সরকারের আকার বাড়ছে, কিন্তু কর্মচারী কমছে: কেন এমন হচ্ছে?
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ এবং প্রকল্পের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা বাড়েনি, বরং অনেক ক্ষেত্রে কমেছে। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগে সরকারি নীতির পরিবর্তন।– সরকারের আকার বাড়ছে, কিন্তু কর্মচারী কমছে: কেন এমন হচ্ছে?
আউটসোর্সিংয়ের প্রবর্তন: কেন এবং কীভাবে? একসময় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর (যেমন—অফিস সহায়ক, নিরাপত্তা কর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী) স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হতো। এতে একদিকে যেমন কর্মসংস্থান তৈরি হতো, তেমনি সরকারি কর্মপরিবেশে একধরনের ধারাবাহিকতা বজায় থাকতো। কিন্তু ২০০৯ সালের পর থেকে সরকার এই নিয়োগ প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেয়। এর পরিবর্তে চালু করা হয় আউটসোর্সিং প্রথা। আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় কোনো সরকারি দপ্তর সরাসরি কর্মী নিয়োগ না দিয়ে একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনবল নেয়। এই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি কর্মীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পায়। সরকারের যুক্তি ছিল, এতে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আসবে, খরচ কমবে এবং শ্রম ব্যবস্থাপনা আরও সহজ হবে।
আউটসোর্সিংয়ের ফল: লাভ না ক্ষতি? আউটসোর্সিংয়ের কারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সরকারি দপ্তরে কর্মী সরবরাহ করে থাকে। এর ফলে কিছু সুবিধা যেমন এসেছে, তেমনি কিছু গুরুতর সমস্যাও তৈরি হয়েছে।
সুবিধা:
- প্রশাসনিক জটিলতা হ্রাস: সরকারি দপ্তরের নিজস্ব নিয়োগ প্রক্রিয়া ও বেতন-ভাতার প্রশাসনিক জটিলতা কমেছে।
- খরচ সাশ্রয়: সরকারি কোষাগার থেকে সরাসরি বেতন ও পেনশন দিতে না হওয়ায় সরকারের খরচ কমছে।
অসুবিধা:
- কর্মসংস্থান কমেছে: স্থায়ী সরকারি চাকরি কমে যাওয়ায় বেকার তরুণদের জন্য চাকরির সুযোগ কমে গেছে।
- শ্রম শোষণ: ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় কর্মীদের প্রাপ্য বেতন ও অন্যান্য সুবিধা পুরোপুরি দেয় না। কর্মীরা সরকারি দপ্তরের জন্য কাজ করেও সরকারি চাকরির কোনো মর্যাদা বা সুবিধা পান না।
- নিরাপত্তার অভাব: আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীদের চাকরি স্থায়ী নয়। যেকোনো সময় তাদের বাদ দেওয়া হতে পারে, যা তাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে।
- দুর্নীতি: ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্বাচন এবং কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ প্রায়শই শোনা যায়।
সরকারের আকার বাড়ছে, অথচ কর্মচারীর সংখ্যা কমছে—এই আপাত-বৈপরীত্যের পেছনে মূল কারণ হলো এই আউটসোর্সিং নীতি। এর ফলে সরকারের প্রশাসনিক ব্যয় হয়তো কমেছে, কিন্তু অসংখ্য তরুণের জন্য স্থায়ী ও সম্মানজনক চাকরির সুযোগ সংকুচিত হয়েছে। এই বিষয় নিয়ে আপনার যদি আরও কিছু জানার থাকে, তাহলে প্রশ্ন করতে পারেন।
আউটসোর্সিং বেতন নীতিমালা 2025 । কেন আউটসোর্সিং কর্মীগন এমন চাকরি করতে চায় না?
