বর্তমান বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি বিষাক্ত পরিবর্তন ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠছে—এটি অর্থনৈতিক ফ্যাসিবাদ- সাম্প্রতিক মহার্ঘ ভাতা বিতর্ক দমন বাস্তবতার একটি নগ্ন উদাহরণ-মহার্ঘ ভাতার প্রশ্ন কেবল টাকা-পয়সার ব্যাপার নয় বরং অধিকারের, মর্যাদার এবং রাষ্ট্রের নৈতিক দায়বদ্ধতার প্রশ্ন জড়িত–বেতন ভাতায় সীমাহীন বৈষম্য ২০২৫
বর্তমান সময়ে মহার্ঘ ভাতা কি সুবিধা নাকি অধিকার? দেশের ১৫.৫ লাখ সরকারি কর্মচারীর মধ্যে ৯০ শতাংশের মাসিক বেতন ১৩ থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ তখন এই বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবনের ন্যূনতম চাহিদা পূরণের জন্য যে ৪-৫ হাজার টাকার মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার আলোচনা উঠেছিল সেটি ‘সুবিধা’ নয়—বরং এটি একটি বেঁচে থাকার বা অস্তিত্ব সংকট থেকে রক্ষার শেষ আশ্রয়স্থল ছিল অথচ এই ভাতা নিয়েই এখন “জাতীয় অর্থনীতির ভারসাম্য নষ্ট” হওয়ার বুলি আওড়িয়ে স্থগিত রাখা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেনের যুক্তি যদি ধরে যদি বিশ্লেষন করা যায় তবে দেখা যাবে যে, উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা গাড়ির লোন পান এবং ৫০ হাজার টাকা মেইনটেন্যান্স ভাতা পান, তাই তাঁদের মহার্ঘ ভাতা প্রয়োজন নেই—তাহলে আমরা দেখতে পাই, কীভাবে একজন অর্থনীতিবিদ গোটা কর্মচারী শ্রেণিকে গুলিয়ে ফেলে অভিজাত শ্রেণির সুবিধা দিয়ে সব সরকারি কর্মচারীর ন্যায্য চাহিদাকে অগ্রাহ্য করছেন। এ তো একপ্রকার “বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাসিবাদ”—যেখানে যুক্তি ব্যবহার করে বৈষম্যকে বৈধতা দেওয়া হয়।
শিক্ষাখাত কেন এত অবহেলিত? শিক্ষা খাতে অব্যাহত অবহেলা যেন এই বৈষম্যের সবচেয়ে করুণ প্রতিচ্ছবি। যে দেশের শিক্ষক ১৭ হাজার টাকায় বাঁচতে বাধ্য হন, সেই দেশ যখন ফিনল্যান্ডের শিক্ষার মানের স্বপ্ন দেখে তখন সেটা শুধু হাস্যকর নয় বরং নিষ্ঠুর কল্পনা। জাতিসংঘের নির্দেশিত বাজেটের তুলনায় বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে ব্যয় একেবারেই নগণ্য। ফলাফল—শিক্ষক, ডাক্তার, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সকলেই মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। অন্যদিকে, পে-স্কেলের প্রশ্নে দেখা যাচ্ছে—২০১৫ সালের পর আর নতুন কোনো কাঠামো আসেনি। নিয়ম অনুসারে ২০২০ এবং ২০২৫ সালে দুটি নতুন পে-স্কেল হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবে সরকার মহার্ঘ ভাতা দিয়েই দায় এড়িয়ে চলতে চাইছে। তারও নাটকীয় বাস্তবতা—এই ভাতা দিতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে আসা, নতুন করে হিসাব মেলানো, দোষারোপের রাজনীতি।
ড. ফাহমিদা খাতুনের আশঙ্কা যে এটি মূল্যস্ফীতি বাড়াবে—তা অমূলক নয়, কিন্তু সেটি ঠেকাতে গিয়ে যদি শ্রমজীবী মানুষদের ন্যায্য পাওনা কেড়ে নেওয়া হয় তবে সেই রাষ্ট্র কাদের জন্য কাজ করছে? এই প্রশ্ন ফাঁকা বুলি নয়—এটি রাষ্ট্রের আদর্শিক চরিত্রের আয়না। থমাস পিকেটি ও কার্ল মার্ক্স আমাদের দেখিয়েছেন, যখন রাষ্ট্র কেবল ক্ষমতাশীল শ্রেণির সেবক হয়ে ওঠে, তখন সমাজে শোষণ একটি নিয়মে পরিণত হয়। আজ বাংলাদেশেও উচ্চপদস্থ আমলা ও নীতিনির্ধারকরা সেই ‘নতুন বুর্জোয়া’ হয়ে উঠেছেন, যারা নিজেদের স্বার্থে নীতিনির্ধারণ করেন—আর সাধারণ কর্মচারীরা রয়ে যান বঞ্চিত, চাপা কণ্ঠস্বরের ‘প্রলেতারিয়েত’। মহার্ঘ ভাতা বিতর্ক তাই কেবল অর্থনৈতিক নয়—এটি একটি রাজনৈতিক ও নৈতিক লড়াইয়ের অংশ।
বাংলাদেশে ১১-২০ গ্রেডের সরকারি কর্মচারীরা মাসিক বেতনে সংসার চালাতে মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন। মূলত, তাদের বেতন কাঠামো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না।
এ লড়াই হচ্ছে শাসক শ্রেণির স্বেচ্ছাচারিতা বনাম জনগণের ন্যায্য অধিকারের। রাষ্ট্র যদি এখনই বৈষম্য দূরীকরণের স্পষ্ট পদক্ষেপ না নেয়, তবে সেই রাষ্ট্র ফ্যাসিবাদের পথে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে—যেখানে সত্য, যুক্তি আর ন্যায়বিচারের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে ‘কে কতটা ক্ষমতাবান’। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলা এখন শুধু নাগরিক দায়িত্ব নয়—এটি একপ্রকার প্রতিরোধ।
Caption: Info by Research
বেতন ও মূল্যস্ফীতির বৈষম্য ২০২৫ । কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন বৈষম্য কোথায়?
