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা এবং FAQ (সচরাচর জিজ্ঞাসা) পাওয়া যাচ্ছে। রিটার্ন দাখিলের শেষ তারিখের জন্য অপেক্ষা না করে, সময়মতো সকল নথিপত্র গুছিয়ে নির্ভুলভাবে রিটার্ন দাখিল করার জন্য সংশ্লিষ্ট করদাতাদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।
রিটার্ন দাখিল না করলে কি হয়?
রিটার্ন দাখিল না করলে বা সময়মতো দাখিল না করলে একজন করদাতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ আয়কর আইন, ২০২৩ (Income Tax Act, 2023) অনুযায়ী নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ আইনগত ব্যবস্থা ও শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে:
১. 💰 জরিমানা ও সুদ (Penalty and Interest)
- জরিমানা (Penalty):
- নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে রিটার্ন দাখিল না করলে সর্বশেষ দাখিলকৃত রিটার্নে পরিশোধিত করের ১০% অথবা ন্যূনতম ১,০০০ টাকা (যা বেশি) জরিমানা হতে পারে।
- প্রতিদিন বিলম্বের জন্য ৫০ টাকা হারে অতিরিক্ত জরিমানা আরোপ করা হতে পারে, যতক্ষণ না রিটার্ন দাখিল করা হচ্ছে।
- সুদ (Interest):
- রিটার্ন দাখিলে বিলম্ব হলে, যে পরিমাণ কর বকেয়া থাকে, তার ওপর মাসিক ২% হারে সরল সুদ (Simple Interest) আরোপ করা হতে পারে।
২. ⚖️ মামলা ও কারাদণ্ড (Prosecution and Imprisonment)
রিটার্ন দাখিল না করা একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) মামলা দায়ের করতে পারে।
- মিথ্যা বা ভুল রিটার্ন দাখিল বা রিটার্ন দাখিলে ব্যর্থতা:
- আয়কর আইনের বিধান অনুযায়ী, রিটার্ন দাখিল না করলে বা ভুল তথ্য দিলে সর্বোচ্চ ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডই হতে পারে।
৩. 🚫 অন্যান্য আইনি জটিলতা ও অসুবিধা
- বিভিন্ন সেবা গ্রহণে বাধা: অনেক সরকারি ও বেসরকারি পরিষেবা নিতে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র (Acknowledgement Slip) বা ট্যাক্স সার্টিফিকেটের প্রয়োজন হয়। রিটার্ন দাখিল না করলে এই ধরনের সেবা পেতে সমস্যা হবে। যেমন:
- ব্যাংক ঋণ বা ক্রেডিট কার্ড আবেদন।
- বিভিন্ন লাইসেন্স বা রেজিস্ট্রেশনের আবেদন (যেমন- ঠিকাদারির লাইসেন্স, মোটরগাড়ি রেজিস্ট্রেশন)।
- কোনো কোম্পানির পরিচালক বা স্পন্সর শেয়ারহোল্ডার হওয়া।
- টেন্ডারে অংশগ্রহণ করা।
- কর নির্ধারণে কঠোরতা: কর কর্মকর্তা যদি মনে করেন যে আপনি ইচ্ছাকৃতভাবে রিটার্ন দাখিল করেননি, তবে তিনি উপলব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ হারে কর নির্ধারণ করতে পারেন, যা আপনার প্রকৃত করের চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে।
- সম্পদ যাচাই: রিটার্ন দাখিল না করলে আপনার সকল সম্পদ ও দায় (Assets and Liabilities) কঠোরভাবে যাচাই-বাছাই (Audit) এর আওতায় আসতে পারে।
⚠️ বিশেষ দ্রষ্টব্য
আইনগত জটিলতা ও আর্থিক জরিমানা এড়াতে, প্রতি বছর ৩০শে নভেম্বরের মধ্যে (যদি না সময় বাড়ানো হয়) বা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করা প্রতিটি করদাতার জন্য বাধ্যতামূলক। অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের ক্ষেত্রেও উপরে উল্লিখিত নিয়ম ও শাস্তি প্রযোজ্য।



