সরকারি কর্মচারীদের বিভাগীয় মামলা হলে তা কিছু নীতিমালা বা নিয়ম কানুন অনুসরণ করে রুজু করা হয় – বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তি নীতিমালা ২০২১
বিভাগীয় মামলা –রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ ও জনপ্রশাসনে কর্মরত কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি, কার্যসম্পাদনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণে, শৃঙ্খলা রক্ষায় ও জনমুখী প্রশাসন ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪০(২) নং অনুচ্ছেদের বিধানবলে রাষ্ট্রকর্তৃক সরকারি কর্ম কমিশনের সহিত পরামর্শক্রমে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা-২০১৮ প্রণয়ন করা হয়েছে। সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে এই বিধিমালা জনপ্রশাসনে কর্মরত জনবলকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সাথে দায়িত্ব পালনে ব্রতী করার জন্য প্রচলিত রয়েছে। কর্মরত জনবলের কর্ম দক্ষতা বৃদ্ধি তথা প্রশাসনিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা পরিচালিত হয়ে থাকে। বিভাগীয় মামলার কার্যধারা পরিচালনার সাথে সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান সহজবোধ্য করে একসাথে উপস্থাপনের লক্ষ্যে এই নির্দেশিকায় প্রয়োজনীয় কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইন, বিধি বা সরকারি আদেশের সাথে এর কোনো অংশ সাংঘর্ষিক মনে হলে এবং বিষয়টি এই অনুবিভাগের দৃষ্টিগোচর করা হলে প্রয়োজনীয় সংশোধন সাধন করা হবে।
বিভাগীয় মামলা বা ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিং কি? সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এ বর্ণিত অপরাধ, সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধির পরিপন্থি কোনো কার্যকলাপ এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সময়ে সময়ে জারিকৃত পরিপত্রের মাধ্যমে নির্ধারিত কোনো আচরণের পরিপন্থি কোনো কাজ এর জন্য কোন সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত পদক্ষেপ/কার্যক্রমকে বিভাগীয় মামলা বা ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিং বলে।
অভিযোগ প্রাপ্তির পর করণীয় দপ্তর কি করে? কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাওয়া গেলে প্রথমে বিবেচনা করা হয় তিনি কোথায় কর্মরত। তিনি যদি মাঠ প্রশাসনে কর্মরত বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের কর্মকর্তা হন, তা হলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ২৬ মে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ তারিখের ০৪.০০.০০০0.511.27.156.15-৩৪৬ নং স্মারক মোতাবেক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে মতামতের জন্য প্রেরণ করা এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মতামত প্রাপ্তির পর বিভাগীয় মামলা রুজু অথবা নথিজাত করা; (পরিশিষ্ট – ২)। কোন সরকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধিমালা, ২০১৮ অনুসারে অভিযোগ উত্থাপিত হলে অভিযোগের প্রাথমিক সত্য যাচাইয়ের জন্য প্রশাসনিক তদন্ত পরিচলনা করা হয় । তবে প্রাপ্ত অভিযোগ যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ সমৃদ্ধ হলে এবং অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হলে অথবা অভিযোগের ধরন ও গুরুত্ব ইত্যাদি বিবেচনা করে প্রাথমিক/প্রশাসনিক তদন্ত ছাড়াও বিভাগীয় মামলা রুজু করা যায়। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী সম্পর্কিত হলে অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করা হয়।
বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তি হলে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হয়। চিত্র অনুসারে বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তির ধাপ দেখে নিন
নাগরিক অভিযোগে কি কিছু হয়? ক. সাধারণত সরাসরি ও অনলাইন এ দুই মাধ্যমে ৩ ধরণের উৎস থেকে অভিযোগ পাওয়া যায়। যথা-নাগরিকদের নিকট থেকে, কর্মচারী/কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এবং দাপ্তরিকভাবে।
Caption: Departmental Case against Goverment Employee
কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিভাগীয় মামলা রুজুর পক্ষে আইনগত ভিত্তি । কখন বিভাগীয় মামলা হয়?