আউটসোর্সিং কর্মীদের চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাদের নিয়োগ হয় একটি নির্দিষ্ট চুক্তির অধীনে, যা সাধারণত এক বছর পর পর নবায়ন করা হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চাইলেই যেকোনো সময় কর্মী ছাঁটাই করতে পারে, যা তাদের মধ্যে চরম নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে। সরকারি দপ্তরের স্থায়ী কর্মীদের মতো তাদের চাকরি স্থায়ী বা সরকারি চাকরির বয়স শেষ হলেও পেনশন পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
Caption: Outsourcing rules 2025
আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া ২০২৫ । আউটসোর্সিং হলো এক ধরনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া, যেখানে একটি সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সরাসরি কর্মী নিয়োগ না করে তৃতীয় কোনো পক্ষ বা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেবা বা জনবল নেয়। এই পদ্ধতিতে নিয়োগ, বেতন-ভাতা এবং অন্যান্য সব প্রশাসনিক দায়িত্ব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই পালন করে।
- দরপত্র আহ্বান: যে সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জনবল নিতে চায়, তারা বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করে। এই দরপত্রে প্রয়োজনীয় জনবল, তাদের কাজের ধরন এবং অন্যান্য শর্ত উল্লেখ করা থাকে।
- চুক্তি সম্পাদন: সর্বনিম্ন দরদাতা বা সবচেয়ে উপযুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সেবা প্রদানের জন্য চুক্তি করা হয়।
- কর্মী বাছাই ও নিয়োগ: চুক্তি পাওয়ার পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে কর্মী বাছাই ও নিয়োগ করে। অনেক ক্ষেত্রে, যে প্রতিষ্ঠানে কর্মী প্রয়োজন, তারাও এই বাছাই প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়।
- কর্মী সরবরাহ: নিয়োগকৃত কর্মীদের নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কাজের জন্য পাঠানো হয়।
আউটসোর্সিং কর্মীগণ কি সরাসরি সরকারের নিকট হতে বেতন ও অন্যান্য সুবিধা পায়?
না। আউটসোর্সিং কর্মীদের বেতন-ভাতা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই পরিশোধ করে। তবে এই বেতন সাধারণত স্থায়ী পদের কর্মীদের থেকে কম হয়। তাদের বেতন কাঠামো সাধারণত বেতন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীর জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বেতন নির্ধারণ করে, যা সাধারণত সরকারি স্কেলের চেয়ে কম হয়। বোনাস ও অন্যান্য ভাতা স্থায়ী সরকারি কর্মীদের মতো উৎসব বোনাস বা অন্যান্য সরকারি ভাতা তারা সাধারণত পায় না। তবে কোনো কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব নীতি অনুযায়ী কিছু সুবিধা দিতে পারে। চাকরির নিরাপত্তা আউটসোর্সিং কর্মীদের চাকরির নিরাপত্তা থাকে না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বা যে প্রতিষ্ঠানে তারা কাজ করছে, তাদের ইচ্ছানুযায়ী যেকোনো সময় চুক্তি বাতিল হতে পারে। এই প্রক্রিয়ায়, কর্মীরা সরকারের জন্য কাজ করলেও তাদের সঙ্গে সরকারের সরাসরি কোনো চুক্তি থাকে না। তাদের সব দায়বদ্ধতা ও আইনি সম্পর্ক থাকে কেবল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
আউটসোর্সিং কর্মী নিয়োগে ঠিকাদারগণ কিভাবে আয় করে? আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ের প্রধান উৎস হলো সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া অর্থ এবং কর্মীদের বেতন-ভাতার মধ্যেকার পার্থক্য। এই প্রক্রিয়াটি বেশ কয়েকটি উপায়ে ঠিকাদারদের লাভবান হতে সাহায্য করে।