- বেতন ও মূল্যস্ফীতির বৈষম্য: প্রতিবছর গড় মূল্যস্ফীতি প্রায় ৬% হলেও, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি হয় মাত্র ৫%। ফলে, প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে এবং গত ছয় বছরে প্রায় ৬% নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কর্মচারীদের বেতন-ভাতায় ।
- বেতন কাঠামো: ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী, ১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীদের মূল বেতন ৮,২৫০ টাকা (২০তম গ্রেড) থেকে শুরু হয়ে সর্বোচ্চ ৩০,২৩০ টাকা (১১তম গ্রেড) পর্যন্ত নির্ধারিত হয়েছে । তবে, এই বেতন দিয়ে বর্তমান বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, বাড়িভাড়া এবং অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
- অতিরিক্ত ভাতা ও সুবিধার সীমাবদ্ধতা: ১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীরা মাসিক মাত্র ৩০০ টাকা যাতায়াত ভাতা পান, যা উপজেলা পর্যায়ে কার্যকর নয়। এছাড়া, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড সুবিধা না থাকায় তাদের বেতন বৃদ্ধির সুযোগ সীমিত ।
- কর্মচারীদের দাবি: এই পরিস্থিতিতে, ১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীরা বেতন বৈষম্য দূরীকরণ, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল, এবং অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির জন্য ৭ দফা দাবি উত্থাপন করেছেন । সার্বিকভাবে, বর্তমান বেতন কাঠামো ১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীদের জন্য পর্যাপ্ত নয়, এবং তাদের জীবনযাত্রার মান বজায় রাখতে সরকারকে বেতন স্কেল পুনর্বিবেচনা ও প্রয়োজনীয় সংস্কার করা জরুরি।
- গ্রেড ব্যবধানের অসামঞ্জস্য: কর্মকর্তাদের ১ম থেকে ১০ম গ্রেড পর্যন্ত প্রতিটি গ্রেডে বেতন ব্যবধান গড়ে ২০.৪% রাখা হয়েছে, যা বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ও পদোন্নতিতে তাদের জন্য সুবিধাজনক। অপরদিকে, ১১তম থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীদের বেতন ব্যবধান মাত্র ৩-৪%, ফলে তাদের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি ও পদোন্নতির সুযোগ সীমিত।
- টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের বিলুপ্তি: আগে কর্মচারীরা নির্দিষ্ট সময় পর টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের মাধ্যমে বেতন বৃদ্ধি পেতেন। তবে বর্তমান বেতন কাঠামোতে এই সুবিধাগুলো বিলুপ্ত হওয়ায় কর্মচারীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশ সার্ভিস রুলস
- বাজারমূল্যের সাথে বেতনের অসামঞ্জস্য: বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সীমিত আয়ের কর্মচারীরা সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, ১১তম গ্রেডের একজন কর্মচারীর দৈনিক বেতন প্রায় ৪১৭ টাকা, যা ছয় সদস্যের পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত নয়।
- বেতন কাঠামোর বৈষম্য: ২০১৫ সালের অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে ১ম থেকে ১০ম গ্রেডের মোট বেতন ব্যবধান ১,৫৫,৬২০ টাকা, যা মোট বেতনের ৯৪%। অপরদিকে, ১১তম থেকে ২০তম গ্রেডের ব্যবধান মাত্র ৬,৩৭৫ টাকা, যা মোট বেতনের ৬%।
বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের বেতন এত কম কেন?
বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের বেতন কম হওয়ার কারণগুলি হলো বেতন বৈষম্য, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির হার কম, মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। সচিবালয়ের কর্মচারীদের তুলনায় সচিবালয়ের বাইরে কর্মরত কর্মচারীদের বেতন কম। বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির হার বর্তমানে ৫%। এটি দ্রব্যমূল্যের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে না। অত্যাধিক মূল্যস্ফীতির কারণে সকলের ক্ষেত্রেই জীবিকার মান অনেক নিম্নমুখী হয়েছে। বাংলাদেশে সাধারণ পরিবারের দৈনন্দিন খাদ্য খরচ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সর্বনিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের বেতন উল্লেখযোগ্যভাবে কম, বিশেষ করে ঢাকার মতো শহরে বসবাসকারী একজন কর্মচারীর জন্য। ১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীগণ মানববেতর জীবন যাপন করছে। না পারছে চাকরি ছাড়তে না পারছে চাকরি করতে -তারা দোটানায় পড়ে গেছে সংসার চালাবে নাকি চাকরি চালাবে।
ক্রেডিট: মোঃ ফারুক | ||