- ক. সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর ৩১ ধারায় রাষ্ট্র বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় কার্যধারা রুজু ও পরিচালনার ক্ষমতা রয়েছে।
- সরকারি চাকরি আইনের ধারা ৪১(২) অনুযায়ী কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো আদালতে ফৌজদারি বা অন্য কোনো মামলা বিচারাধীন থাকলে একই অভিযোগে বিভাগীয় কার্যধারা রুজু ও নিষ্পত্তিতে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।
- সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ তে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে কিংবা তৎকর্তৃক দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বিভাগীয় কার্যধারা রুজু ও পরিচালনার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
- সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর বিধান অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ বলতে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অথবা রাষ্ট্র কর্তৃক সময় সময় জারিকৃত সাধারণ বা বিশেষ নির্দেশনা- সাপেক্ষে এ বিধিমালার অধীন কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য নিয়োজিত বা মনোনীত কোনো কর্মকর্তা এবং কর্তৃত্বের ক্রমধারায় নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তাকে বোঝানো হয়েছে ।
- ক্যাডার সার্ভিসের নিয়োগ বিধিতে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের উল্লেখ নেই। তবে রুলস অব বিজনেস-১৯৯৬-এর তপশিল-৪ এর ক্রমিক নম্বর ১৫ অনুযায়ী ক্যাডার সার্ভিসের কোনো পদে প্রথম নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন প্রয়োজন হয় বিধায় রাষ্ট্রপতি ক্যাডার সার্ভিসের সকল পদের নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ।
- অন্যদিকে নন-ক্যাডার পদের নিয়োগবিধি অনুযায়ী নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ সাধারণত রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা। রাষ্ট্র বলতে রুলস অব বিজনেস-১৯৯৬ এর তপশিল-৫ ক্রমিক ১৭ ও ১৮ অনুযায়ী গ্রেড-৩/ঊর্ধ্বতন পদের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য পদের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়/বিভাগের সিনিয়র সচিব/সচিব।
- গ্রেড ১০-২০ গ্রেড পর্যন্ত প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংস্থা প্রধানগণ/নিয়োগ প্রদানকারীগণ নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হিসাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন।
- যেসব ক্ষেত্রে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ মহামান্য রাষ্ট্রপতি সেসব ক্ষেত্রে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কতিপয় ক্ষমতা মন্ত্রণালয়/বিভাগের সিনিয়র সচিব/সচিবকে অর্পণ করে রাষ্ট্রকর্তৃক আদেশ জারি করা হয়েছে। উল্লেখ্য, যে সকল সরকারি কর্মচারীর নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রপতি এবং জাতীয় বেতন স্কেল’ ২০১৫ এর আওতাধীন তৃতীয় গ্রেডের নিম্নে কর্মকর্তাদের বিভাগীয় মামলা সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব/ সচিবদের মহামান্য রাষ্টপ্রতি কর্তৃক ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে । (পরিশিষ্ট – ১ )
যে সকল ক্ষেত্রে বিভাগীয় মামলা রুজু হয় না?