আয়ের প্রধান উৎস
সরকারি চুক্তি ও প্রাপ্য বেতন-ভাতার পার্থক্য: একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান যখন আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিতে চায়, তখন তারা একটি দরপত্র (Tender) আহ্বান করে। এই দরপত্রে প্রতিটি পদের জন্য একটি নির্দিষ্ট মাসিক বেতন-ভাতা উল্লেখ করা থাকে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো সেই নির্ধারিত বেতনের চেয়ে কম বেতনে কর্মী নিয়োগ দেয় এবং বাকি অর্থ নিজেদের লাভ হিসেবে রেখে দেয়।
উদাহরণস্বরূপ: যদি একটি সরকারি দপ্তরে একজন অফিস সহায়ক পদের জন্য মাসিক বেতন ২০,০০০ টাকা ধার্য করা হয়, তাহলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি এই পদের জন্য একজন কর্মী নিয়োগ দিয়ে তাকে হয়তো ১৫,০০০ টাকা বেতন দেয়। বাকি ৫,০০০ টাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পকেটে চলে যায়।
কমিশন বা সার্ভিস চার্জ: কিছু ক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মীদের মোট বেতন-ভাতার ওপর একটি নির্দিষ্ট হারে কমিশন বা সার্ভিস চার্জ নেয়। এটি চুক্তিতে উল্লেখ করা থাকে এবং এটিই তাদের বৈধ আয়ের উৎস। তবে বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে এর বাইরেও তারা নানা কৌশলে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করে।
শ্রমিকদের অন্যান্য সুবিধা না দেওয়া: আউটসোর্সিং কর্মীদের সরকারি কর্মীদের মতো নিয়মিত বেতন বৃদ্ধি, পেনশন, বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসব সুবিধা বাবদ কোনো খরচ করে না, ফলে তাদের লাভের অংশ বাড়ে।
নিয়োগের সময় ঘুষ নেওয়া: কিছু ক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মী নিয়োগের সময়ই চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ হিসেবে নেয়। এটি সম্পূর্ণ অবৈধ হলেও এমন ঘটনা প্রায়শই ঘটে থাকে।
বেতন-ভাতা অনিয়মিত করা: ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় কর্মীদের বেতন দিতে বিলম্ব করে বা মাসের পর মাস বকেয়া রাখে। এর ফলে তারা সেই টাকা অন্য কোনো খাতে বিনিয়োগ করে লাভবান হতে পারে।
সার্বিকভাবে, আউটসোর্সিং ব্যবস্থাটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জন্য খুবই লাভজনক প্রমাণিত হয়েছে। তবে এর ফলে কর্মীদের শ্রম শোষণ, বেতন কম পাওয়া, এবং চাকরির নিরাপত্তাহীনতাসহ নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
কোন কোন পদে আউটসোর্সিং নিয়োগ দেয়া যায়?
সিকিউরিটি গার্ড নিরাপত্তা প্রহরী, ক্লিনার পরিচ্ছন্নতা কর্মী, সহকারী গার্ডেনার, ইলেক্ট্রিক্যাল হেলপার, কার্পেন্টার কাঠমিন্ত্রী, হেলপার, স্যানিটারী হেলপার, পাম্প হেলপার, গাড়ির হেল্পার, এসি মেকানিক হেলপার, চৌকিদার, হোস্টেল এটেনডেন্ট, ডোম, বাইন্ডার, অদক্ষ শ্রমিক ড্রাইভার (হেবী), সুপারভাইজার, শুকানী, বাবুর্চি কুক, গার্ডেনার বাগানকর্মী, দক্ষ শ্রমিক। | ল্যাব এটেনডেন্ট, ইর্মাজেন্সি এটেনডেন্ট, স্ট্রেচার বেয়ারার, ওয়ার্ড বয়, আয়া, সহকারী বাবুর্চি, লিফটম্যান, লাইনম্যান, ফরাশ লষ্কর, মাসন হেলপার, ম্যাসেঞ্জার, মশালচি, এ্যানিমাল এটেনডেন্ট, গেষ্ট হাউস এটেনডেন্ট, | কেয়ারটেকার, ওয়ার্ড মাস্টার, ইলেকট্রিশিয়ান, লিফট মেকানিক, এসি মেকানিক, পাম্প মেকানিক, জেনারেটর মেকানিক, অন্যান্য কারিগরী কাজ সংক্রান্ত টেকনিশিয়ান এবং সহকারী ইঞ্জিন মেকানিক, টেন্ডল, গ্রিজার, টেইলর, ডুবুরি, লন্ড্রি অপারেটর, ফরাশ জমাদার, সহকারী ইলেক্ট্রিশিয়ান, |
আউটসোর্সিং চাকরি ২০২৫ । অস্থায়ী চাকরির মেয়াদ, বেতন কাঠামো, নীতিমালা দেখুন