কতিপয় ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিভাগীয় মামলা রুজুর প্রয়োজন হয় না। বিসিএস নিয়োগ বিধিমালা-১৯৮১ বা অন্য কোনো নিয়োগ বিধিমালা/প্রবিধানমালা অনুযায়ী চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের পর শিক্ষানবিশকালে কোনো কর্মচারী চাকরিতে বহাল থাকার অযোগ্য বিবেচিত হলে কর্তৃপক্ষ তাঁর চাকরির অবসান করতে পারেন। বিএসআর-এর বিধি-৩৪ অনুযায়ী কোনো কর্মচারী এক নাগাড়ে ০৫ (পাঁচ) বছর চাকরিতে অনুপস্থিত থাকলে তাঁর চাকরির অবসান হয়। সেক্ষেত্রে উক্ত কর্মচারীকে কারণ দর্শানোর সুযোগ প্রদান করে কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট সকলের অবগতির জন্য এ মর্মে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করতে পারেন। সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ৪২ ধারা অনুযায়ী কোনো কর্মচারী ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত হওয়ার কারণে চাকরি হতে বরখাস্ত হলে বা অন্য কোনো দণ্ড প্রদানের প্রয়োজন হলে কর্তৃপক্ষ সরাসরি আদেশ জারি করতে পারেন।
বিভাগীয় মামলায় অনুসরণীয় প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি বা ধাপ কি কি? কোনো বিভাগীয় মামলায় ৬ বিধি অনুযায়ী লঘুদণ্ডের প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে এবং অভিযোগ প্ৰমাণ হলে শুধু লঘুদণ্ডই প্রদান করা যায়। তবে ৭ বিধি অনুযায়ী গুরুদণ্ডের প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে এবং অভিযোগ প্রমাণ হলে কর্তৃপক্ষ গুরু বা লঘু যে-কোনো দণ্ডই দিতে পারেন। তাই বিভাগীয় মামলার প্রক্রিয়ায় যদি গুরুদণ্ড আরোপযোগ্য হবে মর্মে অনুমিত হয় তবে গুরুদণ্ডের প্রক্রিয়াতে অর্থাৎ ৭ বিধি অনুযায়ী বিভাগীয় মামলার কার্যক্রম গ্রহণ ও পরিচালনা করা উচিত। নিম্নোক্তভাবে বিভাগীয় মামলা শুরু করা হয়। প্রাপ্ত অভিযোগের বিষয়ে প্রাথমিক সত্যতা নিরূপণের লক্ষ্যে প্রশাসনিক তদন্ত করা হয় তবে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিযোগের ধরন ও গুরুত্ব অনুযায়ী যদি এটিকে বেচনাযোগ্য মনে হয় তাহলে প্রশাসনিক তদন্ত ব্যতিরেকে সরাসরি বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়। প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার পর অভিযোগনামা ও অভিযোগবিবরণী প্রণয়ন করা হয়। অভিযোগনামা ও অভিযোগবিবরণী সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব/সচিব/ নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্বাক্ষর করার পর অভিযুক্ত কর্মচারীর নিকট প্রেরণ করার মাধ্যমে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয় এবং অভিযুক্ত বরাবর প্রেরিত পত্রটিকে প্রথম কারণ দর্শানো নোটিশ হিসাবেও অভিহিত করা হয়। অভিযুক্ত কর্তৃক ১০ (দশ) কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দাখিল করতে হয়।
১০ কার্যদিবসের মধ্যে জবাব প্রদান করা সম্ভব না হলে অভিযুক্ত কর্মকর্তা নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার আগেই গুরুদণ্ডের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ১০ কার্যদিবস এবং লঘুদণ্ডের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ৭ কার্যদিবস সময় প্রার্থনা করতে পারেন। কর্তৃপক্ষ যৌক্তিক মনে করলে উক্ত সময় মঞ্জুর করতে পারেন। অভিযুক্ত জবাবে ব্যক্তিগত শুনানির ইচ্ছা পোষণ করতে পারেন অথবা ব্যক্তিগত শুনানি নাও চাইতে পারেন। অভিযুক্তের জবাব কিংবা শুনানিতে প্রদত্ত বক্তব্য সাক্ষ্য প্রমাণ সমর্থিত মতে সন্তোষজনক না হলে লঘুদণ্ড প্রদানপূর্বক অভিযোগ নিষ্পত্তি অথবা কার্যক্রম অধিকতর তদন্ত হলে গুরুদণ্ড আরোপযোগ্য হতে পারে এরুপ বিবেচনায় করার প্রয়োজন হলে বা গুরুদণ্ড আরোপযোগ্য মর্মে প্রতীয়মান হলে তদন্ত কর্মকর্তা/ বোর্ড নিয়োগ করা হয়।